হাসান আজিজুল হক ও তাঁর ‘আগুনপাখি’

রফিক আহমদ খান | বুধবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ


১৯৩৯ সালে জন্ম নেওয়া হাসান আজিজুল হক তাঁর শৈশবে দেখা মহামারী, দেশভাগ ও যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আগুনপাখি’। ‘আগুনপাখি’তে এক নারীর মুখে চিত্রিত হওয়া গল্পগাথা লেখক নিজেই তাঁর শৈশবে দেখেছেন, অনুভব-অনুধাবন করেছেন। এই গল্প মূলত গত শতাব্দীর ত্রিশ থেকে সাতচল্লিশে দেশভাগের পর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত সময়ের দুই বাংলার মানুষের যাপিত জীবনের প্রায়-সম্পূর্ণ চিত্র। তখনকার বিশ্বরাজনীতির (বিশ্বযুদ্ধ) উত্তাপে সৃষ্ট হওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বৈশ্বিক সমস্যাসহ বৃটিশ তাড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জন করার প্রাক্বালে ধর্মের দোহাই দিয়ে ভুলভাবে দেশ ভাগের ফলাফলই এই বইয়ের দীর্ঘ কাহিনীর শেষ দৃশ্য।
বাংলা কথাসাহিত্যের শক্তিমান এই মেধাবী লেখকের সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ঠিক চৌদ্দ বছর পর ২০২০ সালের এপ্রিলে মহামারী করোনাকালের ঘরবন্ধি সময়ে প্রথমবারের মত আমাদের ছাদবাগানে আমার পাঠটেবিলে আসে আগুনপাখি। যাপিত জীবনে মহামারীর সম্মুখীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়ে মহামারী শব্দটা বই-পত্রিকার পাতায় কখনো-সখনো চোখে পড়লেও আমল করার মতো ছিল না। ২০২০ সালে সরাসরি মহামারীর সাক্ষাতে মহামারী ছঁয়ে-ছুঁয়ে গেলো সমকালের তাবৎ মানুষকে।
করোনাকালের ঘরবন্দি সময়ে যখন হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি পড়ছি তখন বইয়ের প্রথম অর্ধেক পাঠের পর পড়ছি মহামারীর করুণ বিবরণ। গত শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশের দশকের মহামারীর কথা। সেই মহামারী করোনার মতো বৈশ্বিক ছিল না। উন্নত দেশ বৃটেনের শাসনের যাতাকলে পিষ্ট হওয়া ভারত উপমহাদেশ তথা আজকের বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় ঘনঘন নানা মহামারী দেখা দিতো। চিকিৎসক, পথ্য, হাসপাতালবিহীন এই অঞ্চলের মানুষ যারা নানা মহামারীতে দুনিয়া ছেড়ে যাননি তারা কেবলই ভাগ্য ও সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বেঁচে থাকতেন।
আগুনপাখিতে বলা গল্পে এক জায়গায় বলা হয়েছে, সমাজে দু’য়েকজনের ভুলের কারণেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়। হ্যাঁ এখনো, মানে একুশ শতকে এসেও, আমাদের সমাজে গুটিকয়েক মানুষের ভুলের কারণে মাঝেমধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আগুন ধরে ওঠে। এই যেমন, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কক্সবাজারের রামু ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরের ঘটনা। কিংবা এই তো অল্প কিছু দিন আগে কুমিল্লার ঘটনা এমনই। এই অঞ্চল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অঞ্চল। এখানে সমাজের গুটিকয়েক মানুষের ভুলের কারণে কিংবা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট করার পায়তারা চলে মাঝেমধ্যে। যে কথাটি আমরা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থেও পাই। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হওয়ার ঘটনা দূর অতীতে হয়েছে; যা এখনো মাঝেমধ্যে দেখা যায়। এটা দমিয়ে রাখতে পারাটাই রাষ্ট্রকর্তাদের কৃতিত্ব বোঝাবে।
আগুনপাখির গল্পে কোনো এক কষ্ট-বেদনার শেষে সেই নারীর উক্তি, ‘মানুষের সয় না কি? সোমায়েই সবই সয়’। এটা তো সতত সত্য বচন। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে এমন শক্তি দিয়েছেন যত দুঃখ-কষ্টের ব্যাপার হোক, মানুষ একসময় সে-সব কাটিয়ে ওঠেই। পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষকে হারিয়েও অধিকাংশ মানুষ পুনরায় বেঁচে উঠে জীবন কাটায় স্বভাবজাত হাসি-আনন্দেই। মানুষ সুখ, হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-উৎসব যেমন উপভোগ করে, তেমনি দুঃখ-কষ্ট, বেদনা-গ্লানিও সয়ে যায়। এক সময় ভুলেও থাকে; কখনো কখনো জীবনগতির বাঁক বদল হয় হয়তো। কিন্তু বেঁচে থাকতে হয় নিশ্চিত মৃত্যুর অজানা সময়কাল পর্যন্ত। আগুনপাখির ভাষা প্রমিত নয়, আঞ্চলিক ভাষা। দ্বিতীয়বার পড়ার সময় সেই আঞ্চলিক ভাষাই অধিকাংশ সময় প্রমিত ভাষার মতোই গড়গড় করে উচ্চারণ করেছি। কোনো অসুবিধা বা জড়তার সম্মুখীন হইনি। লেখা আঞ্চলিক, পড়ছি প্রমিত-এ এক মজার ব্যাপার বটে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের দেশে দম্পতিরা সন্তান নেওয়া না-নেওয়ার কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারতেন না। সেই অধিকার বা সুযোগ বাঙালি নারীদের ছিল না বললেও চলে। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নারীর কোলে সন্তান এসে যেত। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিলো না তখন। সেকালের বাহন গরুর গাড়ি, গরুর গাড়িতে করে নারীরা বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় গাড়ির চারপাশে শাড়ি কাপড় বেঁধে পর্দা করা, আরো কতো কী চিত্রিত হয়েছে ‘আগুনপাখি’তে।
আগুনপাখি আমার ভালো লাগার প্রধান কারণ, গল্পের প্রতিটা অনুষঙ্গে, প্রতিটা বিষয়ে ইতিবাচকতা। যেমন গল্পের প্রধান এবং শেষ যে দৃশ্য আমরা পাই, তা হচ্ছে- গাঁয়ের একান্নবর্তী সংসারের কর্তার সহজ-সরল তেমন পড়ালেখা না-জানা স্ত্রী (যার জবানিতে এই বইয়ের গল্প) যিনি শুধু হিন্দু-মুসলিম জাতের উপর ভিত্তি করে দেশ ভাগ হওয়াটা মেনে নিতে পারেননি, নিজের মাতৃস্থান-মায়ায় ভরা ভিটেমাটি ছেড়ে ভিনদেশে যেতে পরেননি, যদিও তাঁর নাড়িছেঁড়া আদরের সন্তানেরা ও প্রাণের স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। লেখক মূলত এখানে সাম্প্রদায়িকতার কারণে যে বাংলা ভেঙে দুই দেশে ভাগ হয়েছে সেটাই তুলে ধরেছেন, এবং তা তিনি অত্যন্ত ইতিবাচক ও সুক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। এখনকার সময়ে কোনো-কোনো লেখক যেভাবে অসাম্প্রদায়িক হতে গিয়ে সরাসরি ধর্মকে আঘাত করেন, হাসান আজিজুল হক তা করেননি। এই গল্প মানুষের জন্য, দেশ-বিশ্ব মানুষের জন্য, ধর্মও মানুষেরা পালন করেন, ভুলও মানুষই করেন, কখনও ব্যক্তিগত ভুল, কখনোবা সমষ্টিগত ভুল। হয়ত সমষ্টিগত ভুলের কারণে বা সমষ্টিগত আবেগের কারণে সাতচল্লিশে দেশ ভাগে আমরা পাকিস্তানের সাথে ছিলাম। এই নারীর দৃষ্টিতে হিন্দুস্তান পাকিস্তানের পাশাপাশি বাংলা ভাষাভাষীদের নিয়ে তখন আলাদা একটা দেশ হতে পারতো। তা না-হয়ে হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ায় বহু মানুষকে মাতৃভূমি ছেড়ে ভিন দেশে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে এবং ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসতে হয়েছে। এই বিষয়টিই আগুনপাখির মূল গল্প। মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়া কোনো যুক্তিতেই মেনে নিতে পারেননি শত ঝড়-ঝাপটা সয়ে বেড়ে ওঠা এক নারী, যিনি নিজের হাতে তিলেতিলে গড়ে তুলেছিলেন কর্তার একান্নবর্তী সংসার। এতো মায়া, মমতা, ভালোবাসা, আনন্দাশ্রুতে ভরা জীবন ছিল তার যে-গাঁয়ের মাটিতে, সে-গাঁ ছেড়ে সারা জীবনের জন্য ভিন দেশে যেতে পারেননি তিনি। যদিও একজীবনের সব মায়ার মানুষ তাকে ছেড়ে চলে গেছেন! স্বজনেরা ছেড়ে গেলে অশ্রুসিক্ত প্রাণে তিনি আঁকড়ে ধরে রইলেন মাটি, মাতৃভূমির মাটি; যে-মাটিতে শুয়ে আছেন তাঁর মা-বাবা-বড় ছেলে সহ অন্যান্য স্বজন যাঁরা পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছেন এবং যাঁদের পাশে তিনিও চলে যাবেন একদিন। জীবন-রশি ধরে টানাটানি! একদিকে টেনেছেন সমকালের জীবিত সব স্বজন; অন্যদিকে মাটি, মাটিতে শুয়ে থাকা স্বজন ও এক-জীবনের স্মৃতি। সেখানে হেরেছেন স্বজনেরা, জয় হয়েছে মাটির। এখানেই আগুনপাখির গল্পের ভিন্নতা।
সবমিলিয়ে আগুনপাখি এমন একটি উপন্যাস যেখানে মানুষের এক-জীবনকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন লেখক। মাত্র দুইশো চব্বিশ পৃষ্ঠার বইয়ে তিনি এমনভাবে গল্প বলেছেন, ওই নারীর সারা জীবনের সব কথাই উঠে এসেছে। এমনকি শিক্ষার অভাব, সমাজচিত্র, অনুন্নত দেশ, বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ, মহামারী, ভাতের অভাব, অশিক্ষা, কৃষিনির্ভর জীবন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানব-সৃষ্ট দুর্যোগ, বৃটিশ শাসন, দেশ ভাগ, দেশ ত্যাগ, ডায়াসপোরা সহ বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টির দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়কে লেখক তুলে এনেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। সংক্ষেপে বললে আগুনপাখি একজন নারীর সম্পূর্ণ জীবনগাথা-ই নয় শুধু, তাঁর যাপিত দীর্ঘ জীবনকালের সামগ্রিক সমাজ-দেশ চিত্রের উপাখ্যানও বটে। আগুনপাখির তুলনা আর কোনো উপন্যাসের সাথে হয় না, হয়ত হবেও না কোনোদিন। আগুনপাখি বাংলা কথাসাহিত্যে অনন্য একটি সংযোজন। সতত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ‘আগুনপাখি’র জনক হাসান আজিজুল হকের জন্য। তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন তঁর যাপীত জীবনের সমস্ত পাঠ চুকিয়ে ; কিন্তু তিনি চির প্রস্ফুটিত থাকবেন বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রশ্নের উত্তর কে দিবে?
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে