সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র এক ধ্রুপদী সৃষ্টি ‘লালসালু’। উপন্যাসটা হয়ত আমাদের অনেকের পড়া আছে। আজকের প্রজন্ম বা এখনকার পাঠ্যবইয়ে উপন্যাসটি অন্তর্ভুক্ত আছে কিনা জানা নেই। এই উপন্যাসের একটা লাইন মনে গেঁথে ছিল তখনই। বাংলার কোন এক গ্রামের চিত্র আঁকতে গিয়ে লেখক লিখেছিলেন, ‘যেখানে শস্যের চাইতে আগাছা বেশি, ধর্মের চাইতে টুপি বেশি।’ রাজনীতি যখন আদর্শিক রাজনীতিবিদের আওতার বাইরে, এলাকার ক্ষমতা যখন মাদকাসক্ত, বখাটে বর্বরদের কব্জায়, অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নই যখন সমাজের মূল চালিকা শক্তি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যখন নিজের অস্তিত্ব সংকটে, আর সচেতন সমাজ যখন অসচেতন, তখন এমন সব ঘটনার জন্ম হচ্ছে যা আমাদের কল্পনাতীত।
এই সমাজে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে একটা ‘উগ্রবাদী ভাব’ এসেছে। তারা তাদের যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে। যাদের মধ্যে নেই মানবিকতা, নেই কোন শিষ্টাচার। গোটা সমাজকে তারা নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। কেউ তাদের রুখছে না। ব্যবহার করছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ব্যানার। সরকারি দলের ব্যানার থাকলেও, এদের পেছনে আছে নানান অপশক্তি। এরা মূলত একটি নির্দিষ্ট এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য ও নানান সুবিধা ভোগের জন্যে একটি সর্বদলীয় সিন্ডিকেট। যখন যে সরকার ক্ষমতায়, এই সিন্ডিকেট সবসময় সক্রিয়। সরকারি খাস জায়গা জমি দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন, পাহাড়ে গাছ কেটে বিরান ভূমিতে পরিণত করা, পাহাড় কেটে নেয়া থেকে শুরু করে গোটা এলাকাকে মাদক ব্যবসার আখড়া বানিয়ে ফেলছে এই দুর্বৃত্তের দল। এলাকার নতুন নতুন উঠতি বয়েসি ছেলেদের নষ্ট করার কারখানায় পরিণত হয়েছে এরা। রাজনীতির নামে গ্রুপ ভারী করার জন্যে এদেরকে শিক্ষা, নীতি ও আদর্শহীন একটি প্রজন্মে পরিণত করছে। পড়াশুনায় ফেল করে, মাদকাসক্ত ও বখাটেপনায় জড়িয়ে যাওয়া এসব ছেলে গুলোকে দিয়ে খুব সহজেই নানান কুকর্ম করানো যায়। ভাবতেই অবাক লাগে, অনেক অভিভাবক নিজ সন্তানের এমন কর্মকাণ্ডে বেশ গর্ববোধও করেন।
হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, “সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।” রাজনীতি আমাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন অংশ নয়। সমাজে বসবাসকারীদের একটি বৃহৎ অংশ রাজনীতির সাথে জড়িত। এরাই সমাজের নীতি নির্ধারক হয়ে বসে আছে। আর টিনের চশমা পরে বসে আছে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি। গুটিকয়েক সচেতন নাগরিক এসবের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেও, সাধারণ মানুষ তাদের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে না। সমাজের পয়সাওয়ালারা তাদের নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্যে, এই দুর্বৃত্তদের পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। এদের সকল কর্মসূচিতে তাদের বড় অঙ্কের অনুদান দিয়ে থাকে। অথচ এরা সভা-সেমিনার, গোল টেবিল বৈঠকে দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কথা বলে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল; এসব দুর্বৃত্তদেরকে একশ্রেণির মানুষ ক্ষমতাবান বলে বাহবা দেয়, এদের সাথে সখ্য গড়ে তুলে, তাদের লেজুড়বৃত্তি করে।
টাকার গরমে যাদের পা মাটিতে পড়ছে না। যাদের অবৈধ টাকার দাপটে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাটি অসহায়, প্রিয় শিক্ষকটা কোণঠাসা, ভাল মানুষগুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে দূরে তাদের ব্যাপারে সজাগদৃষ্টি থাকা জরুরি। নানান সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, মসজিদ-মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদে যোগ্যদের বাদ দিয়ে পয়সাওয়ালা অযোগ্যরা স্থান করে নিচ্ছে। আপনার এলাকার ভদ্র, সুশীল শিক্ষিত মানুষটি যে সম্মান পাওয়ার দরকার সেই জায়গাটি দখল করে মঞ্চে উপবিষ্ট এলাকার সবচেয়ে বড় টাউট। এর দায় আপনাকেও বহন করতে হবে। এরাই এলাকায় সন্ত্রাসী বখাটেদের আশ্রয় প্রশ্রয় ও ইন্ধনদাতা। এদের চিহ্নিত করুন, সামাজিক ভাবে বয়কট করুন। নিজে বাঁচুন এই সমাজটাকে বাঁচান। চেয়ে চেয়ে দেখার দিন শেষ। মনে রাখুন, “নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না।”
২.
নুসরাত পর্ব শেষ হতে না হতেই, পর পর দুই ঘটনায় সারাদেশের বিবেকবান মানুষের মধ্যে নাড়া দিয়ে গেছে। গত সপ্তাহে সিলেটের মুরারি চাঁদ কলেজ এলাকায় স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে একজন নারী গণধর্ষণের শিকার হন। এই ঘটনায় সারা বাংলাদেশের মানুষ স্তম্ভিত! দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। সেখানে এক নারীর সঙ্গে মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঘটনা ঘটেছে। অবৈধ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তার ঘরে ঢুকে তাকে নগ্ন করে দফায় দফায় শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে বখাটেরা। ঘটনা আগের হলেও মাসখানেক পর ফেসবুকে ভাইরাল হয় বিষয়টি। নৃশংস নির্যাতনের শিকার এই গৃহবধূকে তার বসত ঘরে ঢুকে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। বহুবার পায়ে ধরে ভাই, বাবা ডাকা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয়নি এই বোনটির। এমন ঘটনা প্রতিদিন কোন না কোন জায়গায় ঘটছে। তারা কারা? তাদের পেছনের শক্তি কি? কোন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তারা যেকোন জঘন্য অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করছে না! তারা কি রাষ্ট্রের চেয়েও বেশী শক্তিশালী?
সমাজে সাধারণত যেসব অন্যায়-অপকর্ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে, তার মধ্যে নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য হচ্ছে ধর্ষণ। প্রতিদিন কত হাজারো নারী বাংলাদেশের কোন না কোন প্রান্তে এভাবেই নিপীড়িত নির্যাতিত হচ্ছে, তার কয়টা খবর আমরা জানি। লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া এসব ঘটনার কয়টাইবা ভাইরাল হয়েছে। নারী নির্যাতন রোধে বিভিন্ন আইন ও তাতে শাস্তির বিধান থাকলেও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে নারীর ওপর সহিংসতা দিন দিন বাড়ছেই। ছোট-বড় সব নারীর সম্মান রক্ষা করা সমাজের নৈতিক দায়িত্ব এবং নারীর ওপর সহিংসতা বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততাও এজন্য কোন অংশে কম দায়ী নয়। একেবারে যে বিচার হচ্ছে না সেটা বলা যাবে না। কোন অপরাধী অপরাধ করেই পার পেয়ে যাচ্ছে তাও নয়। প্রশাসন ঘটনার খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধীদের আটক করছে। সমস্যা যেটা হচ্ছে তা হল, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যথেষ্ট শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও নির্যাতনকারীরা বিভিন্ন উপায়ে পার পেয়ে যায়। আইন এবং তদন্ত আর বিচার প্রক্রিয়া সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে যেভাবে তদন্ত এবং বিচার হয়, তাতে নারীরা অভিযোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে উৎসাহী হন না। এর ফলে বেশির ভাগ ধর্ষণের ঘটনার কোন বিচারই হয় না। কেউ সাহস করে অভিযোগ নিয়ে আসলেও, তাকে পুনরায় সামাজিক ধর্ষণের শিকার হতে হয়।
চারিদিকে যে লোমহর্ষক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, এতে জোর দিয়ে বলতে পারি যে নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। এমনকি তার স্বামী ও তার নিজের বাবা-মার কাছে থেকেও সে নিরাপদ নয়। এর জন্য আমি এ দেশের বিচার ব্যবস্থাকে দায়ী করবো না। ক্রসফায়ার বা জনসম্মুখে হত্যাকেও সমর্থন করব না। কারণ একটা অপরাধের বিচার করতে অন্য আরেক জঘন্য অপরাধের সমর্থন দিতে পারি না। বিচার ব্যবস্থা সারা বিশ্বে এমনই। সঠিক ও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে যথেষ্ট সময় প্রদান করা প্রয়োজন। কোন একটা অপরাধ করলে তাকে কোন গোষ্ঠীর ট্যাগ দেয়ার সংস্কৃতি ন্যায় বিচারের অন্তরায়। একজন ধর্ষককে ধর্ষক হিসেবেই দেখা উচিৎ। ধর্ষক কোন ধর্মের বা রাজনৈতিক দলের সদস্য সেটি বিবেচ্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, এসব অপরাধীরা রাজনৈতিক রং মেখে বরাবরই সুবিধা নিয়ে থাকে। ধর্ষণের বিচার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে এবং দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে তার শাস্তি কার্যকর করা দরকার। তাহলে এ দেশে আর কোন ধর্ষণকারী থাকবে না। যে সমাজ ধর্ষক তৈরি করে সে সমাজ ভাঙতে হবে, নতুন সমাজ গড়তে হবে। প্রয়োজনে পাড়ায় পাড়ায় ধর্ষণবিরোধী ব্রিগেড গড়তে হবে।
পরিশেষে, ভাল মানুষের মুখোশ পরে থাকা মানুষগুলো যখন, ভাল কাজ করবে না, তখন নষ্টরা তো আর বসে থাকবে না। তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাবে। আপনি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে ভয় পান, নষ্টদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাহলে এই সমাজের সুস্থতা কিভাবে আশা করেন। কিভাবে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আশা করেন। মানুষ নিজেই যখন অপরাধী, রাষ্ট্রকে দায় দেয়া তখন অযৌক্তিক। সময় হয়েছে বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করার। নয়তো ধ্বংস হবে এই যুব সমাজ, বর্বরতায় ছাড়িয়ে যাবে সকল সীমা-পরিসীমা, নিপীড়িত হবে নারীরা, ধর্ষিত হবে পুরো সমাজ। আমরা কি কেবল চেয়ে চেয়ে দেখবো?
লেখক : প্রাবন্ধিক, ছাত্রনেতা