বিদ্যাসাগরের সামাজিক অঙ্গীকার

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | শনিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ৭:১৭ পূর্বাহ্ণ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০৯১) অতি অসাধারণ ছিলেন, অনেক দিক দিয়েই। তাঁর সময়ে তাঁর মতো কাজ অন্য কেউ করতে পারেন নি। কিন্তু কোনো কোনো মহৎ মানুষের বেলাতে যে বলা হয় তাঁর কাজের চেয়েও মানুষটি মহৎ সেকথা বিদ্যাসাগর সম্পর্কে ষোল আনা সত্য। মানুষ হিসেবে তিনি যে তাঁর কাজের চেয়েও বড় ছিলেন তার সাক্ষ্য তাঁর সমসাময়িকেরা দিয়েছেন, আমরাও জেনেছি। তাঁকে সাগরের সঙ্গে তুলনা করা হয়, বিদ্যার নয় কেবল করুণারও সাগর ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে এই মানুষটি। দেবপ্রতিম, হিন্দু সমাজে অবতারপ্রতিম, এমন বর্ণনাও আছে। উঁচু ছিলেন পর্বতের মতো। ঋজু এবং দৃঢ়। সমাজের সঙ্গে এবং সরকারি লোকদের সঙ্গেও তাঁর বিরোধ ছিল; রক্ষণশীলরা তাঁকে আক্রমণ করেছে, প্রাণনাশেরও আয়োজন করেছিল; তিনি অবিচলিত ছিলেন। তবুও তিনি কিন্তু তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই অভিব্যক্ত। আসলে ব্যক্তি বিদ্যাসাগর এবং কর্মী বিদ্যাসাগর এক ও অভিন্ন, আলাদা করার উপায় নেই।

তাঁর কাজটা কি ছিল? তিনি নিজে মনে করতেন যে বিধবা বিবাহের প্রবর্তনের পথ করে দেওয়াটাই তাঁর জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম। অন্যরা বলতেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ বাংলা গদ্যের কাঠামো তৈরি করা। যে কাঠামো এখনো আছে, এবং যেটির ওপর ভর করেই বাংলা গদ্যের নানামুখী বিকাশ। তাঁকে বাংলা গদ্যের জনকও বলা হয়, কিছুটা কমিয়ে কেউ কেউ বলতে চান অন্যতম জনক। রবীন্দ্রনাথও মনে করতেন বাংলা গদ্যকে সাহিত্যের স্তরে উত্তীর্ণ করে দেওয়াই বিদ্যাসাগরের প্রধান কাজ।

বিধবা বিবাহ প্রবর্তন এবং বাংলা গদ্যকে প্রকাশক্ষমতায় ও সাহিত্যিক গুণে সমৃদ্ধকরণ উভয় ক্ষেত্রেই তিনিই যে প্রধান এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই; দুটোই তাঁর অসামান্য কীর্তি, অন্য কারো পক্ষে ওই কাজ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ওই দুই কাজকে কি পৃথক করা যাবে? না, যাবে না। কাজ দু’টি একই সূত্রে প্রথিত। সূত্রটি হলো সমাজ পরিবর্তন। তাঁর কাজটিকে সমাজ সংস্কার ও সমাজ উন্নয়নও বলা সম্ভব, বলা হয়েও থাকে; কিন্তু আসলে কাজটি ছিল সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনার। সেলক্ষ্যেই তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে লড়েছেন। বিবাহসম্পর্কিত এই তিন ব্যাপারও আবার একই সঙ্গে যায়। বাল্যবিবাহের ও বহুবিবাহের কারণে বিধবার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং পুনরায় বিবাহ করার বিধি না থাকায় বিধবাদের জীবনযন্ত্রণা দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। সমস্তটাই ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের অধীনে; এবং পরিষ্কার ভাবে পিতৃতান্ত্রিক। পিতৃতান্ত্রিকতা সামন্তবাদে সত্য, পুঁজিবাদে যে তার অবসান ঘটে তা নয়। পুঁজিবাদও নানাভাবে পিতৃতান্ত্রিকই। বিদ্যাসাগর লড়ছিলেন এই পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। তিনি তাঁর পিতার কাছে গভীর ভাবে ঋণী, কিন্তু ছিলেন তিনি মাতার পাশে। তাঁর মাতৃভক্তি প্রবাদতুল্য এবং মাতার সঙ্গে সম্পর্কটাও ছিল পারস্পরিক স্নেহে ও নির্ভরশীলতায় পরিপূর্ণ, মাতা যেমন পুত্রকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন, পুত্রও মা’কে একই ডাকে ডাকতেন। মায়ের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর কিছু দিন নির্জনবাসে ছিলেন; ওই মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠলে শিশুর মতো কাঁদতেন। মাতার এবং মাতৃস্বরূপ মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্বজ্ঞানই বিদ্যাসাগরকে মাতৃভাষার চর্চায় নিবিষ্ট করেছিল।

নারীমুক্তির পক্ষে তাঁর কাজটা সামাজিক পরিবর্তনেরই কাজ বটে। কেবল বিধবা বিবাহ প্রবর্তন এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিবারণে সীমাবদ্ধ থাকেন নি, তিনি নারীশিক্ষা বিস্তারের কাজেও কারমনোবাক্যে নিযুক্ত ছিলেন। আসলে বিদ্যাসাগর জানতেন মুক্তির এবং সমাজপরিবর্তনের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল জ্ঞানের চর্চা। সে জন্যই শিক্ষাকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। আর সেই জ্ঞানের চর্চাটা যে হওয়া চাই মাতৃভাষার মাধ্যমে সেই উপলব্ধিটাও তাঁর পুরোমাত্রাতেই ছিল। ১৮৫৫ সাল মাত্র ছয় মাসে তিনি ২০টি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করেন, ১৮৫৭ সালে কয়েক মাসের মধ্যে স্থাপন করেন ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয়। হ্যাঁ, সরকারি আনুকূল্য পেয়েছেন; সামাজিক সাহায্যও ছিল; কিন্তু উদ্যোক্তাটা ছিল সম্পূর্ণ তাঁর নিজের। আর মাতৃভাষাকে জ্ঞানের মাধ্যম করার জন্য ওই ভাষার ধারণ ও প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধি করাটা যে অপরিহার্য তাও তিনি বিলক্ষণ জানতেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যে ‘নোটস’টি তৈরি করেছিলেন তার প্রথম বক্তব্যটাই ছিল শিক্ষার প্রয়োজনে একটি সমৃদ্ধ ও সুমার্জিত বাংলাসাহিত্যের সৃষ্টির আবশ্যকতার বিষয়ে। ইংরেজিতে লেখা ওই নোটসএ বলা হয়েছিল, বহষরমযঃবহবফ, বষবমধহঃ ও রফরড়সধঃরপ সাহিত্যের সৃষ্টির কথা। বাংলাসাহিত্য বহষরমযঃবহবফ হবে ইউরোপীয় জ্ঞানকে আত্মস্থ করে। জ্ঞান সমৃদ্ধ হবার কথা বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তিবাদিতার চর্চার দ্বারা। বাইরের জ্ঞানকে ঘরে নিয়ে আসতে হবে, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কিছুতেই উৎপাটিত হওয়া চলবে না।

ভাষাতে শব্দ থাকে, অর্থ থাকে; দুটোই অপরিহার্য। বিদ্যাসাগর অর্থটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। গুরুত্ব দিয়ে শব্দকে প্রাণবন্ত ও মূল্যবান করেছেন। শিক্ষায় তিনি সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। অবস্থানে ছিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণ। ইংরেজি শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ পান নি, হিন্দু কলেজের ছাত্ররা যেটা পেয়েছিলেন, অর্থনৈতিক ভাবে যাঁরা সন্তান ছিলেন বিত্তবান পরিবারের এবং সান্নিধ্য পেয়েছিলেন ডিরোজিওর মতো শিক্ষকের। বিদ্যাসাগর ছিলেন একাকী, ইংরেজি শিখেছেন সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়, এবং মেধা যে কেমন অসাধারণ ছিল প্রমাণ পাওয়া যায় ইংরেজি ভাষায় নিজের বক্তব্য প্রকাশে তাঁর দক্ষতায়। মেকলে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন চেয়েছিলেন এমন একটি শ্রেণি তৈরি করবার জন্য যারা গাত্রবর্ণে এদেশীয় হলেও ভেতরে ভেতরে ইংরেজ হবে, এবং হওয়ার চেষ্টা করতে থাকবে। বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি চাইছেন বাঙালিরা ইংরেজি শিখবে ইংরেজ হবার জন্য নয়, সমৃদ্ধ বাঙালি হবার জন্য; সেলক্ষ্যে বাঙালিকে ইউরোপীয় জ্ঞান গ্রহণ করতে হবে দু’বাহু বাড়িয়ে। আর সমৃদ্ধ ও উন্নত রুচির বাঙালি হবার জন্য চাই উন্নত মাতৃভাষা।

ইউরোপীয় জ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল পরিচ্ছন্নরূপে প্রকাশিত। নিজের গৃহে, প্রচুর অর্থব্যয়ে ও প্রভূত যত্নে, তিনি একটি গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। বড় গ্রন্থাগার হয়তো কলকাতা শহরে অন্যদের কারো কারো ছিল, কিন্তু তাঁর গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য ছিল সংগৃহীত গ্রন্থের তালিকাতে। গ্রন্থাগারে পুস্তকের সংখ্যা ছিল ৩৪৪৭টি, এর ভেতর ৩২২টি সংস্কৃত, ১৯১টি বাংলা, বাকি সবগুলো ইংরেজি। ইংরেজি ভাষার সংগ্রহের মধ্যে বিজ্ঞানের বইয়ের উপস্থিতিটা ছিল বিশেষ ভাবে লক্ষ্যযোগ্য। শ্রম ও মনোযোগ দিয়ে তিনি জ্ঞানার্জন করছিলেন, কিন্তু সেটা শুধু যে নিজের প্রয়োজনে তা নয়, আহরণকরা জ্ঞানকে অকাতরে বণ্টন করার জন্যও। বিদ্যাসাগরের দানশীলতা সর্বজনবিদিত, কিন্তু সর্বাধিক পরিমাণে যা তিনি দান করেছেন অর্থ নয়, সহানুভূতিও নয়, সেটি হচ্ছে জ্ঞান।

দান করেছেন কেবল যে ছাত্র পড়িয়ে তা নয়, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি পরিমাণে কাজটি করেছেন মাতৃভাষায় বই লিখে, এবং বই পড়াকে উৎসাহিত করে। বাংলা গদ্য অতুলনীয় মাত্রায় সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। গদ্যের ধারণ করার ও প্রকাশ করার, দুই ক্ষমতাই বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর সকল উল্লেখযোগ্য কাজই সামাজিক, বাংলা গদ্যকেও তিনি সমৃদ্ধ করলেন সামাজিক কাজের তাগিদেই। বলাই বাহুল্য তিনি সাহিত্য সৃষ্টির আবশ্যকতাতে বাংলা গদ্যের প্রথম প্রাণপুরুষে পরিণত হন নি, হয়েছেন সামাজিক প্রয়োজনে; সামাজিক মানুষ হিসেবেই সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর পদার্পণ।

শুরু করেছেন পাঠ্যপুস্তক রচনা দিয়ে। সেপাঠ্যপুস্তক আবার ছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের। এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম বই ‘বর্ণপরিচয়’; পরে যার দ্বিতীয় খণ্ড লিখেছেন। এর পরে এসেছে ‘বোধোদয়’। তারপরের কয়েকটি বইও শিক্ষার্থীদের চাহিদাকে সামনে রেখেই রচিত। বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে পছন্দ করতে পারেন নি, সে জন্যই হবে নিজের লেখা ইংরেজি প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করেছেন যে বিদ্যাসাগর মূলত ছিলেন পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা। কথাটা মোটেই যথার্থ নয়। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও তাঁর রচনা আছে। শকুন্তলা বিষয়ে ও সীতার বনবাসকে নিয়ে লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন ইংরেজি, সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষা থেকে। বিধবাবিবাহের পক্ষে এবং ওই বিষয়ে রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে বলার জন্য তাঁকে প্রবন্ধ লিখতে হয়েছে। আত্মজীবনী লিখছিলেন, সমাপ্ত করতে পারেন নি। আর লিখেছেন ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’; বাংলা ভাষায় প্রথম শোকগাথা; লিখেছিলেন বন্ধুর বালিকা কন্যার মৃত্যুতে। প্রত্যেকটি রচনাই অসাধারণ। আরও বড় সত্য এই যে তাঁর লেখা পাঠ্যপুস্তকগুলোতেও সাহিত্য আছে। বর্ণমালার সংস্কার দিয়ে শুরু করে তিনি ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে একাধারে শৃঙ্খলা আনলেন এবং বাক্যগঠনে সাহিত্যিক গুণ সংযোজনের পথ দেখালেন। এই সাহিত্যিক গুণের কথাই রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের প্রধান কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। বিদ্যাসাগর তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’ বইয়ের প্রথম ভাগে লিখেছেন, ‘জল পড়িতেছে পাতা নড়িতেছে’; রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছেন যে তাঁর নিজের জন্য সেটিই ছিল প্রথম কাব্যপাঠ। ওদিকে বঙ্কিমচন্দ্র যে অতুলনীয় সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন এবং সম্মানিত হয়েছেন ‘সাহিত্যসম্রাট’ হিসেবে সেটিও কিন্তু বিদ্যাসাগরের গদ্যকে প্রত্যাখ্যান করে নয়, গ্রহণ করেই।

আধুনিক বাংলা গদ্যের চর্চা রামমোহন রায়ই শুরু করেন। সেটাও সামাজিক কাজের প্রয়োজনে। রামমোহনের বিশেষ কাজ ছিল দু’টি। একটি সতীদাহ নিবারণ, অন্যটি ধর্মগ্রন্থ বেদান্তের অনুবাদ। দেখা যায় যে রামমোহন লড়ছিলেন দুই ফ্রন্টেসামাজিক ও ধর্মীয়। সতীদাহ নিবারণ ও শিক্ষার আধুনিকায়ন সামাজিক কাজ, ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ করে পৌত্তলিকতাকে সরিয়ে একেশ্বরবাদের পক্ষে সচেতনতা সৃষ্টি করাটা ধর্মসংস্কারের কাজ। সে জন্য তাঁকে একই সঙ্গে সমাজসংস্কারক ও ধর্মসংস্কারক হিসেবে দেখা হয়। তাঁর নেতৃতাধীন আন্দোলনের কারণে সতীদাহ নিষিদ্ধ হয়; এবং ধর্মসংস্কারের ধারাতে ব্রহ্মের এককত্ব স্বীকৃতির ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মের একটি ধারা হিসেবে ব্রাহ্ম মতবাদের অভ্যুদয় ঘটে। একদা ইউরোপে যেমন রোমান ক্যাথলিক ধর্মকে সংস্কার করে প্রটেস্ট্যান্ট ধারার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল ঘটনা অনেকটা সেই রকমের বটে, তবে বড় তফাৎ ছিল এই স্থানে যে প্রটেস্ট্যান্ট মতের প্রতিষ্ঠার পেছনে যে জাতীয়তাবাদী প্রেরণাটা কাজ করেছে এবং তার সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে সামন্তবাদের নিগড় ভেঙে নতুন অর্থনীতির উত্থানের, ব্রাহ্মধর্মের আগমনের পেছনে সেরকমের কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিকসামাজিক শক্তির উপস্থিতি ছিল না। মনে করা হয়ে থাকে যে বিদ্যাসাগর রামমোহনেরই অনুসারী। ধারণাটা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। বিদ্যাসাগর রামমোহনের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে, এবং অধিকতর পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছেন। ফলে রামমোহনের কাজের সঙ্গে তাঁর কাজের পার্থক্য ঘটেছে। বিদ্যাসাগর ধর্ম নিয়ে মোটেই মাথা ঘামান নি, তাঁর জগৎদৃষ্টি ছিল পুরোপুরি সামাজিক। শাস্ত্র থেকে যুক্তি বের করে এনে তিনি ব্যবহার করেছেন সমাজে পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজনে।

রামমোহন ধার্মিক মানুষই ছিলেন, যুক্তির ও ইহজাগতিকতার ক্ষেত্রে তিনি যেমন দার্শনিক বেকনকে অনুসরণ করার পক্ষপাতী ছিলেন, তেমনি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আবার বেদে আস্থা রাখতেন। বিদ্যাসাগর কিন্তু বেকনকেই চেয়েছেন, বেদকে নয়। ঈশ্বর আছেন কি নেই সেব্যাপারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কোনো জিজ্ঞাসা ছিল না। ঈশ্বর থাকলে তিনি তাঁর জায়গাতে থাকুন, তিনি আমার কাজে লাগবেন না, দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল এই রকমের। ইহজাগতিকতা ও ঈশ্বরমুখিতাকে একসাথে রাখবেন এরকমের সমন্বয়ে তাঁর আস্থা ছিল না। তিনি পুরোপুরি ইহজাগতিক ছিলেন। এটি হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে তিনি রামমোহন থেকে সরে এসেছেন এবং সেই সঙ্গে দেশে বিদ্যমান চিন্তাস্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। প্রথা ও কুসংস্কারের দাস নই যে বলেছিলেন সেটা কোনো কথার কথা ছিল না, ছিল তাঁর দার্শনিক ও সামাজিক অবস্থানের কেন্দ্রভূমি।

এটা তো জানা আছে আমাদের যে বানারস সংস্কৃত কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ প্রাচ্যবিদ ড. ব্যালেন্টাইন এসেছিলেন কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা করতে। ইংরেজ প্রাচ্যবিদ সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণের বিরোধী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য, ছাত্ররা যদি সংস্কৃত ও ইংরেজি দুটোই পড়ে তবে সংস্কৃতে প্রকাশিত সত্য এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত সত্যের ভেতর দ্বৈততা দেখে তারা ভীষণ বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন সত্য এক রকমেরই, দু’রকমের নয়; ছাত্ররা ইংরেজি ভাষায় যে সত্যের সন্ধান পাবে সেটাই যে খাঁটি তারা এটা জানতে পারবে; তাতে করে তারা আলোকিত হবে। এই প্রসঙ্গে লিখিত ভাবেই তিনি জানিয়েছিলেন যে সংস্কৃত কলেজে তাঁরা যে বেদান্ত ও সংখ্যা পড়িয়ে থাকেন সেটা নিতান্ত বাধ্য হয়েই, কারণ তাঁদের জানা আছে যে ওই দর্শন দু’টো ভ্রান্ত। এমন কথা প্রকাশ্যে, লিখিত ভাবে, অমন স্পষ্ট করে অন্য কোনো ব্যক্তি সেসময়ে জানান নি। তাঁদের দিক থেকে জ্ঞানের অভাব তো ছিলই, অভাব ছিল সাহসেরও। বেদান্ত ঐশ্বরিক বাণী, সাংখ্য জপিল মনিউদ্ভাবিত দর্শন যাতে ঈশ্বরের স্থান ছিল না; বিদ্যাসাগর উভয়কেই ভ্রান্ত বলে বাতিল করে দিয়েছেন। পারলে পাঠ্য তালিকা থেকেই বাদ দিতেন না, কারণ এসব বিদ্যা অর্জনে মানুষের কোনো মঙ্গল হবে না বলে তিনি জানতেন। ব্যালেন্টাইন চাইছিলেন বিশপ বার্কলের ভাববাদী দর্শন পড়াতে, বিদ্যাসাগর বলেছেন তিনি বরঞ্চ জন স্টুয়ার্ট মিল পড়াবেন। পক্ষপাতের কারণটা বোঝা যায়। মিলের লেখার ভিত্তি ছিল অভিজ্ঞতাবাদ, যুক্তি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য; যে বিষয়গুলো চর্চায় বিদ্যাসাগর অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন।

বাংলাদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীতে একটি রেনেসাঁ সংঘটিত হয়েছিল বলে অনেকে ভাবতে ভালোবাসেন; কিন্তু ইউরোপীয় রেনেসাঁর ভিত ছিল যে ধর্মনিরপেক্ষতায়, যার ভেতরে রয়েছে ইহজাগতিকতা এবং রাষ্ট্র ও সমাজকে ধর্ম থেকে আলাদা করে ফেলা, সেই ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা তো তখন যেভাবে হওয়া উচিত ছিল এদেশে সেভাবে হয় নি। বিদ্যাসাগর চেষ্টা করেছিলেন, শিক্ষার ভেতর দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষর জন্য জায়গা তৈরি করবেন। তাঁর লেখা পাঠ্যপুস্তকগুলোতে দেবদেবীর কোনো আনাগোনা নেই। সবটাই বাস্তবিক জগতের ব্যাপার। ‘বোধোদয়’ বইতে ঈশ্বরের উল্লেখ মাত্র নেই দেখে আপত্তি ওঠাতে নিতান্ত বাধ্য হয়ে ঈশ্বরকে হাজির করেছিলেন, তবে মূর্তিমান হিসেবে নয়, ‘নিরাকার চৈতন্য’ হিসেবে। ওই বইয়ের সর্বত্র বস্তুজগতের ও ভূগোলের উপস্থিতিতে ঈশ্বরের অবস্থানটা ঈশ্বরের নিজের জন্যই বেশ অস্বস্তিকর ছিল। ‘জীবনচরিত’ বইতে তিনি কোপর্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, হের্শেলের মতো যে সকল বিজ্ঞানীদের জীবনী উপস্থাপিত করেছিলেন তাঁদের বিষয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের কিছু জানা থাকবার নয়, এমন কি উচ্চশিক্ষিত মহলেও তাঁদেরকে নিয়ে আলোচনা তখন তেমন একটা চালু ছিল না। বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন ওই বিজ্ঞানীরা কি করে বড় হলেন সেটা শুধু নয়, বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে তাঁরা যে জ্ঞান প্রচার করেছেন সেটাও শিক্ষার্থীরা জানুক; তাদের কৌতূহল বৃদ্ধি পাক।

বিদ্যাসাগরের গদ্যে যে প্রাণবন্ততা দেখা যায় তার অনেকটাই এসেছে সমাজপরিবর্তনে তাঁর নিজের অত্যন্ত জীবন্ত আগ্রহ ও অনমনীয় অঙ্গীকার থেকে। ওদিকে আবার তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি যেমন ছিল প্রখর, হৃদয়ও ছিল তেমনি উষ্ণ। তাঁর কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিল আবেগ। গদ্যরচনার কাজটাকে তিনি দায়সারা ভাবে নেন নি, নিয়েছেন শিল্পকর্ম হিসেবে, তেমন শিল্পকর্ম যা পাঠক গভীর ভাবে স্পর্শ করবে, তাকে ভাবাবে। ওই গদ্যে তাই এক দিকে আছে শিল্পের শৃঙ্খলা অন্যদিকে হৃদয়ের আবেগ। আবেগ সেখানে ভাবালু হয় নি, সচলতা তৈরি করে দিয়েছে। একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল বৈদগ্ধ তাঁর গদ্যকে রক্ষা করেছে গ্রাম্য স্থূলতার হাত থেকে।

বাক্যে যতিচিহ্নের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি প্রবহমানতা ও সুস্থিরতাকে একত্র করেছেন। বাক্যগুলো অঙ্গীকারের কারণে অস্থির, আবার শিল্পবোধ ও যুক্তিবিদ্যার কারণে সংযত। ছাত্র বয়সে তিনি কবিতাও লিখেছিলেন, তাঁর গদ্যে কাব্যগুণ যে নেই এমন নয়। তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী অক্ষয়কুমার দত্তও চমৎকার গদ্য লিখেছেন; সেগদ্যও ইহজাগতিকতা ও বৈজ্ঞানিকতাতে ভরপুর। কিন্তু অক্ষয় দত্তের রচনা বিদ্যাসাগরের রচনার মতো প্রাণবন্ত ও প্রভাবশালী হতে পারে নি। কারণ বিদ্যাসাগরের আবেগ সেখানে ছিল না। সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি ততটা অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন না বিদ্যাসাগর যতটা ছিলেন।

লেখক : শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা