৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন

ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা :

কুমার প্রীতীশ বল | সোমবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল–বছর গুনলে ৫০বছরই হয়। এ সময়টুকুকে যারা দেখেছেন কিংবা দেখেননি, প্রত্যেকে একবাক্যে স্বীকার করবেন, অনেক উন্নয়ন হয়েছে এদেশের। একেবারে ম্যাগা উন্নয়ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ মহাশূন্যে সেটেলাইট পাঠিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। উন্নয়নের অনেক সূচকে উর্ধ্বমুখী অবস্থান অব্যাহত রেখে উন্নয়নশীল দেশের তালিকা থেকে নাম মুছে ফেলে উন্নত রাষ্ট্রের খাতায় বাংলাদেশ নাম লেখাতে চলেছে। কিন্তু এসব উন্নয়নের ফিরিস্তির মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, ৫০ বছরের বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কতটুকু মানবিকতা অর্জন করেছে? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সূচক ১৯৭১ সাল থেকে ২০২১ সালে এসে কতটুকু উপরের দিকে উঠেছে? আদৌ কি উঠেছে? আগের কথা বাদই দিলাম, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ কতটুকু ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক চরিত্র অর্জন করতে পেরেছে? আদৌ কি এই বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক বলার সুযোগ আছে? প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এবারের দুর্গাপূজা এবং দুর্গাপূজা পরবর্তী সংঘটিত কয়েকদিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে বলাই বাহুল্য।
বাংলা নামের এই দেশটিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আগুনে জ্বলতে দেখে চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠছে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অনেক মানুষের অবয়ব। এঁদের মধ্যে অনেকে বেঁচে আছেন, অনেকে প্রয়াত। এঁদের মধ্যে কেউ আমার পিতৃতুল্য, কেউ অগ্রজ, কেউ বন্ধু স্থানীয়, এমনকী কেউ আছে অনুজ। আমি তাঁদেরকে সামনে রেখে কিংবা পাশে বসে কি করে বলব, আজ আমার জন্মভূমি সোনার বাংলা মৌলবাদের আলখেল্লা পরিহিত, আজকের বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক। আমি যদি জাতির জনকের জীবন বিশ্লেষণ করি, তাঁর চেতনার কথা বলি, তবে কি করে মিলাব ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কালের ঘটনাপ্রবাহ! কি করে প্রশ্ন তুলব, যে কথা বলার ছিল, সে কথা কি বলছে ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আজকের বাংলাদেশ? কিন্তু আজ অত্যন্ত বেদনাহত হৃদয়ে স্বীকার করতেই হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনেক ম্যাগা উন্নয়নের তকমা গায়ে লাগালেও, তলাবিহীন জাতির অপবাদ ঘুচালেও আজও বাংলাদেশ ধর্মান্ধতা এবং মৌলবাদী চরিত্র বর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র এখনও মানবিক হতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চরিত্র অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই আজ বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে গণতান্ত্রিক বলতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। একথা লিখতে গিয়ে আমি একবারের জন্যও ভুলে যাইনি, এদেশে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ হয়েছিল। এও স্মরণে আছে, এর অন্যতম সংগঠক ও রূপকার ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল। ধর্মীয় গোঁড়ামি, সংস্কারাচ্ছন্নতা, চৈতন্যের পশ্চাৎপদতা, কূপমন্ডুকতার মতো নানা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের অচলায়তন ভেঙে মুক্তবুদ্ধি, গণতান্ত্রিক চেতনা ও প্রগতি মনস্কতার ‘উদ্বোধন’ করতে অনেকেই সচেষ্ট ছিলেন এবং এখনও আছেন। তাঁদের প্রচেষ্টাকে সালাম জানাই। কিন্তু ফলাফল হলো, সেই ‘উদ্বোধন’ হয়নি। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছিলেন। আওয়ামীলীগ আজও তাই বলে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত, মৌলবাদ মুক্ত হয়নি। এখানে এসে সবাই ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতার কথা গত ২১ অক্টোবর চ্যানেল ৭১ এর সংবাদ সংযোগে আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কামাল হোসেনও স্বীকার করেছেন।
‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ কিংবা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চায় যাঁরা নিবেদিত প্রাণ আজ তাঁরাও আমার মতো এদেশে সংখ্যালঘু। এঁদের তৎপরতা তাই আজ কোনো ফেলে না রাষ্ট্র পরিচালনায়। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রভাব ফেলতে পারে ধর্মান্ধ, মৌলবাদীদের তৎপরতা। তাঁদের কথায় বইয়ের কারিকুলাম পরিবর্তন হয়। ওরা ভাস্কর্য ভাঙলে মাফ পেয়ে যায়। কিন্তু চট্টগ্রামের ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয় না। সিআরবিকে চট্টগ্রামবাসীর সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য উন্মুক্ত না রেখে, চট্টগ্রামের সুধিজনদের দাবি উপেক্ষা করে হাসপাতাল তৈরির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে যে হারে মডেল মসজিদ হয়েছে, সে অনুপাতে কি পাঠাগার হয়েছে? তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ হবে কি করে? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চর্চাইবা আশাকরি কেন? এখানেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এখনও কি এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ রয়ে গেল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়, যখন প্রশাসনের সামনে জেএম সেন হলে হামলা হতে দেখে। সারাদেশে গত কয়েকদিন ধরে হিন্দুদের ওপর হামলা, লুট, খুন-খারাপি চলল। এসব ঘটনায় তো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে হয়েছে। ভারতের বাবরি মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৯০ সালে ঘটেছে। ১৯৯১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হয়েছে। ২০২১ সালে দুর্গাপূজায় বিনা কারণে হয়েছে। গত ৫০ বছরে একবার নয়, বারে বারে হয়েছে। ফলে হিন্দুরা ক্রমেই সংখ্যালঘু হয়েছে। গত ৫০ বছরের পরিসংখ্যান এমন ইংগিতই দেয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে সবচেয়ে বেশি গণহত্যা চলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। এর কারণ জগনন্নাথ হল ছিল হিন্দু অধ্যুষিত ছাত্রাবাস। তখন হিন্দু-মুসলমান চেনার জন্য লুঙ্গি খুলে দেখে ছিল। তখন ওরা ভিন্ন দেশী ছিল, চেহারা দেখে চিনতে পারত না কে হিন্দু কে মুসলমান। তাই লুঙ্গি খুলে দেখত। এখন আর তা দরকার হয় না। একে অন্যের প্রতিবেশি। সবাই সবাইকে চিনে। তাই সরাসরি ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দিতে পারে। উল্লেখ্য, গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার মনোহরপুর রাজ-রাজেশ্বরী কালি মন্দিরের সেবায়েত দিলীপ কুমার দাসকে মন্দিরে মিছিলকারী তরুণেরা ইট মেরে আহত করে। গত ২২ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেলে তিনি মারা যান। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সংখ্যানুপাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আসমান জমিন বৈষম্য। উদাহরণ হিসাবে যদি দেখি, জন্মাষ্টমীতে একদিন, পাঁচদিনের দুর্গাপূজায় একদিনসহ মোট দুদিন ছুটি, আর বৌদ্ধদের একদিন, খৃস্টানদের একদিন করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জাতীয় ছুটি থাকে। গত ৫০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিদ্যালয় একজনও সংখ্যলঘু যোগ্য অধ্যাপক পায়নি, যাঁকে উপাচার্য হিসাবে নিযোগ দিতে পারে। যশস্বী পণ্ডিত খ্যাতিমান স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা একমাত্র নামের কারণে এসব দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হন। একই কথা বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ ধরনের অপ্রিয় সত্য কথা বলেন বলেই রানা দাশগুপ্তরা সাম্প্রদায়িক হয়ে যান। যাঁরা বঞ্চিত করেন, তাঁরা স্যাকুলার থাকেন। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতে হচ্ছে বলে আমি সত্যি লজ্জিত এবং আবারও পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র–এ চার জাতীয় মূলনীতিরভিত্তিতে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনকালে যখন হিন্দুদের জানমাল রক্ষার জন্য পাহাড়ার ব্যবস্থা করতে হয়, মানববন্ধন, সম্প্রীতি মিছিল করতে হয়, তখন মূলনীতিরভিত্তিই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে যায়। সেই বিকশিত চেতনা নিয়ে সন্দেহ জাগে। আসলে কি মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা বিকশিত হয়েছে? সেই চেতনা আজকের বাংলাদেশ কি ধারণ করে? গত শতকের ষাটের দশকে রবীন্দ্র জন্মশতবাষির্কী উদযাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমান শতকে এসেও সরকারের নির্বাহী আদেশে হেফাজতের দাবির প্রেক্ষিতে ‘ধর্মকে অগ্রাধিকার দিয়ে’ পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে তাদের সমমনা পেশাজীবীদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। “পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের ক্ষেত্রে ধর্ম এবং সামপ্রদায়িকতার প্রভাব এতটাই পড়েছে যে-তার কাছে অন্য সমস্যাগুলো গৌণ হয়ে গেছে”-বিবিসি বাংলাকে বলেছেন জাতীয় নাগরিক কমিশনের সদস্য সচিব অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। পাঠ্যপুস্তকে ‘বানান ভুল’, ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য বা ভুল তথ্য’ এবং ‘সামপ্রদায়িকতা’, এই তিনটি সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে। তবে বাংলা বইয়ে ‘ধর্ম এবং সামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব বেশি পড়েছে’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। হেফাজতের দাবির সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে আনা সংশোধনীর কোথায় মিল আছে, তাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিবিসিকে বলেছেন, “মূল সমস্যা হচ্ছে সামপ্রদায়িকীকরণ। যেমন তারা বলছে, হিন্দু লেখকদের বাদ দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সোনার মন্দিরে বাদ দিতে হবে।…হুমায়ুন আজাদের লেখা বই নামের কবিতা বাদ দেয়া হয়েছে। এটি নাকি কোরান নিয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু আসলে তা সঠিক নয়। এসবের মাধ্যমে সামপ্রদায়িক শক্তি কৌশলে একটা আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে।” তাহলে উন্নতিটা কোথায় হলো?
তাহলে গত ৫০ বছরে যা কিছু উন্নয়ন ঘটেছে তা কাঠামোগত উন্নয়ন। এমন উন্নয়ন ধর্মান্ধ রাষ্ট্রসমূহে আরও বেশি হয়েছে। কিন্তু গত ৫০ বছরে মেধার উন্নয়ন ঘটেনি। রাষ্ট্র ধর্ম চর্চা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটে না। সামপ্রদায়িক শক্তির বিকাশ ঘটে। তখন এক সময় কাঠামোগত উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সেদিকে এগুচ্ছে। এখনই এর রাশ টেনে না ধরলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ অন্ধকারে পথ হারাবে। বর্তমান সময়ে ঘটনাপ্রবাহ তারই আলামত। আজ আমার প্রিয় জন্মভূমি নিয়ে এসব কথা লিখতে ঘটে যাওয়া সব গভীর মর্মস্পর্শী ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে। তারপরও পাঠক, আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণ : রফিকুল আনোয়ার
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ৪৯.৯৯ কোটি টাকা