হেলমেট না পরা ও বেপরোয়া গতিই দায়ী

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৩ নভেম্বর, ২০২২ at ৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে মেয়েকে কলেজে পৌঁছে দেয়ার সময় লরির সাথে সংঘর্ষে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে এক কলেজছাত্রী নিহত হন। তার বাবা মো. ফারুক মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনায় চোখের সামনে মেয়ের মৃত্যু দেখে বেশ কয়েকবার সড়কে চলাচলরত গাড়ির নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ওই ছাত্রীর বাবা। গত ২৩ জুলাই বিকেল ৩টার দিকে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোডের ৩ নম্বর ব্রিজের পাশে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ফাতেমা জাহান নগরীর এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলেন।

এটি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। সহজে বহন, পারিবারিক প্রয়োজন এবং ফ্যাশনে মোটর সাইকেলের বিকল্প নেই। মোটরসাইকেল গতির বাহন। মূলত যুবকরা এই বাহন ব্যবহার করে থাকে। তবে এই বাহনে ভারসাম্যহীনতার সমস্যা আছে, ফলে মোটরসাইকেল যেমন বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্ঘটনা। ইদানিং সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও প্রাণহানির বড় কারণ বেপরোয়া মোটরসাইকেল। বুয়েটের গবেষণায় বলা হচ্ছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে অভিভাবকগণ অতি আবেগী হয়ে কিশোর এবং উঠতি তরুণদের হাতে তুলে দিচ্ছেন মোটর সাইকেলের চাবি।

অধিকাংশই কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া রাস্তায় নামছে মোটরসাইকেল নিয়ে। বয়সটা এমন যে গতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কথা নয়। গত ছয় মাসে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ১৯ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে জেলায় ১৩ টি এবং নগরীতে ছয়টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন সাত জন। এর মধ্যে জেলায় ১৪ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়েছেন।

অন্যদিকে নগরীতে নিহত হয়েছেন ছয়জন। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার সকালে হাটহাজারী থানার বাসস্ট্যান্ড এলাকার এম আলম সিএনজি পাম্পের সামনে ট্রাকের ধাক্কায় সৈয়দ রাসেল (৪০) নামে এক মোটরসাইকেল চালক নিহত হয়েছেন।

সিএমপির ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) মো. তারেক আহম্মেদ এ প্রসঙ্গে আজাদীকে বলেন, সচেতনতার বিকল্প নেই। আবেগের বশে মোটরসাইকেল সন্তানের হাতে তুলে দেওয়ার সময় ভাবছি না যে, হয়তো এর ফলে সন্তানকে চিরতরে হারাতেও হতে পারে। তিনি বলেন, রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ অধিকাংশ মামলা করছে মোটর সাইকেলের বিরুদ্ধে। কারও লাইসেন্স নেই, কখনো আবার চালক কিংবা আরোহীর মাথায় হেলমেট নেই, কারও ডকুমেন্ট ফেল। কিন্তু আইন প্রয়োগ করে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। যদি আমরা সচেতন না হই। বেপরোয়া গতি ও উল্টো পথে যাত্রার কারণে চট্টগ্রামে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চট্টগ্রামের ট্রাফিক পুলিশ প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার মামলা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। তিনি বলেন, চালকরা সচেতন না হলে দুর্ঘটনা এড়ানো আরো কঠিন।

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে ২৮.৪টি। বাংলাদেশের পর কম্বোডিয়ায় ১১.৯, লাওসে ১১.৫, থাইল্যান্ডে ১১.২, ভারতে ৯, মিয়ানমারে ৮.৬, মালয়েশিয়ায় ৪.৪, ভিয়েতনামে ৪.১, ইন্দোনেশিয়ায় ২.৫ এবং ভুটানে ২.১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ হেলমেট না পরার কারণে এবং ১২ শতাংশ ত্রুটিযুক্ত হেলমেট পরার কারণে মারা গেছেন। শতকরা ৪৩ শতাংশ মোটরসাইকেল চালক হেলমেট ব্যবহার করেন না। এর কারণ হিসেবে চালকরা বলেছেন, হেলমেট পরার কারণে তারা বেশ গরম অনুভব করেন। ২৫ শতাংশ চালক হেলমেট পরতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না এবং ১১ শতাংশ চালক কাছাকাছি দূরত্বে যাতায়াতের সময় হেলমেট পরেন না। ৫ শতাংশ চালক বলেছেন, তাদের কোনো হেলমেট নেই। অতিরিক্ত গতির কারণে ৫১ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়। অমনোযোগী অবস্থায় চালাতে গিয়ে ৪০ শতাংশ এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে ৪৯ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে।

নগরীর বিভিন্ন সড়ক পর্যবেক্ষণ করে সর্বাধিক সংখ্যক বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেল আরোহী দেখা গেছে নবনির্মিত আউটার রিং রোডে। চার লেনের সড়কটি সুপ্রশস্থ হওয়া সত্ত্বেও উল্টো পথে ‘মরণযাত্রায়’ পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছেন একাধিক মোটরসাইকেল আরোহী। কোনো মোটরসাইকেলে তিনজন আরোহী, কোনো কোনোটিতে হেলমেট নেই। তীরের সুপ্রশস্থ সড়ক ধরে লেন বদল করে উল্টো পথে যাত্রার কারণ প্রসঙ্গে চালকদের একজন হাসিব বলেন, বাঁ পাশের লেন ধরে সাগর দেখা যায় না। এই কারণে ডান লেনে সাগর দেখতে দেখতে এলাম।

নগরীর ব্যস্ততম জাকির হোসেন রোড দিনের বেশির ভাগ সময়ই থাকে যানজটপূর্ণ। সেই পথেই বিকট শব্দ করে চালাচ্ছিলেন অভিক সেন নামের এক মোটরসাইকেল চালক। তিনি বলেন, এই সড়কে আইন মেনে গাড়ি চালালে দীর্ঘ যানজটে থাকতে হবে। তাই ফাঁকফোকর দিয়ে চলে যেতে হয়। আর দুই চাকার গাড়ি কিনেছি তো যানজট এড়ানোর জন্য। অতএব একটু সাবধানে চালালে সমস্যা নেই।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় চালকদের বয়স পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৩-২৫ বছরের চালকরা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে চালকদের হেলমেট ও লাইসেন্স না থাকা এবং বেপরোয়া গতিই বেশি দায়ী। এর মধ্যে ১৩-১৮ বছরের চালকরা কিশোর, যাদের কোনো লাইসেন্সও থাকে না।

সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের তালিকাটা দীর্ঘ হচ্ছে। এসব দুর্ঘটনার বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। গত বছরের তুলনায় এবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে। এবার জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ২০০৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০৯৭ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৬৪ জনই শিক্ষার্থী। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১২৮৬ জন। চলতি বছরের ১০ মাসে সারাদেশে সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার এই চিত্র তুলে ধরেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ৩৭৪টি (১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ), মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ৬২৯টি (৩১ দশমিক ৪০ শতাংশ), মোটরসাইকেলে অন্য যানবাহনের চাপা ও ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ৯৫৮টি (৪৭ দশমিক ৮২ শতাংশ) এবং অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪২টি (২ দশমিক ০৯ শতাংশ)।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দেশের সর্বত্র কিশোর-যুবকদের হাতে বেশি গতির মোটরসাইকেলের ছড়াছড়ি। এগুলো ক্রয় ও ব্যবহারে নিয়মকানুন মানার বালাই নেই, নেই মনিটরিং ব্যবস্থা। তিনি আরও বলেন, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ মোটরসাইকেল চলছে। মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব ও যানজটের কারণে মোটরসাইকেলের ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেলের ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগ্রেপ্তার আটজন তিনদিনের রিমান্ডে
পরবর্তী নিবন্ধওভারটেক করতে গিয়ে ট্রাকের নিচে বাইক, আরোহী নিহত