ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার লড়াইয়ে ভূমিকার জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পেল এবারের শান্তির নোবেল। নরওয়ের নোবেল কমিটি গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ১০১তম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য জাতিসংঘের এ সংস্থার নাম ঘোষণা করে। নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসন বলেন, আন্তর্জাতিক সংহতি ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি দৃশ্যমান।
‘ক্ষুধামুক্তির লড়াই, যুদ্ধ ও সংঘাত কবলিত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পরিস্থিতির উন্নয়নে ভূমিকা এবং যুদ্ধ ও সংঘাতে অস্ত্র হিসেবে ক্ষুধাকে ব্যবহার রোধে গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করায় নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে শান্তিতে ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ খবর বিডিনিউজের।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি খাদ্য সহায়তার উদ্দেশ্যে গঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি শাখা। ৮৩টি দেশের ৯১.৪ লাখ মানুষকে খাদ্যের সংস্থানে সহায়তা করে থাকে এই সংস্থা। ১৯৬০ সালে ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অরগানাইজেশনের কনফারেন্সের পরে ১৯৬৩ সালে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আমেরিকার ‘ফুড ফর পিস’ প্রোগ্রামের ডিরেক্টর জর্জ ম্যাকগভার্ন এক বহুপাক্ষিক খাদ্য সহায়তা সংস্থার প্রস্তাব রাখেন। এরই ফল হল ১৯৬৩-তে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠা। প্রথমে তিন বছরের জন্য পরীক্ষামূলক ভাবে এই সংস্থা গঠিত হয় রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা এবং ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের তত্ত্বাবধানে। ১৯৬৫ থেকে এটি একটি নিয়মিত সংস্থার রূপ পায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দান এবং সংস্থাগত ও ব্যক্তিগত আর্থিক সহায়তাতেই এই সংস্থা পরিচালিত হয়। ইতালির রোমে এর সদর দপ্তর অবস্থিত।
গত কয়েক বছরে এই কর্মসূচির আওতায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল, ২০১০ সালে হাইতিতে ভূমিকম্পের সময়ে সেখানকার মহিলাদের মধ্যে খাদ্য বণ্টন। মহিলাদের হাতে খাদ্য তুলে দেওয়ার পিছনে যুক্তি ছিল, এভাবেই বিপর্যস্ত পরিবারগুলিতে খাদ্য যথাযথ উপায়ে পৌঁছবে। সেই সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম স্কুলগুলিতেও খাদ্য পৌঁছে দিতে থাকে। ৭১টি দেশ এই স্কুল-ফিডিং প্রোগ্রামে উপকৃত হয়। ২০১৫-য় ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম ৮১টি দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়। ২০১৭-এ জর্ডানের সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের মধ্যে খাদ্য বণ্টনে অগ্রণী ভূমিকা নেয় ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম। ২০২০-য় ইয়েমেনে বিপন্ন মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিতে সমর্থ হয় এই সংস্থা। বর্তমানে কোভিড-১৯ অতিমারিতে বিপন্ন জনগোষ্ঠীগুলির কাছেও আপদকালীন ভিত্তিতে খাদ্য-সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম। রিপাবলিক অব কঙ্গো, উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেনেও বিশেষ ভাবে সক্রিয় রয়েছে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম।
নোবেল জয়ের খবরের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি টুইট করে বলেছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ১০ কোটির বেশি শিশু, নারী আর পুরুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে জীবন উৎসর্গ করেছেন ডব্লিউএফপির কর্মীরা। এই পুরস্কারে তাদের কাজ স্বীকৃতি পেল। আর ডব্লিউএফপির প্রধান ডেভিড বিয়াসলে বলেছেন, জীবনে এই প্রথম বোধ হয় আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
বিবিসি লিখেছে, চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ২১১ জন ব্যক্তি এবং ১০৭টি প্রতিষ্ঠানের নাম জমা পড়েছিল নোবেল কমিটির কাছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পরিবেশ আন্দোলনে নজর কাড়া সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের নামও সেই তালিকায় ছিল। ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দুই দশকের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে গতবছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলী।
এ বছর নোবেল পুরস্কারের সম্মানী বাড়িয়ে এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার করা হয়েছে। এমনিতে প্রতি বছর স্টকহোমে অনুষ্ঠান করে নোবেল পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় বিজয়ীদের হাতে। সেখানে তারা বক্তৃতাও দেন। তবে এবার করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে রাজকীয় সেই আয়োজন থাকছে না। তার বদলে নোবেলজয়ীরা নিজের দেশে বসে ওয়েবিনারে অংশ নেবেন নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে। আগামী বছরের পুরস্কার বিতরণীতে তাদের স্টকহোমে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
আগামী ১২ অক্টোবর অর্থনীতিতে এবারের নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে। এর মধ্য দিয়ে চলতি বছরের নোবেল মৌসুমের সমাপ্তি ঘটবে।