লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল পরিচালনার পাশাপাশি দেদারসে বিক্রি হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এমন অভিযোগ, ভেজাল, মানহীন ওষুধ ও সামগ্রী বিক্রির তালিকায় রয়েছে নামিদামি মডেল ফার্মেসিগুলোও। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওষুধ বিক্রিতে জবাবদিহি না থাকায় ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব হচ্ছে বাজার, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ফার্মাসিস্ট ছাড়াই দিনের পর দিন চলছে ফার্মেসি। গত ১২ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘ডিপ্লোমা ছাড়াই নার্স, ওষুধও মেয়াদোত্তীর্ণ’ শীর্ষক সংবাদে দেখা যায়, লাইসেন্স নবায়ন না করায় নগরীর চট্টেশ্বরী রোডের সিটি হেলথ ক্লিনিক নামে একটি বেসরকারি হাসপাতাল সিলগালা করে দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। পুলিশের সহায়তায় সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি হাসপাতালটি সিলগালা করেন। এর আগে গর্ভপাতে এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা এক মামলায় হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক হারুনকে গ্রেপ্তার করে চকবাজার থানা পুলিশ। এরপর পুলিশকে সাথে নিয়ে ওই হাসপাতালে অভিযানে যান সিভিল সার্জন। বেশ কিছু অনিয়ম ধরা পড়ায় হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। দীর্ঘ দিন হাসপাতালটির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, হাসপাতালটিতে দায়িত্বরত নার্সদের কোনো প্রকার ডিপ্লোমা নেই বলে আমরা জানতে পেরেছি। অর্থাৎ নার্সিং ডিপ্লোমা ছাড়াই নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে হাসপাতালটিতে। আর রোগীরা অভিযোগ করেছেন রাতে কোনো ডাক্তারই পাওয়া যায় না। হাসপাতালে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও পেয়েছি। এছাড়া ফ্রিজে ওষুধের পাশাপাশি একই সাথে মাংসও রাখা হয়েছে। পরে হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দ ও ধ্বংস করা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধবিরোধী অভিযান পরিচালনা করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। আদালত সে সময়ে বলেছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধবিরোধী অভিযান পরিচালনা কাজ প্রশংসনীয়। এটাকে চলমান রাখতে হবে। জনসাধারণ, ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী সবাইকে সচেতন হতে হবে। অন্যদিকে, ওষুধের পাতায় (স্ট্রিপ) স্পষ্ট করে বাংলা ও ইংরেজি বড় হরফে মেয়াদ, উৎপাদনের তারিখ ও মূল্য লেখার ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্রপক্ষকে বলেছেন আদালত। একই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি, সংরক্ষণ ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফার্মেসি ব্যবস্থাপনায় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তিনটি লক্ষ্য। তা হলো- জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ওষুধ বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং প্রচলিত ওষুধ আইনের প্রয়োগ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধু আইনের প্রয়োগ করলেই চলবে না। প্রয়োজন জনসচেতনতাও। নকল, আনরেজিস্টার্ড ওষুধ কীভাবে চেনা যাবে, ফার্মেসি ব্যবস্থাপনা কীভাবে করতে হবে, ফার্মেসিতে ওষুধ কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, ইনভয়েসের মাধ্যমে ওষুধ কেনা কেন আবশ্যক, অনেক সময় ফার্মেসির মালিক- ফার্মাসিস্ট এসব তথ্য না জেনে অপরাধ করে থাকেন।
তাই জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ গ্রহণও প্রয়োজন। তাঁরা বলেন, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে চিকিৎসক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। ওষুধ কেনার সময় মেয়াদোত্তীর্ণ কি না সেটি দেখে কিনতে ব্যবস্থাপত্রে রোগীদেরকে পরামর্শ দিতে হবে চিকিৎসকদের। ভেজাল এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ যাতে বাজারে প্রবেশ করতে না পারে, এ জন্য চিকিৎসকদেরকে অবশ্যই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বেশিরভাগ ফার্মেসি ওষুধ সংরক্ষণের জন্য কক্ষের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখে না। বিশেষজ্ঞরা ওষুধ সংরক্ষণের জন্য কক্ষের তাপমাত্রা যথাযথ রাখতে ফার্মেসি মালিকদের নির্দেশ প্রদান করতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, এ ধরনের সার্কুলার আমাদের সকলের জন্য সুফল বয়ে আনবে। এ বিষয়ে ফার্মাসিস্টদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তাঁরা।
নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নেওয়া সরকারি পদক্ষেপের মধ্যেও থেমে নেই এ অপরাধ। নতুন কৌশল অবলম্বন করে নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে অপরাধীরা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। মানবতা ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।