করোনাকালে কোভিড পরীক্ষা, করোনা পজিটিভ রোগীর চিকিৎসা, অক্সিজেন, আইসোলেশন সেবা নিয়ে চারিদিকে যখন অস্থিরতা চলছিল তখন স্বাস্থ্য বিভাগের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বেতনের একটি অংশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়াও কোভিড চিকিৎসায় এগিয়ে এসেছিল নানা প্রতিষ্ঠান। একইভাবে বেসরকারি বিদ্যুৎ প্লান্ট মালিকদের সংগঠন বিআইপিপিএ করোনা শনাক্তকরণ কিটসহ নানা সরঞ্জাম দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে। প্রশ্ন উঠেছে, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগকে দেয়া ২৫ হাজার কিটের বিল হিসেবে বিআইপিপিএকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) থেকে ৫০ লাখ টাকার বিল পরিশোধ নিয়ে।
২৫ হাজার কিটের বিল পরিশোধের জন্য গত ২০ জুলাই বিপিসি চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফারহানা রহমান স্বাক্ষরিত পত্রে (স্মারক নম্বর : ২৮.০০.০০০০.০২০.৯৯.০০১.২০.১৪৪৪) উল্লেখ করা হয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) এর মাধ্যমে গত ১৪মে ডেলিভারি চালানের মাধ্যমে ২৫ হাজার করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ কিট স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিচালক, আইইডিসিআর বরাবর সরবরাহ করা হয়। উক্ত কিট হতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহে কর্মরত দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞগণের নভেল করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য ৫ হাজার কিট সংরক্ষণ করার জন্য গত ১৭ মে বিদ্যুৎ বিভাগ হতে পত্রের মাধ্যমে আইইডিসিআরকে সচিব, স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে অনুরোধ করা হয়। বিষয়টি ডেলিভারি চালানেও উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে বিআইপিপিএ কর্তৃক সরবরাহকৃত কিটের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে বিল দাখিল করা হয়েছে।
পত্রটিতে উল্লেখ করা হয়, গত ২৪ মার্চ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় করোনা ভাইরাসের দুর্যোগকালে ভাইরাস শনাক্তকরণ কিট, পিপিই, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ের জন্য দপ্তর/ সংস্থা/ কোম্পানিসমূহ তাদের সিএসআর ফান্ড (সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল) হতে আপদকালীন খরচ মিটানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এমতাবস্থায় বিআইপিপিএ কর্তৃক সরবরাহকৃত ২৫ হাজার কিটের বিল বাবদ তার কর্পোরেশন ও আওতাধীন কোম্পানির সিএসআর ফান্ডের ২০১৯-২০ অর্থবছরের অর্থ হতে ৫০ লাখ টাকা বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ)কে পরিশোধের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা গেলো।
এরপর বিপিসি চেয়ারম্যানের নির্দেশে ১৭ আগস্ট বিপিসির সচিব মো. লাল হোসেন স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে আওতাধীন চার প্রতিষ্ঠান হতে ৫০ লাখ টাকা আদায় করে বিপিসি। তন্মধ্যে পদ্মা অয়েল কোম্পানি ১০ লাখ, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ৩০ লাখ, যমুনা অয়েল ৫ লাখ এবং এসএওসিএল থেকে ৫ লাখ টাকা করে নিয়ে নেয় বিপিসি। পরে ২৮ সেপ্টেম্বর বিআইপিপিএ এর বরাবরে ৫০ লাখ টাকার চেক প্রদান করে বিপিসি।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফারহানা রহমান ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘মন্ত্রী (বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী) মহোদয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি মিটিং করেছিলেন। আমি পুরো বিষয়টি জানি না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দুই বিভাগের মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আমি শুধু আদিষ্ট হয়ে চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলাম।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘করোনা কিট কিংবা সরঞ্জাম উৎপাদন ও সরবরাহ করা বিআইপিপিএ’র ব্যবসায়িক কাজ নয়। এটা উনাদের বাণিজ্য নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে দেশের সম্পদের বেশিরভাগ ওরা লুটপাঠ করে খাচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকলেও তাদের টাকা দিতে হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকলে উল্টো পিডিবির পক্ষ থেকে তাদের দৈনিক ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়। করোনাকালে দাতা সেজে কোভিড শনাক্তকরণ সরঞ্জাম দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তারা সরকারের কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইমেজ গড়ে তুলেছেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, এটাও একটা বিশেষ উদ্দেশে করেছেন। উপরে দেখাচ্ছে দিচ্ছেন, ভেতরে কিন্তু নিয়ে নিচ্ছেন। দেয়া-নেয়ার মধ্যে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, সেটা আসলে খতিয়ে দেখা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘তাদের যে অবৈধ চুক্তি ও লুটপাটের ব্যাপারটা দীর্ঘায়িত করার জন্য, তাদের চুক্তি নবায়ন করার জন্য, তাদের বিলগুলো (সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ) পাওয়ার জন্য তারা এ ধরনের দাতা সেজেছিলেন। তারা করোনা কিট উৎপাদনকারী নন, আমদানিকারকও নন। তারা হয়তো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে কোন আমদানিকারক সংস্থাকে দায়িত্ব দেবে। তারা এগুলো (করোনা সরঞ্জাম) হস্তান্তর করবে। এটা মিডিয়াতে প্রচার হওয়ায় জাতি তাদের থ্যাংস দিয়েছে। অন্তরালে সরকারি টাকা নিয়ে ফেলার কৌশল যারা দিচ্ছেন এবং যারা নিচ্ছেন তারা দুইপক্ষই দায়ী। দিনশেষে দেখা যাবে- দেয়ার নাম করে গোপন লেনদেন কিংবা আবার আইওয়াশ করে নিয়ে ফেলছে কি না, সেটাও আমরা জানি না। দুর্ভাগ্যক্রমে করোনাকে কেন্দ্র করে দেশের টাকা হরিলুট করার জন্য কিছু খাত তৈরি করা হয়েছে। মূলত মানবিকতা যাঁরা দেখিয়েছেন, তাদেরকে আমরা জানি না, দেখি না। আর এটাকে পুঁজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গগুলো লুটপাট করেছে, এটা হয়তো তার একটি কাহিনী।’
এব্যাপারে বিপিসি চেয়ারম্যান সামছুর রহমান ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দুই বিভাগ থেকেই দেয়া হয়েছে। আমাদের মন্ত্রী ও সচিব মহোদয় মিলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে অনুদান হিসেবে দিয়েছিলেন। চিঠিতে ভুল থাকতে পারে।’ তবে বিআইপিপিএ-কে বিপিসি থেকে সরাসরি চেক প্রদানের বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে জানার পরামর্শ দেন বিপিসি চেয়ারম্যান।
এবিষয়ে জানতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন জানিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠান। পরে ক্ষুদে বার্তা দিয়ে এ বিষয়ে তাঁর কাছে প্রশ্ন করা হলে কোন উত্তর মেলেনি।
তবে বিআইপিপিএ সভাপতি ইমরান করিম গত ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও বিআইপিপিএ একসাথে প্রায় ১০ কোটি টাকার বিভিন্ন মালামাল দিয়েছি। এগুলো গ্রান্ড (দান) ছিল। সেখানে পিপিই ছিল, কিটও ছিল। ফান্ডের জন্য বসে থাকলে তখন করোনাকালীন সংকটে সরঞ্জামগুলো কেনা যেতো না। সেজন্য আগে থেকে পুরো টাকাটাই আমরা খরচ করেছিলাম। বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ওখানে অংশীদার হওয়ার জন্য আমাদেরকে কমিন্টমেন্ট দিয়েছিল তারা কিছু কিছু ফান্ড আমাদের দেবে। এখন প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআর ফান্ড থেকে কিছু কিছু টাকা বিআইপিপিএ-কে দিচ্ছে। যেটা বিআইপিপিএ আগেই খরচ করেছিল।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় কত টাকা দিচ্ছে বিআইপিপিএকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফিফটি ফিফটি হওয়ার কথা। আমরাতো ১০ কোটি টাকা খরচ করেছি। তারা হয়তো ৩-৪ কোটি টাকা আমাদের দেবে।’ মূলত এসব সরঞ্জাম বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিআইপিপিএ যৌথভাবে দিয়েছে বলে দাবি করেন এই বেসরকারি উদ্যোক্তা।