প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতর আহত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ৬২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহাদি আকিব। চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন তিনি। মাথায় ব্যান্ডেজ। সাদা ব্যান্ডেজের উপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দিবেন না’। নিচে একটা বিপজ্জনক চিহ্নও এঁকে দেওয়া হয়েছে। তার চোখও সাদা ব্যান্ডেজে ঢাকা।
এই ছবিটায় আটকে যাচ্ছে চোখ। দিনভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও আলোচনায় ছিলেন আকিব। এই একটি বাক্য নাড়া দিয়েছে সবাইকে। অনেকে নষ্ট ছাত্র রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে নিজেদের ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন। এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন।
গত শনিবার চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়। এই ঘটনার জের ধরে আকিবের ওপর হামলা হয়। এতে তিনি গুরুতর আহত হন।
এদিকে অস্ত্রোপচার পরবর্তী আকিবের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আইসিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রঞ্জন কুমার নাথ আজাদীকে বলেন, তার শারীরিক অবস্থা কিছুটা ইমপ্রুভ করেছে। খুলে নেওয়া হয়েছে লাইফ সাপোর্ট। এখন লাইফ সাপোর্ট ছাড়াই সে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে। রেসপন্স করছে। তবে এখনই পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না।
মস্তিস্কে অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকরা বলছেন, আকিব মাথার ডান দিকে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। অস্ত্রোপচারের পর তার মাথার খুলির হাড়ের একটা অংশ খুলে রাখা হয়েছে। ব্রেইন সোরেজিং যেহেতু বেশি ছিল তাই আর্টিফিশিয়াল ডুরামেটার দিয়ে ব্রেইনের পর্দা তৈরি করা হয়েছে। হাড়টা সেখানে দেওয়া যায়নি। দিলে ব্রেইনের ওপর চাপ তৈরি হবে। সেজন্য সেটা বের করে নিয়ে পেটের চামড়ার নিচে আলাদা একটা কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। ওখানে হাড়টা রাখা হয়েছে। পরে সে সুস্থ হলে দ্বিতীয় অপারেশন করে হাড়টি প্রতিস্থাপন করা হবে। এখন তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে ইনফেকশন না হওয়া এবং ব্রেইনের বিহেভিয়ারের ওপর (যেহেতু বড় আঘাত পেয়েছে) বাকিটা নির্ভর করছে।
ফেসবুকে আলোচনা : ফেসবুকে কোতোয়ালী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান মনসুর লিখেছেন, সব বাবা-মায়ের আশা থাকে ছেলেমেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হবে। তারা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আলোকিত মানুষ হবে। অনেকের আশা পূরণ না হলেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. মাহাদি আকিবের বাবা-মার এই আশা পূরণ হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অসুস্থ রাজনীতির বলি হয়ে সে বর্তমানে আইসিইউ শয্যায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে।
আকিবকে গত শনিবার মারাত্মকভাবে কুপিয়েছে একই সংগঠনের প্রতিপক্ষ গ্রুপের আদর্শিক সহযোদ্ধারা। গ্রুপিং, নষ্ট রাজনীতি ও অসুস্থ রাজনীতিবিদদের জেদাজেদির বলি হয়েছেন আকিব। ছাত্র রাজনীতি করেই আমার রাজনীতিবিদ হওয়া। কিন্ত হতাশ হই, যখন দেখি আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এই যুগেও বিবেক বুদ্ধিহীন রাজনৈতিক নেতাদের হঠকারিতায় আমাদের মেধাবী সন্তানদের করুণ পরিণতি। সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে আমার অভিমত, বর্তমান পরিবর্তিত আধুনিক সমাজব্যবস্থায় এই ধরনের হীন ও সস্তা রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। কাদের স্বার্থে দেশের মেধাবী ছাত্রদের বলি দেওয়া হচ্ছে? এটা এখন তদন্তের দাবি রাখে। আগামী দিনে যারা দেশ পরিচালনা করবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে, তারা কেন রামদা নিয়ে কোপাকুপি করবে? কেন ক্ষমতায় থেকেও নেতাদের অনুসারীদের পেশীশক্তির মহড়া দিতে হবে? এখন তো আর আওয়ামী লীগের দুর্দিন নয়। তাহলে নিজের ক্যারিয়ারে মনোযোগ না দিয়ে কেন বিপথে পরিচালিত হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা? বর্তমান প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কাজ হলো, গতানুগতিকভাবে আদর্শিক রাজনীতি চর্চার পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া। কুৎসিত দাবার গুটি হয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে আমাদের অবুঝ সন্তানেরা। এদের দুঃখজনক পরিণতির জন্য দায়ীদের একদিন বিচার অবশ্যই হবে।
তিনি লিখেন, কত আশা ভরসা করে আকিবকে ডাক্তার বানাতে পাঠাল তার বাবা-মা। প্রিয় প্রজন্ম সময় থাকতে বুঝতে শিখো কে আপন, কে পর। নিজেকে সস্তা না করে আত্মউপলব্ধি করো। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি পড়ে এটা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। অবিলম্বে মেধাবী আকিবের ওপর হামলাকারীদের এবং এর পেছনের কুশীলবদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক।
মহানগর যুবলীগের সদস্য মোহাম্মদ কফিল উদ্দিন লিখেছেন, আকিবের নয়, এ ব্যান্ডেজ জাতির মাথায়! আকিবের ওপর হামলা করে তারই সহপাঠীরা। সে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার মাথা থেঁতলে গেছে। তার মাথার ব্যান্ডেজেই এ লেখাটা রয়েছে, যা সহ্য করার মতো নয়। কত অমানুষ হলে এমন নির্যাতন করতে পারে? হামলাকারীদের শাস্তি হওয়া দরকার।
গণমাধ্যমকর্মী এজাজ মাহমুদ লিখেছেন, পুরো মাথা জুড়ে সাদা ব্যান্ডেজ মোড়ানো। এক পাশে গোলাকার দাগ টানা হয়েছে, সেখানে লেখা ‘হাড় নেই, চাপ দিবেন না’। মাথায় যাতে কেউ স্পর্শ না করে তাই যথারীতি আঁকা হয়েছে বিপদ চিহ্নও।
সতীর্থরা জানান, গতকাল (শনিবার) সকাল ৯টায় পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে মাহাদি আকিবকে পেয়ে ঘিরে ধরেন প্রতিপক্ষরা। গলায় রিকশার চেইন দিয়ে বাঁধা হয়। কাচের বোতল দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। রামদা দিয়ে কোপানো হয় মাথায়। পরে হকিস্টিক দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। নষ্ট রাজনীতির শিকার নটরডেম কলেজ থেকে পাস করে চমেকে সুযোগ পাওয়া এই মেধাবীর জন্য দোয়াই করতে পারি, সৃষ্টিকর্তা তাকে যেন ফিরিয়ে আনেন।