ভূগোলের গোল

ডা. কিউ.এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১০ নভেম্বর, ২০২০ at ৪:৩৬ পূর্বাহ্ণ

বিস্মৃত পাকিস্তানী বিজ্ঞানী :
প্রফেসর আবদুস সালাম

১৯৭৬ সালে ছাত্র অবস্থায় ইটালীর ট্রিয়েস্ট শহরে গিয়েছিলাম। এই শহরটা বেলগ্রেড থেকে ট্রেনে ঘণ্টা সাতেক সময় লাগে। ট্রিয়েস্ট ছোট্ট শহর। আড্রিয়াটিক সাগরের তীরে ছিমছাম শহর। শহরে সাগর তীরের ভিলা ছাড়া দেখার মতো তেমন কিছু নেই। আমার যাওয়ার কারণ ছিল ইটালীর ভেনিস শহরের কানেকটিং ট্রেনটি ট্রিয়েস্ট থেকে ছিল। ইয়থ হোস্টেলের সস্তা খাবারের টেবিলেই পরিচিত হলাম এক পাকিস্তানী ছাত্রের সাথে। সে পদার্থ বিদ্যার ছাত্র। সেই আমাকে ট্রিয়েস্ট শহরে দেখার মত জায়গা আন্তর্জাতিক থিওরেটিকেল ফিজিঙ সেন্টার এর কথা বলল। এটার প্রতিষ্ঠাতা পাকিস্তানী নাগরিক প্রয়াত প্রফেসর ড. আবদুস সালাম। আমি তখন সালাম সাহেবের নামও শুনিনি। তখনও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। পাকিস্তানী ছাত্রটা আমাকে এই বিজ্ঞানী সম্বন্ধে অনেক কিছু বলল। সে তার সাথে এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে এই বিজ্ঞানীর সাথে দেখা করতে যেতে প্রস্তাব করলে আমিও রওনা হই। পাকিস্তানীটা তাঁর অফিসে না গিয়ে সরাসরি বাস ভবনে গেল। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি তখন লন্ডনে ছিলেন।
শুধু ধর্মগত বিবেচনায় মানুষ যে কত বেওকুফ হতে পারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রর ও জনগণের প্রফেসর সালামের প্রতি উদাসীন নিগ্রহ তার প্রমাণ। তালিবান কর্তৃক আক্রান্ত মালালা ইউসুফজাই যখন ২০১৪ সালে নোবেল পুরস্কার পায় তখন কিছু শিক্ষিত পদার্থ বিদ্যার ছাত্র ছাড়া পাকিস্তানীরা জানতই না যে মালালার আগে আরো একজন পাকিস্তানী নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন।
পাকিস্তানীদের ড. সালামের প্রতি উদাসীন তার কারণ হচ্ছে তিনি কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোক, রাষ্ট্রীয় ভাবে পাকিস্তান কাদিয়ানীদের “অমুসলিম” ঘোষণা করে।
এই বিজ্ঞানী ১৯২৬ সালে ক্ষুদ্র একটি পাকিস্তানী শহর জং এ জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি অষ্টম শ্রেণী থেকেই সরকারি পয়সায় লেখাপড়া করেন। মেট্রিক পরীক্ষায় সারা বৃটিশ ভারতে অংকে পূর্ণ ১০০ নম্বর পেলে সেই জমানায় কয়েক গ্রামের লোক ড. সালামকে দেখতে আসেন। গ্রামের সেই ছেলে লাহোর, গভঃ কলেজ এ ভর্তি হন। সেখানেও অংকে অসাধারণ রেজাল্ট করেন। প্রফেসর সালাম এক জবানীতে উল্লেখ করেছেন যে তিনি প্রথম বিদ্যুৎবাতি দেখেন লাহোরে। লাহোরের সালিমার বাগান বা বাদশাহী মসজিদ থেকেও তাঁর কাছে আশ্চর্য লেগেছিল “বিদ্যুতের বাতি।” সেই থেকে পদার্থ বিদ্যায় তার আকর্ষণ।
ড. সালাম সাহেবের পিতা ও শিক্ষা দপ্তরের কর্মচারী ছিলেন, তার আশা ছিল যে- ছেলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিবেন। বৃটিশ ভারতে তিনি পরীক্ষায় পাস করেন। কিন্তু ডাক্তারী পরীক্ষায় তাকে ডিস্‌ কোয়ালিফাই করা হয়। এরপর তিনি কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য বলে যান। সেখানেই তার গবেষণার ভিত্তি ও থিওরেটিকেল ফিজিঙ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ডিগ্রী শেষে তিনি পাকিস্তানে এসে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি পাকিস্তান সরকারের সায়েন্টিফিক উপদেষ্টা রূপে কাজ করেন। পাকিস্তানের বিজ্ঞান গবেষণা থেকে শুরু করে আনবিক বোমা বানানো প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার ব্যবস্থাপনাতেই হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে ইটালীর ট্রিয়েস্ট শহরে আন্তর্জাতিক থিওরেটিকেল ফিজিঙ সেন্টার হওয়ার পর পাকিস্তান। বাংলাদেশ ও ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের প্রচুর শিক্ষার্থীকে ড. সালাম পৃথিবীর বড় বড় একাডেমিকদের কাছে কাজ করার ব্যবস্থাপনা করে দেন। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করলে সরকারি পদের সাথে তার ইতি ঘটে। তিনি এরপর লন্ডন ও ইটালীতে অবস্থান করেন। ইটালী, বৃটেন ও আমেরিকা তাকে নাগরিকত্ব দিতে চাইলেও তিনি পাকিস্তানী নাগরিকত্ব ত্যাগ করেননি। থিওরী অফ পারটিকলস, বর্তমান বিশ্বের পদার্থ বিদ্যার ‘হিগস- বোসন” ড. সালামের গবেষণার ধারাবাহিকতা মাত্র।
প্রায় বার বছর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সম্প্রতি এই বিস্মৃত বিজ্ঞানীর উপর এক প্রামাণ্য চিত্র প্রস্তুত হয়েছে। পাকিস্তানীরা এই বিজ্ঞানী সম্বন্ধে এখন মাত্র জানতে শুরু করেছে। এই প্রামাণ্য চিত্রের ইতিহাস ও চমকপ্রদ। ওমর জাকির ও থাভের নামে দুইজন পাকিস্তানী ছাত্র আমেরিকায় লেখাপড়া করতে গিয়েছিল। দুজন বন্ধু। একদিন রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে ১৯৯৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রফেসর সালামের উপর এক দীর্ঘ প্রবন্ধ দেখে দুজন। দুজন ভাবল “বাতির নীচে সত্যিই অন্ধকার”। পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের এই বিজ্ঞানীকে শুধু ধর্মীয় কারণে জনগণের কাছে অজ্ঞাত রাখে। এই দুই বন্ধু তখন থেকে ড. সালাম সম্বন্ধে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এই প্রামাণ্য চিত্র তৈরীর পরিকল্পনা নেয়।
১৯৭৯ সালে নোবেল পান প্রফেসর সালাম। পুরো আফগানী সেলওয়ার-পাঞ্জাবী ও মাথায় পাগড়ী বেঁধে তিনি নোবেল নিতে যান। নোবেল বক্তৃতায় প্রফেসর সালাম পবিত্র কোরানের সূরা মুলকের ৩ ও ৪নং আয়াত পাঠ করেন। এই দুই আয়াতে নভো মণ্ডলের নিখুঁত সৃষ্টিতে আল্লাহর কুদরত ও মানুষের জ্ঞানের সীমিত পরিধির কথা উল্লেখ করা হয়। দুঃখের বিষয় হল পাকিস্তানে নোবেল বিজয়ের কোন উল্লাস ও সংবাদই ছিল না।
নোবেল পাওয়ার পর প্রফেসর সালাম তার লাহোর সনাতন ধর্ম কলেজের অংকের শিক্ষক অনিলেনদ্র গাংগুলীকে খুঁজে বের করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানান। ভারত সরকার দুই বছর চেষ্টা করে এই শিক্ষককে দক্ষিণ কোলকাতায় খুঁজে পান। এ দিকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮১ সালে প্রফেসর মোহাম্মদ সালামকে দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী গোল্ড মেডেল দেবার আমন্ত্রণ জানান। মূল আলোচনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাংগনে হলেও প্রফেসর সালামের অনুরোধ স্বর্ণ পদক প্রদান অনুষ্ঠানটা তার বৃদ্ধ শিক্ষক অনিলেনদ্র গাংগুলীর দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে হয়। ড. সালাম মেডেলটা তার শিক্ষকের গলায় পরিধান করান এই বলে যে “অংকের যে দীপ আপনি আমার মধ্যে জ্বালিয়েছিলেন তার ফল এই মেডেল”, অতএব এটা আপনারই প্রাপ্য।”
১৯৯৬ সালে বিলাতের অক্সফোর্ড শহরে তিনি মারা যান। তার মরদেহ পাকিস্তানে এনে তার জন্ম স্থানের রাবাওয়া কবরস্থানে তাকে কবর দেয়া হয়। তার কবরে একটা পাথরের ফলকে লিখা ছিল-
“প্রথম মুসলিম বিজ্ঞানী- যিনি নোবেল পান”, স্থানীয় পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ এই ফলকটিতে “মুসলিম’ শব্দটি মুছে দেয়।
সরকার যতই ধর্মীয় কারণে এই অসাধারণ বিজ্ঞানীকে পাকিস্তানের জনগণ থেকে অজ্ঞাত রাখুক নূতন প্রজন্ম ড. সালামের উপর এই প্রামাণ্য চিত্র দেখে এই প্রতিভা সম্বন্ধে বিস্মৃত হচ্ছে। এই উপমহাদেশে ধর্মীয়, রাজনৈতিক কারণে অবহেলার শিকার শুধু বিজ্ঞানী প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুস সালামই নন আরো অনেকে আছেন। ভিন্ন মতের জন্য অনেক প্রতিভাকে উপমহাদেশের বিভিন্ন সরকার শুধু অবহেলাই করেন নি- দেশছাড়াও করেছেন। ড. সালামকে সরকার ছাড়লেও তিনি কিন্তু জন্ম ভূমিকে ছাড়েন নি। বিস্মৃত অবস্থায় সেই মাটিতেই কবরস্থ আছেন।
লেখক : চিকিৎসক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যের দৈনিক আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধবাগদাদে সেনা চৌকিতে হামলা, নিহত ১১