বাজেট শব্দটি অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত। একটি অর্থনীতিতে সরকারের সকল প্রকার কার্যাবলী সম্পাদন করার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সরকার নিজে কোনো ব্যক্তি নয়। বরং একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। যেহেতু সরকার নির্বাচিত হওয়ার সময় জনগণকে বিভিন্ন কথা দিয়ে থাকে সেহেতু নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে। বিশেষ করে জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য, ভাগ্যের পরিবর্তন আনার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প। আবার এসব প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের নিকট প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। কাজেই আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাতসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য একটি ধারাবাহিক হিসাবের প্রয়োজন হয়। এ ধারাবাহিক হিসাবই হলো বাজেট। অন্যভাবে বলা যায়, একটি অর্থনীতির নির্দিষ্ট সময়ের ধারাবাহিক আয় ও ব্যয়ের হিসাবকে বাজেট বলে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের বাজেটের মধ্যে দুইটি অংশ বিদ্যমান থাকে। এদের একটি হয় রাজস্ব বাজেট আর অপরটি হয় উন্নয়ন বাজেট। আবার উভয় অংশের মধ্যে আয় ও ব্যয়ের খাতকে ষ্পষ্টভাবে দেখাতে হয়। অর্থাৎ উভয় অংশের মধ্যে আয় ও ব্যয়ের দুইটি খাত থাকবে এবং উভয় অংশে আয় এর উৎস উল্লেখ থাকে। অবশেষে সামগ্রিক আয় ও সামগ্রিক ব্যয়ের ভেতর সামঞ্জস্য বিধান করে বাজেট প্রণয়ন করতে হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আর্থিক বৎসর শুরুর সময়কাল বিভিন্ন হয়। কোনো কোনো দেশে বাজেট এর সময়কাল হয় জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। আবার কোনো কোনো দেশে শুরু হয় এপ্রিল থেকে আর শেষ হয় মার্চ মাসে।
বাংলাদেশে বাজেটের সময়কাল শুরু হয় বর্তমান বছরের জুলাই থেকে এবং শেষ হয় পরবর্তী বছরের জুন মাসে। সরকার প্রথমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে কোন কোন খাতে ব্যয় করবে এবং কোন কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। ব্যয়ের খাতগুলো স্থির করার পর এবার সরকার কোন কোন খাতে কর আরোপ করে আয় করবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ব্যক্তির বাজেটের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যক্তি প্রথমে আয়ের পরিমাণ ঠিক করে ব্যয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এজন্য বলা হয়ে থাকে যে, ব্যক্তি আয় বুঝে ব্যয় করে। কিন্তু সরকারের বাজেটের ক্ষেত্রে সরকার আয় বুঝে ব্যয় করে না। বরং ব্যয় বুঝে আয় করে। সরকার যেহেতু আয়ের পরিমাণ বাড়াতে বা কমাতে পারে সেহেতু বাজেট করার সময় সরকার আয় বৃদ্ধির জন্য করের পরিমাণকে বৃদ্ধি করে। নতুন নতুন করদাতা খুঁজে বের করে। এ কারণে বাজেট এলেই নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত– সবার চোখ থাকে কোথায় খরচ বাড়লো, কোথায় কমল, তা জানতে। কারণ বাজেটের নেয়া উদ্যোগগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলে। ২০২৩–২৪ আর্থিক বছরের বাজেটও এর ব্যতিক্রম নয়। এ অর্থ বছরে যে বিষয়গুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন তা হলো– করদাতা বাড়ানো, বিলাস পণ্যের ওপর কর আরোপ করা, সুপার ট্যাক্স আরোপ করা, ফ্ল্যাট ও প্লটের ওপর অধিক কর আরোপ করা ইত্যাদি। আগামী অর্থ বছরে সরকারকে নতুন নতুন করদাতা খুঁজে বের করতে হবে। এনবিআর (ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ) এর তথ্য থেকে জানা যায় বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি লোকের মধ্যে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) লোক আছেন মাত্র ৮৭ লাখ। আর এর মধ্যে রিটার্ন জমা দেন মাত্র ৩০ লক্ষ লোক। এ ৩০ লক্ষ লোক হয় বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ২ শতাংশ। এখন উপজেলা ও গ্রামগঞ্জে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হয়েছে। গ্রামগঞ্জেও এমন বহু লোক আছে যারা করযোগ্য। অথচ এদেরকে করের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এমন কি শহরে বিলাস বহুল জীবনযাপন করে– এমন অনেক লোককেও করের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। এনবিআর এর মতে, জনবলের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। ২০২৩–২৪ অর্থ বছরের বাজেটে তাদেরকে করের আওতায় আনা একান্তই প্রয়োজন। অন্যথায় সরকারের বাজেটে আয়ের পরিমাণ তেমন বাড়বে না।
উন্নত দেশে দেখা যায়, নতুন করদাতা খুঁজতে আয়কর বিভাগ এজেন্ট নিয়োগ করে। বাংলাদেশেও এরূপ এজেন্ট নিয়োগ করা যেতে পারে। অবশ্য এরূপ নীতি আয়কর আদেশে নাও থাকতে পারে। যদি না থাকে তবে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন ধারা সংযোজন করে আয়কর এজেন্ট নিয়োগ করা যেতে পারে। এ সকল এজেন্টদের কাজ হবে করদাতাদের চিহ্নিত করে তাদের টিআইএন দেয়া এবং রিটার্ন জমা দিতে সহায়তা করা। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের সামাজিক বিধি ব্যবস্থায় এমনিতেই ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি অধিক। করদাতা খুঁজতে এজেন্ট নিয়োগ দিলে তাতে ঘুষ ও দুর্নীতির সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। এ বিষয়টি চিন্তা করে সরকারকে সামনের দিকে এগুতে হবে।
সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে, উন্নয়নমুখী বাজেট প্রণয়ন করে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করা। বিগত দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশের মানুষদের মাথাপিছু আয় বাড়তে শুরু করে। মাথাপিছু আয়কে সাধারণত দেশীয় মুদ্রায় হিসাব করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের জন্য মাথাপিছু আয়কে ডলারেও প্রকাশ করতে হয়। ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’–এর তথ্য অনুসারে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৪১৪ টাকা। ২০২১–২২ অর্থ বছরে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭ টাকা। অর্থাৎ ২০২১–২২ অর্থ বছরের তুলনায় ২০২২–২৩ অর্থ বছরে মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে ২৯ হাজার ৩৬৭ টাকা। অন্যদিকে যদি ডলারে হিসাব করা হয় তবে বিগত অর্থ বছরের তুলনায় মাথাপিছু আয় কমেছে। ২০২১–২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলার। আর ২০২২–২৩ অর্থ বছরে তা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে, অর্থাৎ বিগত আর্থিক বছরের তুলনায় চলতি অর্থ বছরে মাথাপিছু আয় কমে গেছে ২৮ ডলার। ডলারে মাথাপিছু আয় কমার প্রধান কারণ হলো যে, বিগত অর্থ বছরের তুলনায় চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশি টাকায় ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গত অর্থ বছরে ডলারের মূল্য ছিল ৮৬ টাকা ৩০ পয়সা। আর চলতি বছরে ডলারের মূল্য ধরা হয়েছে ৯৭ টাকা ৮১ পয়সা।
মাথাপিছু আয় ডলারে হিসাব করা হলে তা দ্বারা অন্য দেশের সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার প্রকৃত মূল্য পাওয়া যায় না। যেমন– মার্কিন মুল্লুকে এক কাপ চা এর দাম প্রায় এক ডলার বা তা থেকেও অধিক। কিন্তু ১ ডলার যদি বাংলাদেশি ৯৭ টাকা ৮১ পয়সা ধরা হয় তবে বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলে এক কাপ উন্নতমানের চা এর দাম কখনো ৯৭ টাকা ৮১ পয়সা হবে না। অতএব মাথাপিছু আয় ডলার দ্বারা অন্য দেশের সাথে তুলনা করা যায়, কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ডলারের হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয় কমলেও দেশীয় মুদ্রায় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি তা এ দেশের জনগণের মঙ্গল বয়ে আনবে। তবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মাথাপিছু আয় যাতে এ দেশের ধনী জনগোষ্ঠী কব্জা করতে না পারে সে বিষয়ে সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। যে দিন এ দেশে দারিদ্র্যের হার ১ থেকে ২ শতাংশে নেমে আসবে সেদিনই এই দেশ প্রকৃত উন্নত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি।