পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের মহত্তম আয়োজন

জব্বারের বলী খেলা কিংবা চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ

কুমার প্রীতীশ বল | শুক্রবার , ২২ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

মাননীয় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর প্রতি সূচনাতেই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আবদুল জব্বারের বলী খেলা এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অনন্য ঐতিহাসিক বিশেষত্বের কথা বিশ্লেষণ করব। মেয়র মহোদয় জব্বারের বলী খেলার সাংবাৎসরিক আয়োজনকে স্থগিত হতে দেননি। তিনি জব্বারের বলী খেলার ব্যয় সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নির্বাহেরও ঘোষণা দিয়েছেন।
আবদুল জব্বারের বলী খেলাকে কুস্তি খেলা হিসাবে ভাবতে চাইলে এর অনন্য ঐতিহাসিক বিশেষত্ব হারিয়ে যাবে। এর পরিধিটুকু সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার বাংলাদেশের খেলাধুলা গ্রন্থে এ কারণে এটাকে কুস্তি খেলা বলেননি। তিনি লিখেছেন,‘জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা’। কুস্তি খেলা আর ‘এক ধরনের কুস্তি খেলা’ সমার্থক নয়। কিছু ভিন্নতা আছে। এই ভিন্নতা হতে পারে এর ইতিহাস, ঐতিহ্যে কিংবা আয়োজনের বৈশিষ্ট্যে। এছাড়াও এর একটা নিপাট রাজনৈতিক সত্তা বিরাজমান। আছে মহান রাজনৈতিক দর্শন। এই রাজনৈতিক দর্শন বা সত্তাই এটাকে পৃথক পরিচয় দিতে উদ্বুদ্ধ করবে। আবদুল জব্বারের বলী খেলা চট্টগ্রামবাসীর আবেগ, ঐতিহ্যের শুধু অংশ মাত্র নয়, পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য জব্বারের বলী খেলাকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহত্তম আয়োজন হিসাবেও বিবেচনায় নিতে হবে।
পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত আবদুল জব্বারের বলী খেলা এবছর আয়োজনের ১১৩ বছর অতিক্রম করছে। প্রতি বছর ১২ই বৈশাখ চটগ্রামের লালদিঘির মাঠে আবদুল জব্বারের বলী খেলার আসর বসে। এজন্য খেলোয়াড়, বৈশাখী মেলার বিক্রেতা-ক্রেতা কাউকে আমন্ত্রণ জানাতে হয় না। সবাই নির্দিষ্ট সময়ে এসে হাজির হয়ে যায়। আবদুল জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে বৈশাখী মেলায় এমন কিছু জিনিসপত্র পাওয়া যায়, যা কিনা অন্য কোনো মেলায় পাওয়া যায় না। চট্টগ্রামবাসী এসব জিনিস কিনতে সারা বছর ধরে এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকে। এত সব কারণে শত বছরের প্রাচীন এই মেলাটি আজ চট্টগ্রামবাসীর আবেগ এবং ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে পরিণত হয়ে গেছে।
১৯০৯ সালে ২৫ এপ্রিল বাংলা ১২ বৈশাখ তারিখে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার চটগ্রামের লালদিঘির মাঠে এই বলী খেলার আয়োজন করেন। পরবর্তীকালে এই বলী খেলা আবদুল জব্বারের নামে পরিচিতি লাভ করে। খেলাধুলার মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি এই খেলার সূচনা করেছিলেন। সংস্কৃতি শুধু বিনোদনের জন্য অংশ নয়, লড়াই-সংগ্রামেরও অংশ, একথা সচেতন মানুষ মাত্রেই জেনে আসছেন। কিন্তু সংস্কৃতির পাশাপাশি ক্রীড়াও যে লড়াই-সংগ্রামের অংশ, তা ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার বাঙালির বোধের মধ্যে নিয়ে আসেন।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অচিরেই ব্রিটিশ বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণে তাঁদের তৎপরতায় ব্রিটিশের সার্বক্ষণিক নজর ছিল। সে জন্য বিকল্পপন্থা হিসাবে খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিপ্লবীরা এবং তাঁদের সমর্থকরা। মাস্টারদার নাম তখনও জনতার কাছে পরিচিত হয়নি। কিন্তু তাঁর কুঠির তরুণদের তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তরুণ-যুবাদের সদ্যজাগ্রহ আগ্রহে তিনি সাহস সংযোগ করছেন। তারা ক্লাবে যায়, শরীর চর্চা করে। ক্লাবে ক্লাবে শহর ও গ্রাম ছেয়ে যায়। বাড়িতে, স্কুলে, মাঠে, ক্লাবে, ভাবি ডেথ প্রোগ্রামে’র সোপান চাকা ক্রমশঃ দ্রুততর গতিতে আবর্তিত হতে আরম্ভ করে, যার পরিণতিতে ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় জালালাবাদ যুদ্ধ, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ। লোকনাথ বল অন্যদের নিয়ে তরুণ-যুবাদের নতুনভাবে সংগঠিত করার প্রচেষ্টায় সর্বত্র শরীর চর্চা কেন্দ্র গড়তে সচেষ্ট হলেন। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক শরীর চর্চা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। লোকনাথ বল অন্যদের নিয়ে এ কেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষণ দেন। চট্টগ্রামের ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে নতুন প্রাণের সাড়া পড়ে। ছাত্রদের মুখে মুখে লোকনাথ বলের নাম। তাঁরা ব্যায়াম চর্চা ও ক্রীড়া কৌশলে যোগ্যতার পরিচয় দেন। লোকনাথ বল এসময় সহজেই আড়াই মন ওজনের লৌহখণ্ড তুলে খেলা দেখাতেন। চলন্ত মোটর গাড়ির গতিরোধ করে ফেলতেন। মোটরের পেছটে দড়ি বেঁধে সেই দড়ি কোমরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর মোটর চালক প্রাণপথ চেষ্টা করেও গাড়িকে সামনে এগিয়ে নিতে পারত না। বাংলার পথে প্রান্তরে এই দুরন্ত যৌবনের দুর্দান্ত ক্রীড়া কৌশল সেদিনের বাঙালি চিত্তের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি পূর্ণ মাত্রায় লাভ করে। আবদুল জব্বারের বলী খেলাও খেলাধুলার আড়ালে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার অনুসঙ্গ হিসাবে কাজ করেছে। ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। এ প্রসঙ্গে চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী বন্দর শহর চট্টগ্রাম গ্রন্থে লিখেছেন,‘চট্টগ্রাম বলির দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল’।
আবদুল জব্বারের বলী খেলা ব্যতিত আর কোনো ধরনের খেলায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরম্পরা এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের মহত্তম আয়োজন আছে বলে জানা নেই। সাংবাৎসরিক এই আয়োজনের মাধ্যমে এর ঐতিহাসিক পরম্পরাকে স্মরণ করা হয়। আবার লোকায়িত সংস্কৃতির বিকাশকে বিশ্লেষণ করতে গেলেও জব্বারের বলী খেলার অনন্য ঐতিহাসিক বিশেষত্বের কথা বিবেচনা করতে হবে। বাস্তবতা হলো, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে এখন কেন জানি আর বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। এখন খণ্ডিত ইতিহাস চর্চার আয়োজন চলছে সর্বত্র। সম্প্রতি, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী এবং একাত্তরের প্রতিরোধযোদ্ধা পুলিশের স্মৃতিবিজড়িত দুই ভবন নিয়ে গড়ে তোলা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের জাদুঘরের নামকরণ হয়েছে ‘পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, চট্টগ্রাম’। এই নামে বোঝার উপায় নেয়, এখানে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবের সেই অগ্নিযুগের স্মৃতিও আছে। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন কিংবা আজকের বিপ্লবী চট্টগ্রাম নামের সূতিকাগার হলো লোকনাথ বলের নেতৃত্বে ঐ পুলিশ লাইন আক্রমণ। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল শুক্রবার ছিল আয়ারল্যান্ডের ইস্টার বিদ্রোহ বার্ষিকী। আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ইস্টারের ছুটির উৎসবমুখর রাতে অভ্যুত্থান ঘটাতে চট্টগ্রামের একদল বিপ্লবী পুলিশ লাইন আক্রমণে অংশগ্রহণ করেছিল। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা প্রথমবারের মতো একটি ভৌগোলিক এলাকার দক্ষ প্রশাসন ও সুসংগঠিত বাহিনীকে পরাজিত করে শুধু ইতিহাস সৃষ্টি করেননি, দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মহান দেশপ্রেমের। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ দিবসের বাণীতে বলেছিলেন, ‘মুক্ত বাংলায় জালালাবাদ দিবস পালিত হচ্ছে শুনে আনন্দিত হয়েছি। আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে মৃত্যু ভয়হীন বাঙালি বীর বিপ্লবী সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল। বাংলার মুক্তি পাগল মানুষ রক্তঝরা সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেই স্বাধীন বাংলাকে জয়যুক্ত করেছে, আমাদের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতার সার্থক রূপায়নের মাঝে মাস্টারদার অতৃপ্ত আত্মা আজ খুঁজে পাবে শান্তি। মাস্টারদা অমর হয়ে রইলেন বাংলার মানুষের হৃদয়ে-বাংলার ঘরে ঘরে। যুগে যুগে ঐতিহাসিক এই দিনটি প্রতিটি বাঙালির কাছে অনন্ত প্রেরণার হয়ে থাকুক-এ কামনা করি।’ অধ্যাপক মহীবুল আজিজ লিখেছেন, ‘১৯৩০ সালের এপ্রিল মাস কেবল চট্টগ্রামের ইতিহাসে নয়, ভারতের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এবং বাঙালির স্বাধীনতার পশ্চাৎ প্রেরণা হিসেবে প্রাতঃস্মরণীয়। টি.এস.এলিয়ট তার ওয়েস্টল্যান্ড কাব্যে এপ্রিলকে বলেছেন নিষ্ঠুরতম মাস। আমরা বলতে পারি আমাদের জন্যে এটি মহত্তম মাস’। আবদুল জব্বারের বলী খেলাও অনুষ্ঠিত হয় এপ্রিলের তপ্ত দুপুরে। কিন্তু তারপরও এই মহত্তম মাসের মহত্তম কর্মগুলোকে ছাই ছাপা দিয়ে রাখার নিষ্ঠুরতম উদ্যোগ কার স্বার্থে? মনে রাখতে হবে, আবদুল জব্বারের বলী খেলা এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ উভয়ই ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের মহত্তম আয়োজন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যজন

পূর্ববর্তী নিবন্ধমা বেঁচে থাকুক অনন্তকাল সন্তানের হৃদয় জুড়ে
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা