২০ বছরে লোপাট অর্ধশত কোটি টাকা

সরকারি জায়গায় অবৈধ দোকান, বসতঘর ।। চমেক হাসপাতালে অভিযানের প্রস্তুতি দুদকের

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অভ্যন্তরে সরকারি জায়গায় ক্যান্টিন, গ্রোসারি শপ, পানের দোকান, অবৈধ বসতঘর নির্মাণ করে ২০ বছরে কমপক্ষে অর্ধশত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ প্রভাবশালী কর্মচারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। চলতি সপ্তাহেই সরকারি এসব জায়গা উদ্ধার করার জন্য সাঁড়াশি অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর আগে চমেক হাসপাতালের চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতে টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে ঘুষ দুর্নীতিসহ স্পর্শকাতর নতুন নতুন তথ্য।
দুদক বলছে, মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ, সমবায় অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষের লোকজনও এতে জড়িত বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে। সরকারি জায়গায় নির্মিত স্থাপনা উদ্ধার করে চমেক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ক্যান্টিন ও গ্রোসারি শপগুলো উন্মুক্ত দরপত্র দিয়ে বৈধ ঠিকাদারদের বরাদ্দের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এতে মোটা অংকের সরকারি রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে। জানা যায়, চলতি বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম বিএমএ সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে নেমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালসহ বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক, জেলার সিভিল সার্জনসহ নগরীর ১৫টি বেসরকারি হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট নথি চেয়ে চিঠি দেয় দুদক। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেন চিকিৎসকসহ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এক ডজন ঠিকাদারকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গণপূর্তসহ কয়েকটি দপ্তরের সাড়ে ৮০ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত হয় চট্টগ্রামের দুই কোটি মানুষের সরকারি চিকিৎসা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ২০০১ সালে হাসপাতালের কর্মচারীদের স্বল্প ব্যয়ে খাবার সুবিধার জন্য ক্যান্টিন করার অনুমতি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের অভ্যন্তরে রয়েছে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের একটি ক্যান্টিন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের একটি ক্যান্টিন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্টাফ কো-অপারেটিভ সোসাইটির একটি ক্যান্টিন, নার্সেস এসোসিয়েশনের একটি ক্যান্টিন। শুধুমাত্র হাসপাতাল স্টাফদের জন্য তৈরি হলেও পরে সমিতি বানিয়ে ক্যান্টিনগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু করে প্রভাবশালী কর্মচারীরা। পরে একই কায়দায় হাসপাতালের অভ্যন্তরে কয়েকটি স্পটে খালি জায়গায় বেশ কয়েকটি গ্রোসারি শপ ও পানের দোকান বানিয়ে মোটা অংকে ভাড়া দেয় কর্মচারী সমিতি। বর্তমানে একেকটি ক্যান্টিন থেকে মাসে ভাড়া আসে এক থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। সমিতির আয় থেকে টাকা ভাগাভাগি হয় হাসপাতালের উঁচুস্তর থেকে শুরু করে চিকিৎসক নেতাদের মধ্যেও।
বর্তমানে এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন হাসপাতালের টেন্ডার শাখার রেকর্ড কিপার মঈনুদ্দিন আহমেদ। তিনি কর্মচারী সমিতির বর্তমান সভাপতি। অনুসন্ধানেও তার ব্যাংক হিসেবে অস্বাভাবিক লেনদেনের হদিস পেয়েছে দুদক। তাঁর স্ত্রী অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক কানিজ ফাতেমার ব্যাংক হিসেবেও লেনদেন হয়েছে কোটি কোটি টাকা। পাশাপাশি হাসপাতালের অভ্যন্তরে গোয়াছি বাগান এলাকায় অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে স্টাফদের প্রায় পাঁচ শতাধিত বসতিও। হাসপাতালের কর্মচারী বাদেও বহিরাগতদের ভাড়ায় দেওয়া হয় এসব বসতি।
হাসপাতালের অভ্যন্তরের ক্যান্টিন ও স্টাফদের বসতিগুলো কর্মচারীরা ভোগ করলেও নাগরিক সুবিধা হিসেবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল পরিশোধ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, ক্যান্টিনে ব্যবহৃত বিদ্যুতের বিল কিছুদিন কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে, কিছুদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করে আসছিল। পরে চমেক হাসপাতালের কর্মচারীদের এসব ক্যান্টিন, গ্রোসারি শপের ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ নিয়ে গণপূর্তের বৈদ্যুতিক বিভাগ প্রত্যয়নপত্র দেয়। এরপর এসব বিল হাসপাতাল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিরা পরিশোধ করেন। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পিডিবিকে বিল পরিশোধের সময় ওই বিল সমন্বয় করে আসছে। গ্যাসের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াতেই কোনো স্বচ্ছতা নেই বলে দাবি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০০১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অভ্যন্তরে খালি জায়গায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ক্যান্টিন করার অনুমতি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তখন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, এসব ক্যান্টিন হবে শুধুমাত্র স্টাফদের জন্য। বাণিজ্যিকভাবে কাউকে ক্যান্টিন করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিছুদিন পর থেকে ক্যান্টিনগুলো সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়। এরপর কর্মচারীরা সমবায় থেকে সমিতি নিবন্ধন করে ওই সমিতির নামে ক্যান্টিনগুলো টেন্ডার দেওয়া শুরু করে। অথচ এসব ক্যান্টিন সরকারি জায়গায়। একইভাবে মেডিকেলের অভ্যন্তরের কয়েকটি স্পটে গ্রোসারি শপ বানিয়ে মোটা অর্থে ভাড়ায় দিয়েছে। ক্যান্টিন ও গ্রোসারি শপের আয় সমিতির ব্যাংক হিসেবে জমা করে। এরপর ব্যাংক হিসাব থেকেই বিভিন্ন কর্মকর্তার উপরি দেন সমিতির নেতারা।
ওই কর্মকর্তা বলেন, পরিচালকের মর্জির ওপর নির্ভর করে হাসপাতাল পরিচালনা। পরিচালকের সম্মতি কিংবা নির্দেশনা ছাড়া কোনো কিছুই হয় না চমেক হাসপাতালে। দেশের সব জায়গায় বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রদানকৃত সেবার বিপরীতে বিল করে। কিন্তু চমেক হাসপাতালের চিত্র ভিন্ন। চমেক হাসপাতালের হিসাব বিভাগ থেকে তৈরিকৃত বিল পিডিবি ও কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করে। তারপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করে। ক্যান্টিনগুলো টেন্ডার করে এসবের অর্থ তাদের সমিতির ব্যাংক হিসেবে জমা রাখে। তিনি বলেন, অগ্রণী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ শাখায় সমিতির হিসাব পর্যালোচনা করলেই বিগত বছরগুলোতে কার কার হিসেবে টাকা গেছে তার চিত্র পেতে পারে দুদক।
সরকারি জায়গায় অফিস বানানো হলেও কর্মচারী সমিতির নিবন্ধন দিয়েছে সমবায় অধিদপ্তর। অথচ সরকারি জায়গা বেসরকারি ব্যক্তিবিশেষের অফিস হলেও এটা অবৈধ। যোগসাজশের মাধ্যমে এসব অবৈধ কাজের বৈধতা দিয়েছে সমবায় অফিস। তিনি বলেন, জায়গা সরকারি, কর্মচারীরাও সরকারি। সরকারি জায়গায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টেন্ডার করছে বেসরকারি সমিতি। এটি অবৈধ। এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময়ে কয়েক কোটি টাকা লোপাটের আশংকা এই কর্মকর্তার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অভ্যন্তরে গোয়াছি বাগান এলাকায় বসতিগুলোর স্টাফরা বিনা খরচে ব্যবহার করছে। এসব অবৈধ বসতি থেকে বেতনের একটি অংশ কর্তনের বিষয়ে আপত্তিসহ পরামর্শ দিয়েছিল বাণিজ্যিক অডিট। আবার সরকারি জায়গায় ক্যান্টিন ভাড়া দিচ্ছে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতি। এসব আয় সরকারের পাওয়ার কথা। কিন্তু আয়ের এসব টাকা কর্মচারী সমিতির নামে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব অনিয়মের ঘটনায় সব মিলিয়ে ৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি অর্থ লোপাট হয়েছে। চলতি সপ্তাহে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা দখলমুক্ত করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি ক্যান্টিনগুলো উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানটিও ২০১৪ সালের পর থেকে টেন্ডার হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি জায়গা। এক টাকা আয় করলেও সবই সরকরি অর্থ। হাসপাতালের ক্যান্টিন বরাদ্দের নামে ব্যাংক হিসেবের মাধ্যমে যত উপরি লেনদেন হয়, তার চেয়ে বেশি লেনদেন হয় আন্ডার ক্যাশে।
বিভিন্ন সময়ে পরিচালকদের হিসাবে কর্মচারী সমিতির অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস. এম. হুমায়ুন কবীর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে যে সময়ে লেনদেন হওয়ার অভিযোগ উঠেছে, ওই সময়ে তিনি পরিচালক পদে ছিলেন না।
তিনি গত রাতে আজাদীকে বলেন, ক্যান্টিনগুলো আগে থেকে অবৈধ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। এসব ক্যান্টিন বরাদ্দ দেওয়া কিংবা টেন্ডার করার বিষয়ে কর্মচারী সমিতিকে কোনো অনুমোদন দেননি তিনি। সমিতির কাছে কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। যে কারণে দুদক তাদের কাছে ক্যান্টিনগুলোর বিষয়ে নথি চেয়েছে।
অবৈধ হয়ে থাকলে ক্যান্টিনগুলো বন্ধের ব্যবস্থা নেবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। সরকারের পিপিআর নীতিমালা আছে। হাসপাতালের ক্যান্টিনগুলো হাসপাতাল থেকে টেন্ডার দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানও নিয়মমাফিক বরাদ্দ দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছি। কয়েক দিন আগে তাদের কাগজপত্র চেয়েছি। তাদের কাছে বৈধ কাগজ নেই। কাগজপত্র চেক করে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিএমপির ২৬ নির্দেশনা
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে আবারও নৌকা প্রতীক পেলেন মেয়র বদিউল আলম