হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও এক বিচারপতির মৃত্যু

আর সপ্তাহ পাঁচেক পর অর্থাৎ ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচাইতে বেশি তর্কবিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানএই দুই দলের মধ্যে হয়ে থাকলেও, ২০২০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে ডেমোক্র্যাট পার্টি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে, রিপাবলিকান পার্টির সাথে নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এবারের নির্বাচন মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে ‘রেফারেন্ডাম’। ‘দলের ঊর্ধ্বে নেতা নয়’ বলে কথা থাকলেও এটি মানতেই হবে বর্তমানে দলকে ছাড়িয়ে গেছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প একাই দল। বলা চলে তিনি রিপাবলিকান পার্টি ‘হাইজ্যাক’ করেছেন। তাকে ঘিরেই দল, যা এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোন রাজনৈতিক দলে দেখা যায়নি। কোন দল এমনভাবে দেউলিয়া হয়ে কেবল একজনকে ঘিরে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায়নি। ট্রাম্প দল বা দলের নেতাকাউকে তোয়াক্কা করেন না। তার যখন যা খুশি তাই করেন এবং বলেন যুক্তিহীন কথাবার্তা। তিনি যা করেন, যা বলেন পছন্দ না হলেও রিপাবলিকান দলীয় নেতারা কোন প্রতিবাদ ছাড়া মাথা নত করে মেনে নেন। তারা মেনে নিচ্ছেন গত প্রায় চার বছর ধরে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বিটার পিল’ অর্থাৎ ‘তেতো বড়ি’ তাই তাদের গিলতে হয়েছে দিনের পর দিন বিগত প্রায় চার বছর ধরে। তারা খুব ভাল করেই জানেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একজন নৈতিকতাবিহীন, স্বঘোষিতবর্ণবাদী, ক্ষেপাটে, মিথ্যুক ও অসৎ ব্যক্তি। তিনি কোনোদিন কোন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তিনি স্রেফ রিয়েলস্টেট ব্যবসায়ী ও টেলিভিশন উপস্থাপক। ব্যবসায়ও সততার আশ্রয় নেননি। সেখানেও দিয়েছেন ট্যাঙ ফাঁকি। রিপাবলিকান পার্টি এবং দলের নেতারা এসব কিছু খুব ভালোভাবে ওয়াকেবহাল। কিন্তু সব জেনেও তারা মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। কেননা নির্বাচনীবৈতরণী পার হবার তাদের একমাত্র আশাভরসা এই ‘আনপ্রেডিক্টবল’ লোকটি, যার পুরো নাম, ডোনাল্ড জন ট্রাম্প, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট।

প্রাকনির্বাচনী বিভিন্ন জরিপে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাইতে অনেক এগিয়ে আছেন। অনেক ক্ষেত্রে ডাবল ডিজিটে। কিন্তু সেটিই শেষ কথা নয়। আজ থেকে ৩ নভেম্বর এই সময়টুকুর মাঝে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে, যা এই জরিপের ফলাফলকে মিথ্যে প্রমাণিত করতে পারে। তেমনটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। সে সময়ও প্রাকনির্বাচনী জরিপে হিলারি ক্লিনটন অনেক এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু জয়ী হলেন ট্রাম্প, যা কেউ এমন কী রিপাবলিকান দলের নেতা, সমর্থকরাও ভাবেননি। অনেক দিন ধরে দেশের বিরাজমান নানা সমস্যাকে ঘিরে এবারের নির্বাচনে অনেক আলোচনা, জল্পনাকল্পনা চলছে। কোভিড১৯ কে সামলাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইতিমধ্যে দুই লক্ষের কিছু বেশি আমেরিকান নাগরিক ‘করোনায়’ মারা গেছেন। অথচ কী অবাক করা গতকাল (২২ সেপ্টেম্বর) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বললেন, যারা মারা গেছেন তারা কেবল বয়স্ক লোকজন। দুই লক্ষাধিক নাগরিক মৃত অথচ তিনি বললেন, ‘এ এমন কিছু না’। ক্ষমতার মোহে কী পরিমাণ অন্ধ হলে একজন রাষ্ট্র কর্ণধার এই ধরনের অর্বাচীন কথাবার্তা বলতে পারেন, ভাবতে অবাক হতে হয়। তার আচরণে, কার্যকলাপে এটিই মনে হয়, এতগুলি প্রাণহানিতে তিনি মোটেই বিচলিত নন। কোরোনার শুরু থেকে ট্রাম্পের মিথ্যে বলা, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করা, মাস্ক পরিধানের বিরোধিতা করা এবং নাপরার জন্যে তার সমর্থকদের উৎসাহিত করা, জনসমাগম নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তার নির্বাচনী প্রচারণায় স্বাস্থ্যবিধি না মেনে জনসমাগম করা একটির পর একটি অন্যায় ও জনগণের জন্যে ক্ষতিকর কর্মকান্ড করে চলেছেন ট্রাম্প। কোন প্রতিবাদ, কোন সমালোচনা, নিষেধ তাকে থামাতে পারছে না। তার কথা ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’, আর তার সোনার হরিণটি হলো, ‘হোয়াইট হাউস’। শেতাঙ্গ পুলিশের হাতে নিরীহ কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান নাগরিক হত্যার প্রতিবাদে যখন গোটা আমেরিকা বিক্ষুব্ধ ও উত্তাল, তখন তিনি প্রতিবাদকারীদের লুটেরা, সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে, তাদের প্রতিবাদকে দমাতে ফেডারেল বাহিনী পাঠান। জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নর ও মেয়রদের রাজ্য পরিচালনায় ব্যর্থ বলে তাদের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন এবং প্রকাশ্যে পুলিশি বাড়াবাড়ির সমর্থন জানান। গোটা জনগণ একদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অন্যদিকে। বিগত প্রায় চার বছর তিনি দেশ শাসন করেছেন স্বৈরশাসকের মত। ঠিক যেন রাশিয়ার পুতিন, উত্তর কোরিয়ার কিম কিংবা তুরস্কের এরদোগান। একজন সাধারণ ব্যক্তির মাঝে যে সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা ও ভব্যতা তার অভাব সম্পূর্ণভাবে এই ব্যক্তিটির মধ্যে। তারপরও এই বিতর্কিত, নিন্দিত ব্যক্তিটি আরও চার বছরের জন্যে আমেরিকার মত শক্তিশালী দেশ শাসন করার জন্যে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন। এবং অবাক হবোনা যদি তিনি আবারো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। প্রশ্ন আসে, এতই যদি নিন্দিত ও ঘৃণিত হন, তাহলে আমেরিকার জনগণ কি তা দেখছেন না? তারা কি সে বিচার করবেন না? বিষয় হলো, আমেরিকার নির্বাচনী পদ্ধতি ভিন্ন, যেখানে কেবল সাধারণ জনগণের ভোটই চূড়ান্ত রায় নয়। যে কারণে ২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারী ক্লিনটন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাইতে কয়েক লক্ষ ভোট (পপুলার ভোট) বেশি পেয়েও হেরে গেছেন ইলেকটোরাল ভোটে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যের লোকসংখ্যা অনুপাতে এই ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এখন দেখা যাক এই ইলেক্টোরাল ভোট কে বেশী পায়ট্রাম্প না জো বাইডেন।

এদিকে চলতি সপ্তাহে ৮৭ বছরের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুত বাদের গিন্সবার্গ মারা গেলে শুরু হয় নতুন বিতর্ক ও আলোচনা। তার মৃত্যু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পালে যে সুবাতাস নিয়ে এসেছে সন্দেহ নেই। কেননা সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারপতির মধ্যে এদ্দিন ৪ জন ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের পক্ষে এবং বাকি পাঁচ জন রিপাবলিকান দলের। গিন্সবার্গের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ডেমোক্র্যাট দলীয় বিচারপতিরা আরো কোণঠাসা হয়ে পড়লেন। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন গিন্সবার্গকে ১৯৯৩ সালে বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেন। অন্যদিকে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প শূন্যস্থান পূরণে দুজন নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেন। যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা দেশের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিয়োগ পান এবং এনারা আমৃত্যু বা স্বেচ্ছায় অবসরে না যাওয়া পর্যন্ত বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন। এখন শূন্যস্থান পূরণ করার জন্যে স্বাভাবিকভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দল উঠে পড়ে লেগেছেন এবং তাদের পছন্দমাফিক প্রার্থী দিতে পারলে সুপ্রিম কোর্টে তাদের আধিপত্য একেবারে নিশ্চিত। দেশের বড় বড় ইস্যুগুলিতে যেমন গর্ভপাত, ওবামাকেয়ার, গেম্যারেজ, অভিবাসী ইত্যাদি সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এই সমস্ত ইস্যুতে ট্রাম্পের অবস্থান কোথায় তা সবাই জানেন। এদিকে ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতারা চাইছেন বিচারপতির আসনে নতুন প্রার্থী নির্বাচন যেন ৩ নভেম্বর নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত না হয়। তাই জন্যে তারা সমস্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জো বাইডেন ইতিমধ্যে এই বলে মন্তব্য করেছেন, জনগণ সিদ্ধান্ত নেবেন এবং তা হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর। তবে ডেমোক্র্যাট দল তাদের দাবীতে কতটুকু সফল হবে তাতে সন্দেহ আছে। ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দল আদাজল খেয়ে নেমেছেন এই যুদ্ধে। সাধারণত কোন ‘সিটিং’ বিচারপতি যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে মারা যান বা স্বেচ্ছায় অবসরে যান, তাহলে সে বছর শূন্যস্থান পূরণ করা হয়না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর তা করা হয়। ২০১৬ সালে তেমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, কিন্তু রিপাবলিকান দলের বাধার মুখে তা সম্ভব হয়নি। বারাক ওবামা নিতান্ত ভদ্রলোক, রাজনীতিবিদ। ডোনাল্ড ট্রাম্প সে যুক্তি মানবেন কেন। তিনি ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘সিনেট’ আমাদের (রিপাবলিকান দলের), প্রেসিডেন্ট আমাদের, ক্ষমতা আমাদের, অতএব, আমরা যে ভাবে পারি নির্বাচনের আগেই বিচারপতির শূন্য আসনে নতুন প্রার্থী দেব। ট্রাম্প ইতিমধ্যে নতুন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছেন। খুব সম্ভবতঃ তিনি এক মহিলা বিচারপতির নাম ঘোষণা করবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ ‘হিস্পানিক’ গোষ্ঠীর ভোট ব্যাংকের জন্যে তিনি এক হিস্পানিক মহিলা প্রার্থীকে বেছে নেবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। এখন দেখা যাকশেষ বল কোথায় গিয়ে পৌঁছে এবং কার হাতে যায় হোয়াইট হাউসের চাবি। দেখা যাক মার্কিনিদের বোধোদয় হয় কিনা। দেখা যাক তারা কী চানট্রাম্পের আরো চার বছরের স্বৈরস্টাইলে দেশ শাসন, না জো বাইডেনের গণতন্ত্রের শাসন। সেটি দেখার জন্যে আমাদের আরো সপ্তাহ পাঁচেক ধৈর্য্য ধরতে হবে। লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষকতা : অনন্য ও মহান পেশা
পরবর্তী নিবন্ধবিদ্যাসাগরের সামাজিক অঙ্গীকার