৭০ শতাংশের মধ্যে অকার্যকর

তিন অ্যান্টিবায়োটিক শিশু ও তরুণদের মাঝেই বেশি চট্টগ্রামে নিউমোনিয়ার রোগীদের নিয়ে গবেষণা

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স তথা অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা। এ প্রবণতা শিশু ও তরুণদের মাঝে সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এবং মা ও শিশু হাসপাতালের গবেষণায় জানা গেছে এই তথ্য।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সালের শুরু পর্যন্ত আসা এক হাজার নিউমোনিয়া রোগীর ৭০ ভাগের মধ্যে দেখা গেছে, অন্তত তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়েছে। সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা দেখা গেছে নবজাতক, শিশু ও তরুণদের মাঝে। প্রতি চারজন নিউমোনিয়া আক্রান্ত পুরুষের মধ্যে তিনজনের শরীরেই মাল্টিড্রাগ রেজিসটেন্স তথা তিনটি বা তার অধিক অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর দেখা গেছে। হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে এই হার অনেক বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান ও মাহবুব হাসান এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নাহিদ সুলতানা, ও নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (এনআইসিইউ) পরিচালক ডা. ওয়াজির আহমেদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই গবেষণা গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নাল প্লস ওয়ানে। পুরো কাজটি গবেষণাগারে পরিচালনা করেন চবির গবেষণা শিক্ষার্থী আফরোজা আকতার তন্বী।
ডা. ওয়াজির আহমেদের মতে, অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা বর্তমান বিশ্বে একটি ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য সমস্যা। ব্যাকটেরিয়া তথা অণুজীবের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা যত কমে যাবে তত বেশি এসব জীবাণুর সংক্রমণ বেড়ে যাবে। এর চিকিৎসার উপায় বা প্রতিষেধক কমে যাবে ও সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
গবেষণায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ক্লেবসিয়েলা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাধিক ব্যবহৃত ২০টি অ্যান্টিবায়োটিকের (সেফুরিক্সিম, সেফেক্সিম, এমোক্সিক্ল্যাভ, সেফেপিম, সেফটাজিডিম, সেফট্রায়াকজম, ক্লোরামফেনিকল, কোট্রিমক্সাজল, সিপ্রফ্লোক্সাজিন, জেন্টামাইসিন, ইমিপেনেম, মেরোপেনেম, নালিডিক্সিক এসিড, নাইট্রফুরানটিন, লেভোফ্লোক্সাজিন, এমিকাসিন) বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে সেফুরিক্সিম, সেফিক্সিম, সেফটেক্সিম ও সেফটাজিডিম গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে।
গবেষকগণ পিসিআর, জিন সিকুয়েন্সিং ও বায়োইনফরমেটিক্স পদ্ধতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতার জন্য কোন কোন জিন দায়ী তা অনুসন্ধান করেন। নিউ দিল্লি মেটালোভাইরাস (এনডিএম-১) জিনের উপস্থিতি সর্বাধিক হারে পরিলক্ষিত হয়। এই জিন ইতিপূর্বে ভারত, কানাডা, সুইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রের রোগীদের জীবাণুর মধ্যে পাওয়া গেছে। এছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলের রোগীদের মধ্যে এই জিনের গঠনে কিছু ভিন্নতা পরলক্ষিত হয়। এর জন্য জীবনযাপনের প্রকৃতি ও ভৌগলিক অবস্থান দায়ী বলে মনে করছেন গবেষণাটির প্রকল্প পরিচালক ড. আদনান মান্নান।
গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বিপুল সংখ্যক রোগী অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে। হাসপাতালের বেসিন ও নালার পানি, বিছানার চাদর, দেয়ালের বিভিন্ন নমুনায় উক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায় এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী এমন একাধিক জিন চিহ্নিত করা হয়।
গবেষকগণ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত কিংবা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার শরীরে অণুজীবগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষমতা তৈরি করে এবং পরবর্তীতে এই অ্যান্টিবায়োটিক উক্ত ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারায়। ফলে উক্ত রোগে আক্রান্তদের জন্য আর কোনো প্রতিষেধক বা চিকিৎসার উপায় থাকে না। এছাড়া একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা তীব্র সংক্রমণের দিকে রোগীকে ধাবিত করে।
গবেষণার আরেকটি অংশে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্ট ম্যাপিং’ করা হয়। এতে দেখা যায়, শহরাঞ্চলে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আগ্রাবাদ, ডবলমুরিং, পাঁচলাইশ, হালিশহর, বায়েজিদ ও বাকলিয়া এলাকায় এবং গ্রামে সীতাকুণ্ড, পটিয়া, হাটহাজারী ও চন্দনাইশ অঞ্চলে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর রোগীর সংখ্যা বেশি। কারণ, এসব এলাকায় ফার্মেসির সংখ্যা বেশি। ওইসব ফার্মেসিতে অবাধে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়।
ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের সবগুলো হাসপাতাল এবং দেশব্যাপী ব্যাপক আকারে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন ডা. নাহিদ সুলতানা। চট্টগ্রামে এই মুহূর্তে প্রায় ছয় হাজার ফার্মেসি রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক লাইসেন্সবিহীন। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রয়োগ নেই। গবেষণায় অর্থায়ন করে চবির গবেষণা ও প্রকাশনা দপ্তর। সহায়তায় ছিল ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ চিটাগাং।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়টি জটিল, সব পক্ষেরই ভূমিকা চাই
পরবর্তী নিবন্ধসুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সংহতি প্রকাশ