আমার এলাকার লোকেরা মনে করে কোন ব্যক্তির মৃত্যুর খবর শুনলে আমি জানাজা পড়ার জন্য যাই। সব জানাজায় উপস্থিত থাকতে পারাতো আর সম্ভব না। তবে আত্মীয়, দূর-আত্মীয়, পরিচিত, সমাজকর্মী, সৎ পেশাজীবী, নিজ পাড়ার লোকদের জানাজায় হাজির হওয়ার চেষ্টা করি। তবে এখন শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
চট্টগ্রাম শহর থেকে বাঁশখালী যাওয়া আসা কমপক্ষে চার ঘন্টা গাড়ী যাত্রা করতে হয়। দিনটা পুরো চলে যায়। উপস্থিত সুহৃদদের তড়িঘড়ি করে ফেলে আসা যায় না। পরিচিতজনদের আদর, শ্রদ্ধা, কুশল বিনিময় করে সামাজিক চেতনাবোধকে জাগ্রত রাখার এক মোক্ষম সুযোগ এই জানাজা। এসব করতে গিয়ে প্রায় সময় নিজেকে ভুলে যাই। অন্যদের বিষয়াদিই যেন মুখ্য চিন্তা বা আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কোন জড়তা থাকে না, কিছুটা আবেগ ও আন্তরিকতার এক রমরমা বাজার হয়ে ওঠে জানাজার স্থানটি। কেউ কেউ আবার নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় আলাপ বা কাজও সেরে নেন। জানাজায় অংশগ্রহণ বা উপস্থিতি সামাজিক যোগাযোগের একটি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। এত আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব বা পরিচিতজনদের উপস্থিতি দেখে মৃতের পরিবারও তাদের শোকে কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পায়। আর সমাজে সবার সাথে দীর্ঘদিন বাস করা একজন লোকের বিদায় হয়ে উঠে মর্যাদাপূর্ণ। একটি দীর্ঘ জীবন মানুষ্য সমাজে নানা কর্মকাণ্ডে অতিবাহিত করার পর চির বিদায়ের দিনে এরূপ একটি জানাজাতো তার প্রাপ্যও বটে।
গত শতাব্দীর ষাট-সত্তুরের দশকেও দেখেছি জানাজার জন্য সারিবদ্ধভাবে মানুষ দাঁড়ানোর পর কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে মৌলানা সাহেব জানাজার নিয়্যত বলে দিতেন। আর বলতেন – লাইন সোজা করুন, পরনের কাপড় পায়ের গোড়ালীর উপর তুলুন, পায়ের সেণ্ডেল জুতা খুলে রাখুন আর তাকবীর বলার সময় ঈদের নামাজের মত করে কাঁধে হাত উঠাবেন না। মৌলানা সাহেবের আগে বা পরে মৃতের ভাই বা ছেলে কিংবা পরিবারের কেউ বলতেন,“ আমার … মারা গিয়েছেন। তিনি জীবিত অবস্থায় কোন কাজে বা কথায় আপনাদের মনে আঘাত দিয়ে থাকলে আমি তার (বা পরিবারের) পক্ষ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি, আর কারো সাথে টাকা পয়সার লেন দেন থাকলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে আমরা শোধ করে দেব। আপনাদেরকে তার জন্য বেহেশত কামনা করার অনুরোধ করছি। আর দূর-দূরান্ত থেকে কষ্ট করে এবং সময় ব্যয় করে উপস্থিত হওয়ায় আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি”। ইসলামের দৃষ্টিতে জানাজায় উপস্থিত হয়ে মৃতের জন্য দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। মূলত জানাজার নামাজটিই দোয়া। এখনও মসজিদে নববী চত্বরে জানাজার পর দ্রুতগতিতে কফিন দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হয়।
গত প্রায় ৩০/৪০ বছর যাবৎ আমাদের দেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামে এক বিরক্তিকর কাজ শুরু হয়েছে। জানাজার স্থলে কফিন আসার পর শুরু হয় ছোট বড় রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক নেতাদের বক্তৃতার জোয়ার। একের পর এক বক্তৃতা চলতেই থাকে। মৃতের আত্মীয়রাও এতে নিজেদেরকে গর্বিত মনে করেন (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। যেন নেতৃবৃন্দের বক্তৃতায় মরহুম ও তার পরিবারের মান মর্যাদা পত পত বা তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছে। অথচ, গ্রীষ্মকালে দুপুরের কিংবা বিকেল বেলার জানাজার জন্য দাঁড়ানো জনতার মাথা ও কপাল রোদে পোড়ার যন্ত্রণার দৃশ্য বক্তাদের চোখে পড়লেও তা তারা আমলেই নেয় না। কেউ কেউ রোদ ঠেকানোর জন্য কপালে ও মাথায় পত্রিকা বা টুপি ধরে রাখে আর মনে মনে (অনেক সময় প্রকাশ্যেও) বক্তাদের ভর্ৎসনা করতে থাকে। আমি মনে করি এ বিষয়ে আমার বিস্তারিত লিখার প্রয়োজন নেই। বলতে গেলে প্রিয় পাঠকবৃন্দই এ বিষয়ে অবগত আছেন, ভুক্তভোগীতো বটেই। তবে আমি আমার সামনে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনা উপস্থাপন করছি।
বৈলছড়ী আজিুল উলুম মাদ্রাসার ‘আউয়াল সাহেব’ নামে খ্যাত অত্যন্ত পরিমিতিবোধ সম্পন্ন গুণী লোক মৌলানা ছৈয়দ আহমদ সাহেবের বিরাট জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ২৯.১২.২০০৬ তারিখ জোহরের নামাজের পর। বাঁশখালীর সাবেক ও তৎকালীন সাংসদ জানাজার স্থানটিকে তাদের বক্তৃতা প্রতিযোগিতার মঞ্চ বানিয়ে ফেলেন। তাদের একজন কথার ফাঁকে ৫/৬ বার বলে ফেললেন যে, সাতপীর আউলিয়ার দোয়ায় তিনি বাঁশখালীর জনগনের জোর খেদমত করে যাচ্ছেন। প্রখর রোদে অতীষ্ঠ হয়ে কিছু কিছু ব্যক্তি উচ্চস্বরে গালমন্দ দেয়া শুরু করলেন। কেউ কেউ আবার জমির আলের উপর বসে পড়েন। ঐদিন বৃদ্ধ লোকদের যথেষ্ট কষ্ট হয়েছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি জমিয়াতুল ফালাহ ময়দানের এটি জানাজায়। রোদ ও বক্তার যন্ত্রণায় অতীষ্ঠ হয়ে সামনের কাতারের জনৈক সাহসী প্রতিবাদী লোক নিজের জুতাজোড়া দিয়ে কপালের রোদ ঠেকালেন। সাথে সাথে উচ্চ বাচ্য ব্যতিরেকে বক্তার বক্তৃতা বন্ধ হয়ে যায়। আশে পাশে দাঁড়ানো লোকজন সাহসী লোকটির প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ মন্তব্য করলেন।
একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার পক্ষে কোন কোন সময় সব জানাজায় উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেই ক্ষেত্রে পরবর্তীতে মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের টেলিফোন করে (প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে) সমবেদনা জানাই। তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাকে আবার বেকায়দায়ও পড়তে হয়। মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা টেলিফোন পাওয়ার পর বলা শুরু করেন – কোন কোন বড় মানুষ বা কোন কোন বড় নেতা জানাজায় উপস্থিত হয়ে কতক্ষণ সময় ছিলেন, কিংবা এই মাতা বা পিতা বা ভাই বা স্ত্রীকে (মৃত ব্যক্তিকে) চিকিৎসার জন্য কোন কোন ডাক্তার বা কোন কোন হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে কত টাকা খরচ করেছেন এই সব। অর্থাৎ চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কোন ত্রুটিই ছিল না।
প্রিয় পাঠক, মৃতের পরিবার ইচ্ছা করলে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে জানাজা স্থলে অন্তত ঘন্টাব্যাপী বা সম্ভাব্য সময় ধরে মৃত ব্যক্তির জীবনের উপর একটি আলোচনা পর্ব রাখতে পারে। ধর্মীয় ও নৈতিকভাবে মৃতের প্রশংসা করা প্রয়োজনও বটে। কিন্তু ঘোষিত সময়ের পর উপস্থিত মুসল্লিদের কাজে লাগিয়ে কিংবা বলতে গেলে এক প্রকার জিম্মি করে বক্তৃতা প্রদান আইন, নীতি, ধর্মের দিক থেকে কোনভাবে সিদ্ধ হতে পারে না। এভাবেই নীতিজ্ঞান সচেতন হয়ে পরবর্তি প্রজন্মকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমার, আপনার, সচেতন মহলের।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজব্রতী