হৃদয়বিদারক

এখনো গ্রেপ্তার হয়নি সেই চালক সংকটে ৫ ভাইকে হারানো পরিবার

চকরিয়া প্রতিনিধি | শনিবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

এখনো পৃথিবীর কোন কিছুই বুঝে উঠার বয়স হয়নি তাদের। তারা জানে না ধর্মীয় রীতিনীতিও কী। এরপরও সনাতন ধর্মের বিধান মতে প্রত্যেক পুত্র সন্তানের গুরুদায়িত্ব হচ্ছে মা-বাবা মারা গেলে তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি (শ্রাদ্ধ) সম্পাদন করা। সেই অনুযায়ী অবুঝ শিশুরাই গতকাল শুক্রবার একসঙ্গে বসে ধর্মীয় কার্যাদি পালন করে। এ সময় তিন শিশু সন্তানকে (অর্ক, আয়ুষ্মান, অভি) তাদের বিধবা মায়েরা পেছনে বসে সহায়তা করছিলেন। এছাড়া অপর দুই বিধবা নিজেরাই প্রয়াত স্বামীর আত্মার সদগতি কামনায় ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্ন করেন। তন্মধ্যে গীতা সুশীল নিঃসন্তান ও দেবকীর পুত্র সন্তানের বয়স মাত্র এক মাস। পিকআপ চাপায় একসঙ্গে অনন্তলোকে যাওয়া চকরিয়ার মালুমঘাটের হাসিনা পাড়ার প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র শীলের পাঁচ সন্তানের বিধবা স্ত্রী ও সন্তানদের ধর্মীয় এই কার্যাদি সম্পন্ন করার সময় সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত পাড়ার লোকজন, আত্মীয়-স্বজনেরা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। ডুকরেও কেঁদে উঠেন অনেকে।
কাকা চিত্তরঞ্জন শীল বলেন, ‘পিকআপ চাপায় নিহত আমার পাঁচ ভাইপোর অকাল মৃত্যু হওয়ায় ধর্মীয় বিধিমতে চারদিনের মাথায় তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করতে হয়। সেই বিধানমতে গতকাল শুক্রবার তাদের অনাথ শিশু সন্তান ও বিধবা স্ত্রীরা ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্ন করেন।’ অর্থ সংকটে ব্যাহত চিকিৎসা : প্রয়াত হওয়ার দশদিন পর সুরেশ চন্দ্র শীলের পারলৌকিক ক্রিয়া। এরইমধ্যে পিকআপ চাপায় একসঙ্গে পাঁচ পুত্রসন্তান নিহত হয়। অপরদিকে এক সন্তান চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, প্রাণে বেঁচে ফেরা প্লাবন শীলের ব্রেনস্ট্রোক এবং গুরুতর আহত হীরা শীলের এক পা কেটে ফেলতে হয়। এতবড় বিপর্যয়ের সম্মুখিন হওয়া পরিবারটির পক্ষে এসব কিছুর ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। একদিকে আহতদের চিকিৎসাব্যয়, অপরদিকে ধর্মীয় বিধিমতে পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্নের ব্যয় নির্বাহ করা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে তাদের জন্য। এই অবস্থায় পরিবারটিকে বড় ধরণের আর্থিকভাবে সহায়তা করাটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই মুহূর্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত আটটি পরিবার ভবিষ্যতে কিছু একটা করতে পারেন। তা না হলে এসব পরিবারের ভবিষ্যত অন্ধকারে পর্যবসিত হবে। বলছিলেন নিহত পাঁচ সহোদরের কাকা চিত্তরঞ্জন শীল। নিহতদের মা মৃণালিনী শীল দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘একসঙ্গে পাঁচসন্তানের মৃত্যু, অপর সন্তানও প্রাণ যায় অবস্থায়। আরেক সন্তান ব্রেনস্ট্রোক করল, মেয়ে হীরার পা কেটে ফেলায় পঙ্গু হলে গেল। এতে আটটি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের পরিবারে আয় করার মতো আর কেউ থাকল না। এই অবস্থায় সংসার চালানো যেখানে কঠিন, সেখাকে তাদের চিকিৎসাব্যয় মিটবে কীভাবে? এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের প্রতি সুদৃষ্টি দেবেন, সেই আশায় রয়েছি।’
৪ দিনেও গ্রেপ্তার হয়নি ঘাতক চালক : পিকআপ চাপায় একসঙ্গে পাঁচ সহোদর নিহত হওয়ার ঘটনাটি সবার বিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে। মর্মান্তিক এই ঘটনার ইতোমধ্যে চারদিন পার হলেও ঘাতক চালককে গ্রেপ্তারের বিষয়ে মালুমঘাট হাইওয়ে থানা পুলিশের কোন তৎপরতা দেখছেন না ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। এমনকি তদন্তের কথা বলে গতকাল শুক্রবার সকালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাইওয়ে পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল হোসেন নিহতদের বাড়িতে যান। তখন তোড়জোড় চলছিল নিহতদের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার। সেই মুহূর্তে তদন্তকারী কর্মকর্তা গিয়ে শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানতে চান, চাপা দেওয়া সেইদিনের পিকআপটি কোন রঙের ছিল। তখন পরিবার সদস্য, স্বজনসহ উপস্থিত লোকজনের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি। এই অবস্থায় তদন্তকারী কর্মকর্তা অবস্থা বেগতিক দেখে সেখান থেকে চলে যান।
এতে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অনিল কান্তি শীল নামের এক স্বজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পুলিশ তো ইতোমধ্যে একটি গাড়ি জব্দ করেছে বলে দাবি করেছে। তাহলে তো তারা জানেনই গাড়িটি কোন রঙের। এর পরও এই ধরণের অবান্তর প্রশ্ন করতে আসাটা কেমন দেখায়? তিনি আরো বলেন, ‘একসঙ্গে এত সদস্যের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো। এখনো সেই ঘাতক চালককে গ্রেপ্তার করতে পারলো না। তাহলে কী আমরা ধরে নেবো, হাইওয়ে পুলিশ বসে বসে শুধু তামাশা দেখছেন। কর্মকর্তারা শুধুই বলে যাচ্ছেন, তাদের তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। অতিদ্রুত আমরা দেখতে চাই, চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
এদিকে, গত ৮ ফেব্রুয়ারি সাত ভাই-বোনকে চাপা দেওয়ার ঘটনায় হাইওয়ে পুলিশের জব্দকৃত মিনি পিকআপটিতে একটি নাম্বার প্লেট পাওয়া যায়। যার নম্বর চট্টমেট্টো-ন-১১-৪৭৪০। কিন্তু এই নাম্বারটি ভুয়া বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এমনকি গাড়ির রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ ও ট্যাঙ টোকেন কিছুরই মেয়াদ নেই। তাছাড়া ওই গাড়িটি যে চালাচ্ছিল তার কোন লাইসেন্স আছে কী-না তাও নিশ্চিত করা যায়নি এখনো। গাড়ির নাম্বার ও আপডেট কাগজপত্র ঠিক না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশের ওসি মো. সাফায়েত হোসেন। তিনি বলেন, ‘জব্দকৃত পিকআপটি বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়ে বিআরটিএকে পত্র দেওয়া হয়েছে। তাই এখনো পর্যন্ত চালকে পরিচয় বা গাড়ির মালিক শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধআইসিইউতে পাঁচ বিভাগের সমন্বয়ে চলছে রক্তিমের চিকিৎসা
পরবর্তী নিবন্ধসিএনজি ছিনতাই করতে চালক হত্যা