ইসলামে তাসাওফ চর্চার গুরুত্ব
তাসাওফ চর্চার মূলনীতি : মহা গ্রন্থ আল কুরআনে তাসাওফ চর্চা ও অনুশীলনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সূরা ফাতিহায় এরশাদ হয়েছে, “হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করো, তাদেরই পথে যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ করেছো।” (আল কুরআন, ১:৫)
আল কুরআনে তাসাওফের নির্দেশনা : মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল করীম ও প্রিয় নবীর সুন্নাহ তথা হাদীস শরীফই তাসাওফ তথা সূফীবাদের উৎস। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “ যে ব্যক্তি নিজ আত্মাকে বিশুদ্ধ করেছে সে সফলকাম হয়েছে আর যে একে কলুষিত করেছে, সে অকৃতকার্য হয়েছে।” (আল কুরআন, সূরা: শামস, ৯১: ৯.১০)
তাসাওফ পরিচিতি :
আধ্যাত্মিক জগতের মহান দিকপাল হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (র.) তাসাওফ সম্পর্কে বলেন, তাসাওফ শব্দটি আরবি চারটি বর্ণের সমষ্টি প্রথম বর্ণ “তা” দ্বিতীয় বর্ণ “সোয়াদ” তৃতীয় বর্ণ “ওয়াও” এবং চতুর্থ বর্ণ “ফা” প্রতিটি বর্ণ মাহাত্ম্য জ্ঞাপক যেমন “তা” বর্ণ তাওবাহ এরদিকে ইংগিতবহ, তাওবাহ দু’প্রকার বাহ্যিক তাওবাহ ও অভ্যন্তরীণ তাওবাহ, সোয়াদ বর্ণ দ্বারা “সাফা” এর অর্থ পরিচ্ছন্নতা অন্তরের পরিচ্ছন্নতা হলো মানবীয় পাপ পঙ্কিলতা থেকে অন্তর পবিত্র হওয়া যা সাধারণত মানষের অন্তরে পাওয়া যায়, যেমন অধিক পানাহার, অধিক নিদ্রা, অধিক কথা বলা ও দুনিয়ার সাথে অধিক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি। আর অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতা হলো, আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছু থেকে অন্তরাত্মকে মুক্ত রাখা। “ওয়াও” বর্ণ দ্বারা বেলায়ত বুঝায়। বেলায়তের সারকথা হলো, বান্দা নিজকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা। যেমন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও” তাসাওফ শব্দের সর্বশেষ বর্ণ “ফা” দ্বারা ফানাফিল্লাহ তথা বান্দা নিজেকে আল্লাহতে বিলীন করে দেওয়া। যখন মানবীয় গুণ বিলীন হয়ে যায় তখন খোদায়ী গুণ বিকশিত হয়। সুতরাং ধ্বংসশীল বান্দা চিরন্তন সত্তার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি বিধানে স্থায়িত্ব অর্জন করতে পারে। (সিররুল আসরার, পৃ: ৮৮, ৮৯)
ইসলামী মনীষীদের দৃষ্টিতে তাসাওফ : হযরত মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আবু তালিব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মতে তাসাওফ হচ্ছে অনুপম সুন্দর চরিত্রের নাম, যার চরিত্র যতবেশী সৌন্দর্য মন্ডিত তিনি ততবেশী উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন হবে। (তারিখে মাশায়েখ ই চিশত, পৃ: ১৮) হযরত আবুল হুসাইন আননুরী (র.) বলেন, সামগ্রিকভাবে কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ পরিত্যাগ করার নামই তাসাওফ। (ফী তাসাউফীল ইসলামী, পৃ: ৩১) শায়েখ আবুল হাসান (র.) বলেন, তাসাওফ নিছক প্রথাগত বিদ্যা ও কেবল একটি শাস্ত্রের নাম নয়, বরং চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের নাম তাসাওফ। (রিসালাই কুশায় রিয়্যাহ, পৃ: ১৯)
দাতা গঞ্জ বখশ আলী হাজভিরী (র.) মতে অন্তরকে সত্যের বিরোধিতার পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র ও মুক্ত রাখার নাম তাসাওফ। (কাশফুল মাহজুব)। প্রখ্যাত সূফী সাধক হযরত ইমাম মারুফ কারখী (ওফাত ৮১৫ খ্রি.) এর মতে তাসাওফ হচ্ছে হাকীকত তথা সত্যকে গ্রহণ করা এবং মানুষের হাতে যা আছে তা অর্জন থেকে বিমূখ হয়ে যাওয়া। পার্থিব অর্জন, যশ-খ্যাতি, লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ও বিলাস বহুল জীবন যাপনের মহড়া থেকে নিজকে পবিত্র ও মুক্ত রেখে সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে, কল্যাণের পথে, হেদায়তের পথে এবং আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তষ্টি বিধানের পথে নিজকে নিয়োজিত রাখাই তাসাওফের মূল শিক্ষা।
প্রকৃত সূফী কারা?: হযরত বিশর হাফী (র.)’র মতে “আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে যিনি স্বীয় আত্মা পরিশুদ্ধ করে নেন। তিনিই সূফী। (ফী তাসাউফিল ইসলামী, পৃ: ২৯), হযরত যুননুন মিসরী (র.) বলেন, সূফী এমন এক শ্রেণির বিশেষ বান্দা যারা জীবনের প্রত্যেক বস্তুর উপরে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালবাসাকে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেন। (ফী তাসাউফিল ইসলামী, পৃ: ২৯)
হযরত জুনাইদ বাগদাদী (র.) (ওফাত ২৯৭)’র মতে সূফী হচ্ছে, পবিত্রতার সাথে নিজকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ ছাড়া সকল কিছুর প্রভাব থেকে নিজকে মুক্ত রেখে আল্লাহর জন্য যিনি মনোনীত হয়েছেন, তিনি সূফী।
সূফী প্রসঙ্গে শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (র.)’র অভিমত : সূফী ওই ব্যক্তি যিনি কুপ্রবৃত্তির বিপদ থেকে পবিত্র থেকেছেন। নিন্দিত অপকর্ম থেকে মুক্ত। নিরাপদ প্রশংসিত পথে পরিচালিত হয়ে সত্যকে অনিবার্যরূপে গ্রহণ করেছেন, সৃষ্টিরাজির কারো সাথে অন্তরের সংযোগ রাখেন না। (গুণীয়াতুত তালেবীন)
পূর্ববর্তী সূফীগণ ছিলেন জ্ঞানের আঁধার: পূর্ববর্তী সূফীগণ ইলমে শরীয়তের ইমাম ছিলেন আল্লামা ইবনুল যওজী (র.) বলেন, পূর্ববতী সূফীগণ কুরআন হাদীস তাফসীর ও ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রের ইমাম ছিলেন।
নামধারী সূফী থেকে সতর্ক হোন: আজকের যুগে সূফী নামধারীদের অনেকে শরঈ জ্ঞানশূন্য, যথারীতি শারঈ জ্ঞানে পারদর্শী না হয়েও আল্লামা ও শাহসূফী উপাধি ধারণকারী অনেক ভন্ড প্রতারক প্রতিনিয়ত সরল প্রাণ মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। ইসলাম বিরোধী, শরীয়ত বিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার পরও শাহসূফী লক্বব ধারন করা প্রকৃত সূফীবাদ তথা সূফীয়্যায়ে কেরামের শিক্ষা ও আদর্শের সাথে প্রতারণা ও প্রহসনের শামিল। এসব ভন্ড সূফীদের বেশভূষা দেখে সরলপ্রাণ নিরহ মানুষগুলো প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। এদের স্বরূপ উম্মেচন এবং এদের অশুভ তৎপরতা ও প্রতারণা থেকে দেশ জাতি ও মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করা সকলের ঈমানী দায়িত্ব।
ভন্ড সূফী থেকে বিরত থাকুন: সরলপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় অনূভূতি ও চেতনাকে পুজি করে এক শ্রেণির ভন্ড ধর্মীয় চেতনাকে পুজিকরে মানুষকে বিভিন্ন কৌশল ও অভিনব পন্থায় বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ইয়াহিয়া মু’আয রাযী (র.) বলেন, “তিন প্রকার লোকের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। এক. অলস ও অমনযোগী আলিম থেকে। দুই, প্রতারক পদদেলী, তোষামোধ কারী ফক্বীর থেকে এবং তিন অজ্ঞ সূফী থেকে।
হাদীস শরীফে ইলমে তাসাওফ তথা ইলমে বাতেনীর কথা বর্ণিত হয়েছে: হযরত হাসান বসরী (র.) বর্ণনা করেন, ইলম দু’প্রকার। অন্তরের ইলম, এটি উপকারী ইলম। মুখের ইলম এটি আদম সন্তানের উপর দলীল। অন্তর সম্পর্কিত ইলমই হচ্ছে তাসাউফ বা সূফীবাদ। এ প্রকার ইলমের নাম ইলমে বাতিন। যেমন হযরত আবু হুরায়রা (রা.) আনহুর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হযরত আবু হুরায়রা (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম এর নিকট থেকে দু’টি জ্ঞানের পাত্র সংরক্ষণ করেছি। এক প্রকার জাহেরী জ্ঞান যা আমি তোমাদের মধ্যে বর্ণনা করেছি, অপরটি যদি আমি বর্ণনা করতাম, তাহলে আমার কণ্ঠনালী কেটে ফেলা হতো , (মিশকাত শরীফ, ইলম পর্ব: পৃ: ৩৭)
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই সূফীবাদী প্রিয় বান্দারা এ প্রকার ইলমের অধিকারী, এ প্রকার ইলমে তাসাওফের সূচনা হয় হযরত আদম আলায়হিম সালাম থেকেই। তাসাউফের প্রথম শিক্ষক হলেন, হযরত আদম আলায়হিস সালাম। নবী প্রেরণের ধারাবাহিকতায় সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন তাসাওফের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা।
প্রখ্যাত সূফী সাধক হযরত ইমাম হাসান বসরীর সাধনা : সাহাবায়ে কেরাম ও তারেঈদের যুগে তাসাওফ চর্চা অব্যাহত থাকলেও তাঁদেরকে সূফী নামে অভিহিত করা হতো না। দার্শনিক আল বেরুনীর মতে “সূফী” শব্দটি প্রথম কুফাবাসী আবু হাশিম উসমান ইবনে শরীফ (ওফাত: ১৬২ হিজরি ৭৭৭খ্রি.) থেকে শুরু হয়।
দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ ভাগে সূফী নামটি জনসাধারণে বিস্তার লাভ করে। এ সময়ের প্রসিদ্ধ সূফী সাধক হচ্ছেন হযরত হাসান আল বাসরী (র.), তিনি হিজরি ২১ সালে মদীনা শরীফে জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত আলী (রা.)’র খিলাফতকালে তিনি বসরায় গমন করেন। হিজরি ১১০ সালে এখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। এখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। ১২০ জন সাহাবীকে দেখার সৌভাগ্য তাঁর নসীব হয়েছে। যাঁদের মধ্যে ৭০ জনই ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মহান সাহাবী। (ইসলামী ইনসাইক্লোপিডিয়া, করাচি, পৃ: ৭৮৪)
ইবরাহীম ইবনে ঈসা বলেন, আমি আখিরাতের চিন্তায় হাসান বসরীর চেয়ে অধিক চিন্তিত ও ক্রন্দনকারী আর কাউকে দেখিনি। হযরত হাসান বসরী (রা.) বলেন, “হে মানব সন্তান, তুমি আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়া বিক্রি করে দাও, এতে তোমরা দুটিই লাভ করতে পারবে। সাবধান দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাতকে বিক্রি করো না, এতে দুটিই হারাবে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় তাসাওফের অনুপস্থিতির পরিণতি: আজকের সমাজে অনাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, ধর্ষণ, গনধর্ষণ, লুণ্টন, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, ছিনতাই, অনৈতিক ও অনৈসলামিক কর্মকান্ডের যে বিস্তৃতি। অপরাধ প্রবণতা ক্রমাগত যে হারে বৃদ্ধি হতে চলছে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ধর্মীয় চেতনা আজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। দেশ ও জাতির এ ক্রান্তিকালে নৈতিক অবক্ষয় রোধে “ইলমে তাসাওফ” এর চর্চা অনুশীলন আদর্শ ও আলোকিত মানুষ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে সূফীবাদী আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। পবিত্র কুরআনের বরকত আমাদের দান করুন। নিশ্চয় আল্লাহ মহান দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।