হৃদয়ের যত্নে হৃদয়বান হোন

২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস

ডা. প্রবীর কুমার দাশ | মঙ্গলবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

ভূমিকা : ইংরেজী ‘হার্ট’ মানে হৃদয় ও হৃৎপিণ্ড দু’টোই বোঝায়। যদিও এই দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য কিছুটা রয়েছে। যেমন হৃদয়হীন মানুষ হতে পারে কিছু হৃৎপিণ্ডহীন মানুষ অকল্পনীয়। আবার সবাই হৃদয় তথা হৎপিণ্ডের অধিকারী হলেও তাদের সবাই হৃদয়বান নাও হতে পারে। অর্থাৎ হৃদয়বান হতে হলে মানবিক গুনাবলী আবশ্যক। চিন্তাধারা বিশেষত্ব, দয়া, সহানুভূতিশীলতা, পরার্থপরতা ইত্যাদি হৃদয়বান ব্যক্তির অন্যতম দিক হিসাবে বিবেচিত। ২০১৭ সালে বিবিসিতে এক অবিশ্বাস্য মর্মস্পর্শী ঘটনা প্রচারিত হয়। আমেরিকার ফ্লোরিডা নিবাসী বিল কোনারের কন্যা অ্যাবে ২০ বছর বয়সে এক ছুটির দিনে সুইমিংপুলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। অ্যাবের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয় হৃদরোগজনিত কারনে মৃত্যু পথযাত্রী জ্যাক্‌ জুনিয়রের দেহে। অ্যাবের হৃৎপিণ্ড গ্রহণকারী জ্যাক্‌ সেরে উঠে; সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে থাকে। বিল কোনার আন্তর্জাতিক বাবা দিবসের প্রাক্কালে সাইকেল রাইড-এ ফ্লোরিডা থেকে লুসিয়ানা এসে তার মেয়ে অ্যাবের হৃৎপিণ্ড গ্রহনকারী জ্যাকের সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি একটা ষ্টেথোস্‌কোপ জ্যাকের বুকে রেখে তার প্রয়াত কন্যা অ্যাবের হৃৎ-স্পন্দন শ্রবণ করেন। এতে তিনি গভীরভাবে আবেগ আপ্লুত হন এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অ্যাবের দান করা হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনে কোনার অনুধাবন করেন জ্যাকের মধ্যেই তার কন্যা অ্যাবে জীবিত। এভাবে অ্যাবে ও তার পরিবার মৃত্যুপথযাত্রী জ্যাককে বাঁচাতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। মানুষের মৃত্যুর পর এর চেয়ে বড় কোন উত্তরাধিকার রেখে যাওয়া কি সম্ভব?
আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস। হৃদরোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এই দিবস পালিত হয়। এই দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য “use heart for every heart (ভাবার্থ: হৃদয়ের যত্নে হৃদয়বান হোন)”। ২০১৭ সালে অকাল প্রয়াত অ্যাবের এই অবদান অন্যের হৃদয়ের যত্নে হৃদয়বান হবার এক অপূর্ব নিদর্শন। মানবদেহের হৃৎপিণ্ড সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব সৃষ্টি। তা এমন এক অঙ্গ যা সরাসরি স্পর্শ করা যায়। যা সরাসরি শুনতে পাওয়া যায়। হৃৎপিণ্ড জীবনের প্রথম ও শেষ চিহ্ন। হৃৎপিণ্ড দিয়েই জীবনের শুরু; তা থেমে গেলেই জীবনের পরিসমাপ্তি। শরীরবৃত্ত্বীয়ভাবে তা মানদেহের অন্যসব অঙ্গকে জীবনীশক্তি তথা রক্ত যোগায় এবং লালন পালন করে। মনস্তাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় হৃৎপিণ্ড আবেগের উৎস, ভালবাসার উৎপত্তিস্থল, সাহসের ঠিকানা এবং আত্মার আশ্রয়স্থল। বিভিন্ন কৃষ্টি ও ধর্ম বিশ্বাসেও জাগতিক সব আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার সাথে হৃৎপিণ্ডের সম্পর্কের কথা উদ্বৃত হয়েছে। এটা সর্বজনীন বিশ্বাস যে মহান ব্যক্তিগণ বড় হৃদয়ের অধিকারী এবং কঠোর ব্যক্তিরা হৃদয়হীন। মানুষ হৃদয় দিয়েই ভালোবাসে। মানুষ শেষকৃত্যে যায় ভারী হৃদয়ে এবং হৃদয়ের অন্তস্তলের সহানুভূতি জ্ঞাপন করে। এভাবে এই অঙ্গের সাথে আবেগ অনুভূতি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। এসব বিবেচনায় বিশ্ব হার্ট দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য “হৃদয়ের যত্নে হৃদয়বান হোন” প্রনিধানযোগ্য।
হৃৎরোগ কেন বাড়ছে : সারাবিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণ হৃদরোগ। আবার এই মৃত্যুর শতকরা ৭০ ভাগই ঘটে বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ সমূহে। অধিকন্তু এখানে হৃদরোগ ছোবল মারে তুলনামূলকভাবে কম বয়সে যখন আক্রান্ত ব্যক্তিগণ তাদের উৎপাদনশীলতার শীর্যে অবস্থান করে। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা, কেবলমাত্র রোগের ওষুধ চিকিৎসাকে প্রাধান্য দিয়ে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা এবং এই বিষয়ে গবেষণার অপ্রতুলতা এই সমস্যাকে আরো প্রকট করে তোলে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্বের ৮০% তামাক দ্রব্য ব্যবহৃত হয় ২য় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। এটা বাংলাদেশের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। এই সব দেশগুলোকে যুগপৎ অসংক্রামক ও সংক্রামক রোগ যেমন যক্ষা, কলেরা, ডেঙ্গু, ডায়ারিয়া ইত্যাদি মোকাবেলা করতে হয়। এসব সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে হৃদরোগসহ অন্যান্য অসংক্রামক ঘাতকব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তা কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। যদিও এই অসংক্রামক রোগই এখানে মৃত্যুর প্রধান কারণ। তা ভোগান্তি ও পারিবারিক চিকিৎসা ব্যয়েরও অন্যতম প্রধান কারণ। হৃদরোগ সেবা প্রাপ্তিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিরাজমান এইসব বৈষম্য নিরসনের বিভিন্ন দিক ও তার জন্য করণীয় বিষয়াদি এবারের বিশ্ব হার্ট দিবসের প্রতিপাদ্যে গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। বিশ্বের সব জনগোষ্টির হৃৎ-স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও তার চ্যালেঞ্জ সমূহ চিহ্নিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ক্রমবদ্ধমান হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সৃষ্ট বিভিন্ন উপাদানের কারণগত সম্পর্ক সাম্প্রতিক কালে বহুল আলোচিত। বর্তমানে বায়ু দুষণকে শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে হৃদরোগ ও আনুষঙ্গিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য দায়ী করা হয়। প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৭ মিলিয়ন মানুষ বায়ু দুষণে মৃত্যুবরণ করে। হৃদরোগ তার অন্যতম কারণ। মোটরযান, শিল্প ও কলকারখানা নিঃসৃত কার্বন ও অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদান হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও রক্তনালীতে বিক্রিয়ার মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও হার্ট ফেইলিউর সৃষ্টি করে। ধূমপানের অভ্যাস সরাসরি হৃদরোগ সৃষ্টি করা ছাড়াও তা পরিবেশ দূষণ করে। এভাবে পরোক্ষ ধূমপায়ীরা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। পরিবেশ বিপর্যয়ে দিন দিন পার্ক ও খেলার মাঠ কমে যাচেছ। এতে লুপ্ত হচ্ছে সুস্থ হৃৎপিণ্ডের চাবিকাঠি ব্যায়ামের সুযোগ। জীবন যাত্রা ও খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে মানুষ প্রাকৃতিক খাবারের স্থলে ফাস্টফুডের দিকে ঝুকেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রক্রিয়াজাত, উচ্চ ক্যালরী ও চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ। এটা শিশু কিশোরদের মধ্যে প্রকট আকারে দৃশ্যমান। এতে বাড়ছে মেদবাহুল্য, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও অপরিনত বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা। ব্যক্তি পর্যায়ে মাথাপিছু আয় বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে উৎকন্ঠা, দুচিন্তা ও নিদ্রাহীনতা। প্রতিযোগিতামূলক জীবনযাত্রা কেড়ে নিচ্ছে মানসিক স্বস্তি। দীর্ঘদিন ধরে চলমান কোভিড পরিস্থিতি এবং পরিবর্তিত বৈশ্বিক অস্থিরতা আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এই সব অস্থিরতা, মানসিক চাপ, হতাশ ও বৈরীতা হৃদরোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া বিশ্বায়নের সাথে দ্রুতলয়ে ঘটে যাওয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এখানে হৃদরোগ সৃষ্টি ত্বরান্বিত করছে।
প্রতিরোধে করণীয় : এ ব্যাপারে নিম্নবণিত প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হতে পারে। এই পদক্ষেপগুলো একে অন্যের পরিপুরক হিসাবে কাজ করবে।
মাধ্যমিক স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা- সনাক্তকৃত হৃদরোগের উপযুক্ত চিকিৎসা। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার প্রভূত পরিবর্তন, আন্তর্জাতিকভাবে সুপারিশ করা ওষুধ চিকিৎসা ও ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসার মাধ্যমে হৃদরোগজনিত ভোগান্তি ও মৃত্যুহার কমানো।
 প্রাথমিক স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা- হৃদরোগে ঝুঁকি যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল, ধূমপানের অভ্যাস সম্পন্ন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাত্রার পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম ও ওষুধ চিকিৎসার মাধ্যমে হৃদরোগ সৃষ্টি প্রতিরোধ করা।
 মৌলিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা- হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলোকে সমূলে বিনাশ করা। সমস্ত জনগোষ্ঠীভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করে তাদের সচেতন করা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় উদ্বুদ্ধ করা, প্রশিক্ষিত করা। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের সাফল্য পথ প্রদর্শক হতে পারে।
উপরোক্ত কর্মসূচীগুলো বাস্তবায়নে পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক।
 পারিবারিক উদ্যোগ- হৃৎ-বান্ধব খারার তৈরী, গৃহ পরিবেশ ধূমপান ও তামাকমুক্ত রাখা। উত্তেজনা ও চাপমুক্ত শান্তির গৃহ পরিবেশ বজায় রাখা। পরিমিত ঘুম ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা। পরিবারের সকল সদস্য সদা কর্মমুখর থাকা ও ব্যায়ামের অভ্যাস করা। পরিবারের বয়স্ক ও হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকা সদস্যদের নিয়মিত চেক আপ।
 সামাজিক- কর্মক্ষেত্রে ও দৈনন্দিন জীবনে মানসিক চাপ এড়িয়ে চলা। কর্মক্ষেত্রে হৃৎ-বান্ধব খাবার পরিবেশন, ফিটনেস প্রোগ্রাম গ্রহণ, হাঁটা ও ব্যায়ামের জন্য পর্যাপ্ত খালি জায়গা, পার্ক,খেলার মাঠ নিশ্চিত করা, সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা বাইসাইকেল ওয়ে নির্মান ও সচেতনতা সৃষ্টিমূলক বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ।
 জাতীয়- পূর্বে উল্লেখিত বিভিন্ন স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন ও বাস্তবায়নে জাতীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহন আবশ্যক। এছাড়া বিনামূল্যে ঔষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যবীমা চালু করা, হৃদরোগ প্রতিরোধে গবেষনা কর্মকে উৎসাহিত করা, ধুমপান বিরোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও তা যুগোপযোগী করা ইত্যাদি।
 আন্তর্জাতিক- জাতিসংঘের ২০২৫ সালের মধ্যে হৃদরোগসহ অসংক্রামক ব্যাধির শতকরা ২৫ ভাগ কমিয়ে আনা কর্মসূচী বাস্তবায়ন, বিশ্ব হার্ট দিবসের বার্তা সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ। উন্নত বিশ্বের গবেষণা কর্ম নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ সমূহের কল্যানে প্রয়োগে ব্যবস্থা গ্রহন করা ও তাদের গবেষনায় এই দেশগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করা। হৃদরোগ সৃষ্টিতে পরিবেশ জনিত কারণ সনাক্ত করা এবং বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষায় সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণ করা।
উপসংহার- ঘাতকব্যাধি হৃদরোগের প্রকোপ ক্রমবদ্ধমান । আগামী দিনে তা আরো বাড়বে নিঃসন্দেহে। প্রতিরোধই তার একমাত্র সমাধান। আসুন আমরা নিজে সচেতন হই। অন্যকেও সচেতন করি। বিশ্ব হার্ট দিবসের সর্বজনীন আহবানে সাড়া দিয়ে আমরা আমাদের মেধা, মনন ও সহমর্মিতা দিয়ে সবার হৃৎ-সুস্থতা বিধানে ভূমিকা রাখি।
লেখক : প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ : কিশোর টুআইসি জানে আলম
পরবর্তী নিবন্ধমো. জামাল উদ্দিন