৬ কোটি টাকার ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন দুই মাস ধরে অচল

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৬ জুলাই, ২০২২ at ৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ

জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ৯০ শতাংশেরই একটা সময়ে ব্র্যাকিথেরাপি নিতে হয়। অর্থাৎ জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তদের জন্য এই থেরাপি অনেকটা অপরিহার্য। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওথেরাপি (ক্যান্সার) ওয়ার্ডে থাকা একমাত্র ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি প্রায় ২ মাস ধরে অচল। কয়েকটি পার্টস নষ্ট হওয়ায় মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
ফলে প্রায় ২ মাস ধরেই ব্র্যাকিথেরাপি সেবাও বন্ধ রয়েছে এ হাসপাতালে। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত চট্টগ্রামের রোগীরা। চিকিৎসকরা বলছেন, চমেক হাসপাতাল ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানেই এই ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন নেই। কিন্তু এ অঞ্চলের একমাত্র মেশিনটি (চমেক হাসপাতালের) অচল থাকায় বাধ্য হয়ে ঢাকায় গিয়েই এই ব্র্যাকিথেরাপি সেবা নিতে হচ্ছে বৃহত্তর চট্টগ্রামের রোগীদের।
মেশিনটি অকেজো হওয়ার পরপরই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে বলে জানান রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ। অকেজো থাকায় ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনের সেবা বন্ধ থাকার বিষয়টি স্বীকার করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, ডিপার্টমেন্ট থেকে অবহিত হওয়ার পরপরই বিষয়টি আমরা সিএমএসডি (কেন্দ্রীয় ওষুধাগার)-কে লিখিতভাবে জানিয়েছি। মাঝখানে সিমএসডি আমাদের কাছে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে, মেশিনটি সচল হয়েছে কী না। তবে মেশিনটি সচল না হওয়ার বিষয়টি আমরা পুনরায় সিএমএসডি-কে জানিয়েছি।
ক্যান্সার ওয়ার্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, থেরাপি সেবা দেওয়ার সময় গত ৬ জুন ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি হঠাৎ করে অকোজে হয়ে পড়ে। এর পরপরই
মোবাইল ও ই-মেইলের মাধ্যমে মেশিনটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি জানানো হয়। গত ১৫ জুন তাদের (সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের) প্রকৌশলী এসে মেশিনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। নষ্ট হওয়ায় তারা মেশিনটির কয়েকটি পার্টস (টাউথ বেল্ট ও লাইট বেরিয়ার) পরিবর্তন ও সার্ভিসিংয়ের কথা বলেছেন।
বিষয়টি গত ১৬ জুন লিখিতভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে রেডিওথেরাপি বিভাগ। এর প্রেক্ষিতে ২১ জুন সিএমএসডির পরিচালক বরাবর চিঠি দেয় হাসপাতাল প্রশাসন। হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. অং সুই প্রু মারমার স্বাক্ষরে ওই চিঠি দেয়া হয়। ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে জরুরি ভিত্তিতে মেশিনটি মেরামতের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে। তবে চিঠির এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত মেশিনটি সচল হয়নি। যদিও মেশিনটির বিষয়ে সিএমএসডির সাথে আবারো কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেডিওথেরাপি বিভাগে সপ্তাহে দুদিন এই ব্র্যাকিথেরাপি সেবা দেয়া হয়ে থাকে। জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩-৪ বার এই ব্র্যাকিথেরাপি দিতে হয়। প্রতিবার থেরাপিতে খরচ পড়ে দেড় হাজার টাকা। কিন্তু একমাত্র মেশিনটি অচল থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন চট্টগ্রামের জরায়ু ক্যান্সারের রোগীরা।
জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৯০ শতাংশ রোগীর এই ব্র্যাকিথেরাপি গ্রহণ অপরিহার্য জানিয়ে রেডিওথেরাপি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলছেন, জরায়ু ক্যান্সার ছাড়াও খাদ্যনালীর ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার ও জিহ্বার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের যাদের বাইরে থেকে রেডিওথেরাপি দিয়েও কাজ হয় না এবং যাদের অপারেশনও করা যায় না, সেসব রোগীকে ব্র্যাকিথেরাপি দেওয়ার সুযোগ থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অন্য কোনো স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন নেই। দ্বিতীয় কোনো মেশিন না থাকা এবং চমেক হাসপাতালের একমাত্র মেশিনটির সেবা বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামের জরায়ু ক্যান্সারের রোগীরা কষ্টে পড়েছেন। রোগীদের মধ্যে যাদের জরুরিভাবে ব্র্যাকিথেরাপি প্রয়োজন, তাদের এখন ঢাকায় গিয়ে এই থেরাপি দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

উল্লেখ্য, চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে নতুন স্থাপন করা এই ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনের আনুষ্ঠানিক সেবা চালু হয় ২০১৯ সালের মে মাসে। যদিও এর আগে (২৩ এপ্রিল) মেশিনটির পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জার্মান প্রতিষ্ঠান বিআইবিআইজির কাছ থেকে একই সাথে তিনটি ব্র্যাকি থেরাপি মেশিন ক্রয় করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। প্রত্যেকটি মেশিনের মূল্য ৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। এই তিনটির মধ্যে একটি বরাদ্দ দেয়া হয় চমেক হাসপাতালকে। বাংলাদেশের এজেন্সি প্রতিষ্ঠান ‘প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনালের’ মাধ্যমে ২০১৫ সালের শেষ দিকে মেশিন তিনটি সরবরাহ করে জার্মানির ওই প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের জন্য বরাদ্দ পাওয়া মেশিনটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি নিয়ে আসা হয় চমেক হাসপাতালে। বাকি দুটি নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় ওষুধাগারে। মেশিন সরবরাহ করলেও সোর্স নামের মেশিনটির অপরিহার্য একটি যন্ত্রাংশ (যেটি দিয়ে রেডিয়েশন বের হয়) প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ করে আরও এক বছর পর। তবে সোর্স পাওয়ার ৬ মাস পরও চালু হয়নি মেশিনটি। এ নিয়ে ২০১৭ সালের ১২ আগস্ট ‘৬ কোটি টাকার মেশিন আছে, ব্যবহার নেই/দেড় বছর ধরে পড়ে আছে ওয়ার্ডে, চালু হলে সেবা পেত নারী ক্যান্সার রোগীরা’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
ওই প্রতিবেদনে মেশিন সরবরাহের পর সোর্স সরবরাহ করতে এক বছর সময় লাগা প্রসঙ্গে জার্মান প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশি এজেন্সি ‘প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনালের’ প্রধান নির্বাহী এস এম শফিকুজ্জামান বলেন, সোর্স বা রেডিয়শনের যন্ত্রাংশটি আনতে হলে পারমাণবিক শক্তি কমিশন থেকে একটি ইমপোর্ট পারমিট (আমদানি অনুমতি পত্র) দরকার পড়ে। আর এ পারমিট নিতে হয় গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে। গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ইমপোর্ট পারমিট পাওয়ার পর এই যন্ত্রাংশটি সরবরাহ করা হয়েছে।
ওই সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা না আসায় মেশিনটি ইনস্টল করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে জার্মান প্রকৌশলীরা (সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের) আসতে একটু লেইট (দেরি) করেছে বলে ওই সময় স্বীকার করেন প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী এস এম শফিকুজ্জামান।

দৈনিক আজাদীতে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ওই বছরের (২০১৭ সালের) শেষ দিকে স্থানীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনালের সাথে চুক্তি বাতিল করে সিএমএসডি (কেন্দ্রীয় ওষুধাগার)। পরবর্তীতে বায়োজেন টেকনোলজি নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর মেশিনটি স্থাপনে (ইনস্টলে) কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এর অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনের বাংকার নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়।
বাংকার নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তরের প্রায় ৮ মাস পর মেশিনটির স্থাপন (ইনস্টল) প্রক্রিয়া শেষ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি। মেশিনটি ইনস্টল শেষে ২০১৯ সালের মার্চের প্রথম দিকে পরমাণু শক্তি কমিশনের ছাড়পত্র পাওয়া যায়। পরমাণু শক্তি কমিশনের দুই সদস্যের একটি টিম সরেজমিনে পরির্দশনপূর্বক ওই ছাড়পত্র দেন। পরমানু শক্তি কমিশনের ছাড়পত্র পাওয়ার পর এপ্রিলের শেষ দিকে পরীক্ষামূলকভাবে মেশিনটি চালু করা হয়। তবে এর আনুষ্ঠানিক সেবা চালু করা হয় ওই বছরের (২০১৯ সালের) মে মাসে। এর মাধ্যমে মেশিনটি পাওয়ার সাড়ে তিন বছরের মাথায় চট্টগ্রামে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা এর সেবা পেতে শুরু করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখরচ কমাতে প্রধানমন্ত্রীর আরও নির্দেশনা
পরবর্তী নিবন্ধভিকটিমকে জেরায় লাগবে আদালতের অনুমতি