স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ১২টি বাহিনীর ৫০ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন। দেশে প্রথমবারের মতো একজন নারী জলদস্যুও আত্মসমর্পণ করেছেন। দস্যুদের কাছ থেকে ৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২৮৩টি গুলি জমা পড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ মে) দুপুরে নগরীর পতেঙ্গায় র্যাব–৭ কার্যালয়ে এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে না আসা জলদস্যুদের ছাড় দেয়া হবে না। যে কোনো মূল্যে অপরাধীদের দমন করব। তারা যেন অপরাধ করার চিন্তাও না করে। একজন সাংবাদিকের মধ্যস্থতায় বাঁশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া অঞ্চলের ৫০ জন জলদস্যু এ অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করেছেন।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চলের চিহ্নিত অস্ত্রের কারিগর ও জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ, এটি চতুর্থবারের মতো। এবারের ৫০ জনসহ মোট ২১৩ জন জলদস্যু চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল থেকে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জলদস্যুতা আপনাদের জীবনে কখনও শান্তি ফিরিয়ে আনবে না। আমরা খুব শিগগির সমস্ত নৌ অঞ্চল জলদস্যু ও ডাকাত মুক্ত ঘোষণা করব। আমরা কাউকে ক্ষমা প্রদর্শন করবো না। যারা এ পেশা ত্যাগ করবে না, তারা কী দুঃসংবাদ লিখে নিয়ে যাবেন সেটা মহান আল্লাহ জানেন। কাউকে ক্ষমা করা হবে না।
মন্ত্রী বলেন, আজ এখানে একজন মহিলা জলদস্যুও আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তারা কখনও অত্যাচারিত বা নিপীড়িত হয়ে বাধ্য হয়ে এসব কাজে জড়িয়ে থাকেন। স্থানীয় প্রভাবশালী লোকেরাও তাদের বাধ্য করেন এসব কাজে জড়াতে।
সুন্দরবনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সুন্দরবনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান রক্ষায় ২০১২ সালে র্যাবের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করে তাদের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। র্যাবের দুঃসাহসিক অভিযানে সুন্দরবন জলদস্যু মুক্ত হয়। ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত ঘোষণা করেন। তারা যাতে আর সে কাজে ফিরতে না পারে তাদের আর্থিক অনুদান দেওয়া হচ্ছে। আজ তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। কেউ ব্যবসা করছেন বা অন্য কাজ করছেন। সুন্দরবনে জলদস্যুদের ভালো অবস্থা দেখে আজ অন্যরাও উদ্বুদ্ধ। যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই।
চরমপন্থী নির্মূলের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, পাবনাতে ৬০০, সিরাজগঞ্জে তিনশর বেশি চরমপন্থী গ্রুপের নেতাকর্মী আত্মসমর্পণ করেছেন। তাদেরও সরকার সহযোগিতা করেছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের ও খুনের মামলা আছে তাদের কোনোভাবে সহযোগিতা করা হবে না।
র্যাবের প্রশংসা করে মন্ত্রী বলেন, জন্মলগ্ন থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করতে গিয়ে র্যাবের ৩৩ জন সদস্য জীবন দিয়েছেন। হাজার হাজার র্যাব সদস্য আহত হয়েছেন। অনেকের অঙ্গহানিও হয়েছে। জনগণের কাছে র্যাব একটি আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক।
পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, র্যাব সন্ত্রাসীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। জঙ্গি নির্মূলে র্যাবের ভূমিকা অপরিসীম। র্যাব অপরাধ দমনের জন্য কিছু সৃজনশীল কাজ হাতে নিয়েছে। জনগণের শান্তির জন্য পুলিশের সঙ্গে র্যাব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। সুন্দরবনে জলদস্যুদের আস্তানা ও আধিপত্য ছিল। র্যাবের মাধ্যমে সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করা হয়েছে। জলদস্যুদের সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকার বিভিন্ন কাজ করছে। জাল, নৌকা, দোকান দেওয়া হয়েছে। ঘর করে দেওয়া হয়েছে। দুবলার চরে সুপেয় পানির জন্য র্যাব ওয়াটার প্ল্যান্ট করে দিয়েছে।
র্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী একটা ঘোষণা দিয়েছিলেন জঙ্গি ও মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’। আমরা জঙ্গির ক্ষেত্রে সেটা সফল হয়েছি। একটা জায়গায় আমরা সফল হতে পারিনি, সেটা মাদক। আমি যদি আমার বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি, আমার ব্যর্থতা স্বীকার করতে পিছপা হব না। জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে খুরশীদ হোসেন বলেন, এ দেশে ২০০৪ সালে নর্থ বেঙ্গল থেকে জঙ্গির উত্থান হয়েছিল। হয়তো আমরা তা নির্মূল করতে পারিনি। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করেছি। সন্ত্রাসী, জঙ্গি, জলদস্যু যা–ই বলেন আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। এটা ঠিক বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ক্রাইম ফ্রি আছে। সবাই অপরাধকে নির্মূল করতে পারেনি। নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। সেক্ষেত্রে আমরা সফল।
র্যাব জানায়, ১৯টি জলদস্যু বাহিনী দস্যুতা চালিয়ে আসছিল। বৃহস্পতিবার ১২টি গ্রুপের ৫০ জন জলদস্যু ৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২৮৩ রাউন্ড গুলি ও কার্তুজ জমা দিয়েছেন। তারা ৩৫টি একনলা বন্দুক, ১৭টি এসবিবিএল, ১৭টি ওয়ান শুটার গান, ১টি দুইনলা বন্দুক, ১টি পিস্তল, ১টি রিভলভার, ৩টি বিদেশি পিস্তল, ১টি এসএমজি, ২টি এয়ারগান ও আটটি ছুরি এবং চারটি ওয়াকিটকি জমা দিয়েছে। র্যাবের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার শরীফ উল আলম জানান, আত্মসমর্পণকৃত জলদস্যুদের মধ্যে তিনজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত জলদস্যু ও একজন নারী জলদস্যু রয়েছেন। বাহিনীগুলোর মধ্যে জসিম বাহিনীর ছয়জন, কালু, মিন্টু ও বদইল্লা ডাকাত বাহিনীর পাঁচজন করে ১৫ জন, মাহমুদুল করিম, রমিজ, ইয়ার আলী, সুলতান ও কালা রশিদ বাহিনীর ৩ জন করে ১৫ জন, নাছির বাহিনী ও জালাল বাহিনীর ২ জন করে ৪ জন ও অন্যান্য বাহিনীর ১০ জন।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম –১১ আসনের সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম, র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মাহাবুব আলম, রেঞ্জ ডিআইজি নূরে আলম মিনা, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় ও র্যাব–৭ অধিনায়ক মাহবুব আলম। আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুদের মধ্যে বক্তব্য দেন মাহমুদুল করিম ও জসীম উদ্দীন।
আত্মসমর্পণ করা মাহমুদুল করিম বলেন, ঘটনাচক্রে তিনি জলদস্যু হলেও তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে। এই কারণে পরিবার ও স্বজনদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হতো। এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চান। এ জন্য আত্মসমর্পণ করেছেন।
র্যাব জানায়, জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের ফলে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বাঁশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপকূলীয় অঞ্চলে দস্যুতায় নিয়োজিত অন্যান্য জলদস্যু ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে দারুণভাবে উৎসাহিত হবে। র্যাব আরো জানায়, বাঁশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়াসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জলদস্যু অথবা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করার লক্ষ্যে র্যাব–৭–এর ধারাবাহিক অভিযান সামনের দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে। র্যাব–৭ কর্মকর্তারা বলছেন, আজকে পর্যন্ত র্যাব–৭ এর কাছে বাঁশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া অঞ্চলসহ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের ৩৪২ জন কুখ্যাত জলদস্যু এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী আটক হয়। এ সময় দেশি–বিদেশি মিলিয়ে সর্বমোট ২,৬০৩টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রসহ ২৯,১২৩ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে।