এটি সর্বজনবিদিত যে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্ব পরিমণ্ডলে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য এক অনুপম তৌর্যত্রিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বজ্রকঠিন এই ঘোষণা দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের আরাধ্য গন্তব্য পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের অভূতপূর্ব রোডম্যাপ সম্বলিত অসাধারণ ক্রোড়পত্র। মাত্র ১৯ মিনিটের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি, নিপীড়ন-নিষ্পেষণের নির্মম দৃশ্যপট, পরবর্তীতে আন্দোলন পরিচালনায় নির্দেশাবলীসহ রণনীতি-কৌশলের অনবদ্য ক্যানভাস নির্মাণ করেছেন। সহিংসতা পরিহারে অহিংস অসহযোগকে ধারণ করে কীভাবে চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করতে হবে; ভাষণে তা অত্যন্ত সুনিপুণ বিচক্ষণতা ও নির্ভীক সাহসীকতার সাথে দেশবাসীর সামনে সুস্পষ্ট করেছেন।
গণতান্ত্রিক মানসিকতায় বিশ্বাসী বিশ্বের সকল দেশ-সরকার ও জনগণ এই ভাষণের তাৎপর্যকে নিগূঢ়ভাবে ধারণ করে স্বকীয়সত্ত্বার বিকাশ চেতনায় প্রচণ্ড উজ্জীবিত হয়েছিল। উল্লেখ্য কারণেই জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) বিশ্বনন্দিত ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে এই অবিস্মরণীয় ভাষণকে চিহ্নিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণার এই ভাষণটি কালের পদচারণায় বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ ও ‘মহাকালের মহানায়ক’ অভিধায় বিশ্ব ইতিহাসের অধ্যায়ে চিরভাস্বর করেছে। প্রাসঙ্গিকতায় বরেণ্য কবি ও লেখক অজয় দাশ রচিত ‘বঙ্গবন্ধু: আদিগন্ত যে সূর্য’ কবিতার পংক্তিসমূহ বারংবার স্মরণযোগ্য – “বাঙালি কি বাঙালি হয় শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি ছাড়া/ থাকে না তার বর্গ কিছুই না থাকলে টুঙ্গিপাড়া/ সুর-অসুরে হয় ইতিহাস, নেই কিছু এ দু’জীব ছাড়া/বাংলাদেশের ইতিহাসে দেবতা নেই মুজিব ছাড়া/……. বাংলাদেশের মুক্তিও নেই মুজিব নামের সূর্য ছাড়া”।
২০১৩ সালে জ্যাকব এফ. ফিল্ড সম্পাদিত গ্রন্থ ‘WE SHALL FIGHT ON THE BEACHES – THE SPEECHES THAT INSPIRED HISTORY’ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একচল্লিশটি ভাষণের এক অনবদ্য সংকলন। বইটির নামকরণে সম্পাদক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষণের এক প্রণিধানযোগ্য উক্তি ব্যবহার করেছেন। জার্মানির হিটলার ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোলান্ড এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিলে নরওয়ে দখলে নেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চ্যাম্বারলিকে হিটলারের এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যর্থতার জন্য পদত্যাগে বাধ্য করে চার্চিলকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। অল্প বিরতিতে ফ্রান্সসহ হিটলারের অন্য দেশ দখলের জন্য Nazi বাহিনীর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে ১৯৪০ সালের ৪ জুন চার্চিল তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ”We shall fight on the seas and oceans, we shall fight with growing confidence and growing strength in the year………, we shall fight on the beaches,……… We shall fight in the fields and in the streets and ………, we shall never surrender “।
কোনভাবেই পরাভূত না হওয়ার চার্চিলের উপরোক্ত দৃঢ়চেতা অঙ্গীকার অবিরাম যুদ্ধে সৈনিকদের অপরিমেয় মনোবল বৃদ্ধিতে অপূর্ব সহায়ক ছিল। ঠিক একইভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্সে তর্জনী উঁচিয়ে বজ্রকন্ঠে অবিনাশী দ্রোহের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন “আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।” জ্যাকব এফ. ফিল্ড সম্পাদিত গ্রন্থে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭’র রোনাল্ড রিগেনের ভাষণসহ বিশ্বশ্রেষ্ঠ ভাষণসমূহের অন্যতম ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এই গ্রন্থে যেসব বিশ্ববরেণ্য রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়কদের ভাষণ সন্নিবেশিত ছিল, তাঁরা হলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, অলিভার ক্রমওয়েল, জে.এফ. এ্যাডওয়ার্ড স্টুয়ার্ট, জর্জ ওয়াশিংটন, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ও.ভি. বিসমার্ক, আব্রাহাম লিঙ্কন, ভ্লাদিমির লেনিন, ডাব্লিউ উইলসন, এফ. ডি. রুজভেল্ট, জোসেফ স্টালিন, মাও সে তুং, হো চি মিন, সালবাদোর আলেন্দেসহ প্রমুখ।
দেশ-বিশ্ববাসী সকলের জানা যে, ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ উভয় পরিষদেই একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য; জুলফিকার আলী ভূট্টোর ঘোষণা ছিল ‘গত তেইশ বছর পূর্ব পাকিস্তান দেশ শাসনে ন্যায্য হিস্যা পায়নি, তাই বলে আগামী তেইশ বছর পাকিস্তানের উপর প্রভুত্ব করবে তা হতে পারে না।’ এই ধরনের অপপ্ররোচনায় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও ১লা মার্চ তা স্থগিত ঘোষণা করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের জঘন্য এই কূটকৌশল এবং সুগভীর ষড়যন্ত্রের সামগ্রিক উপলব্ধিতে বঙ্গবন্ধু ১লা মার্চ থেকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৩ মার্চ আগের রাতে শহীদদের লাশ নিয়ে মিছিল শেষে পল্টনে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনারা আপনাদের শাসনতন্ত্র রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব। ………২৩ বছর ধরে রক্ত দিয়ে আসছি। প্রয়োজনে আবার বুকের রক্ত দেব। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বীর শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করব না।’
উপরোল্লেখিত বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন – ‘ভায়েরা, আবার আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউ না থাকে, তবুও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে’। এভাবেই অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ অমর মহাকাব্য সমরূপ তাঁর অত্যন্ত প্রাঞ্জল-সাবলীল-তেজোদীপ্ত ভাষণে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের উপর নিপীড়ন নির্যাতনের নির্মম ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন। চরম বৈষম্যের মোড়কে বাংলাদেশের উপার্জন থেকে কেনা অস্ত্র দিয়ে বাঙালি নিধনের কঠিন চিত্র উপস্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম,…… আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন’।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে দেশের জনগণ যাতে কোন রকম কষ্ট-যন্ত্রণা-বঞ্চনায় নিপতিত না হয় এবং খাদ্য অর্থ কষ্টে বিপর্যস্ত হয়ে না পড়েন; সে সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।…….. সরকারি কর্মচারীদের বলি; আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাঙ বন্ধ করে দেওয়া হল। কেউ দেবে না। শোনেন-মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বেঙলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়’।
কী অপরিসীম মানবিক প্রচেতায় সম্প্রদায়-অঞ্চল-জাতিগত বিরোধ-বিচ্ছেদ-বিদ্বেষ-সংঘাত-সংঘর্ষকে নস্যাৎ করে দেশের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধজয়ে প্রণোদিত ও অনুপ্রাণিত করার দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল – দৃঢ়চিত্তে তা অবশ্যই বলা যায়। রণকৌশল এবং রণনীতি কি হবে এবং কিভাবে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করবে তাও বঙ্গবন্ধু নির্দেশনা দেন এভাবে – ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব – তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্যসাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এসেছেন কিন্তু এমন করে কেউ বাঙালিকে জাগাতে পারেন নি। তাই বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগের যেমন প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করাও অসম্ভব। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো, ঘানার পেট্রিস লুসাম্বা ও কওমী নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বঙ্গবন্ধু তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বিশ্ব-ইতিহাসের অনিবার্য স্থানে যথার্থই নিজেকে সমাসীন করতে পেরেছেন। মহান স্রষ্টার অপার কৃপানির্ভর বঙ্গবন্ধুর এই নির্ভীক-সাহসিক ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, বাঙালি জাতিকেও বৈশ্বিক স্বাধীনতার ইতিহাসে আকাশচুম্বী গৌরব ও মহিমায় অধিষ্ঠিত করেছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়