হাসপাতাল হোক, তবে সিআরবিতে নয়

আজাদীর ফেসবুক লাইভে বক্তব্য

| রবিবার , ১৮ জুলাই, ২০২১ at ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

নগরীর ফুসফুস খ্যাত সিআরবির প্রাকৃতিক-প্রতিবেশ হুমকিতে ফেলে ৫শ শয্যার বেসরকারি হাসপাতাল ও একশ শয্যার মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত কোনোভাবে মেনে নেবে না চট্টগ্রামবাসী। সর্বস্তরের মানুষের অভিমত, চট্টগ্রামে উন্নতমানের বেসরকারি হাসপাতাল হোক, আমরা হাসপাতাল বিরোধী নই। তবে তা কোনোভাবে সিআরবিতে নয়। সিআরবি ছাড়াও চট্টগ্রামে রেলওয়ের আরো অনেক জায়গা আছে। সেসব জায়গায় বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলা হলে কেউ আপত্তি করবে না। ‘সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল : চট্টগ্রামবাসীর ভাবনা’ শীর্ষক আজাদীর ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ এ অভিমত প্রকাশ করেছেন।
গত শুক্রবার রাতে আয়োজিত এ লাইভ অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, কবি, সাহিত্যিক ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রামের সভাপতি প্রবীণ চিকিৎসক ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম ও জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আজাদীর স্টাফ রিপোর্টার রতন বড়ুয়া। রেলওয়ের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিস পাঠিয়েছে ৬টি সংগঠন। এর মধ্যে বেলাসহ ৫টি সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি এবং চট্টগ্রামের আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসানের মানবাধিকার সংগঠন বিএইচআরএফের পক্ষ থেকে আরো একটি নোটিস পাঠানো হয়।
এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, একটি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হয় আইনি নোটিস দিয়ে। তার আগের স্টেপ হলো কাগজপত্রগুলো দেখা। চট্টগ্রামের মাস্টার প্ল্যান ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান যেভাবে দেখেছি, এখানে (সিআরবিতে) হাসপাতাল স্থাপনের কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না। করোনার কারণে একটা নির্দিষ্ট সময় দিয়ে লিগ্যাল নোটিসটা দিয়েছি। আমরা মনে করি, একটু দেরি হলেও তারা একটা উত্তর দেবে। উত্তর দিক আর না দিক, তাতে কিছু অসুবিধা নেই। পরবর্তীতে কোর্ট খুললেই আমরা এ মামলাটি করবো। যদি না এর মধ্যে ঘোষণা আসে যে এখানে হাসপাতালটি হবে না।
তিনি বলেন, এখানে সুশাসনের প্রশ্ন জড়িত। যারা হাসপাতালটি গড়ে তুলবেন, তারা একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সিডিএ কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন তারা নেননি। এই স্থাপনা করতে গেলে পরিবেশগত ছাড়পত্র লাগবে, যার কোনো সুযোগ আমি দেখি না। সিডিএর অনুমতি পাওয়ারও সুযোগ নেই। যদি না সিডিএ তার আইন একেবারে সম্পূর্ণ ভেঙে-চুরে এ কাজটি করতে চায়।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আরেকটি বিষয় হলো- কার জায়গা, কার জন্য কাকে দিচ্ছে, কে দিচ্ছে, সেটাও চিন্তা করতে হবে। একটা হেরিটেজ সাইট আপনি চাইলেই প্রাইভেট এনটিটিকে দিতে পারেন না। হাসপাতালের জন্য বিকল্প জায়গা অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু এই উন্মুক্ত জায়গা আর কোথাও কি পাওয়া যাবে? কিংবা সৃষ্টি করতে পারবেন? মাস্টার প্ল্যানে এটি হেরিটেজ সাইট হিসেবে আছে। প্রয়োজনে এটিকে বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হোক। এখানকার বৃক্ষগুলোকে স্মারক বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হোক। এই এলাকার বৃক্ষের জন্য, টিলার জন্য হুমকি হতে পারে এমন কাজ আপনি করতে পারবেন না। সেটা কেউ মেনে নেবে না।
চট্টগ্রামবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তারা অল্প সময়ে আন্দোলনটা যেভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন, যেভাবে এক কাতারে শামিল হয়েছেন; এর জন্য বড় রকমের ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। আমরা আশা করছি, এটা নিয়ে আমাদের মামলায় যেতে হবে না। তার আগেই চট্টগ্রামবাসীর দাবি মেনে নিয়ে এ প্রকল্পটি এখানেই বাতিলের ঘোষণা আসবে। এটা আমার বিশ্বাস।
চট্টগ্রামের উন্মুক্ত জায়গাগুলো একের পর এক ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে মন্তব্য করে বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ যে এখন প্রাণভরে একটু শ্বাস নেবে, সে জায়গা নেই। সরকারি দুই প্রতিষ্ঠানের বিরোধে জাতিসংঘ পার্ক এখন ভাগাড় হয়ে পড়ে আছে। আউটার স্টেডিয়ামে একটুখানি মাঠ ছিল, যেখানে ছেলেরা খেলাধুলা করার সুযোগ পেত। সেটিও নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত। উন্মুক্তভাবে একটু শ্বাসগ্রহণে সিআরবি আমাদের শেষ আশ্রয়। এখন সেটাও ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে। আমরা সেটা হতে দিব না।
তিনি বলেন, আমরা বলছি- হাসপাতাল হোক। তবে তা সিআরবিতে নয়। রেলের আরো অনেক জায়গা আছে। সেখানে আপনারা হাসপাতাল করেন। আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের মুক্ত শ্বাস নেয়ার এই জায়গাটা আপনারা ধ্বংস করবেন না।
পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা শুরু থেকে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছি। কেউ কেউ বলছেন, গাছ কাটা হবে না। আবার কেউ বলছেন, গোয়ালপাড়ার দিকে এ হাসপাতাল হবে। কিন্তু গাছ কাটা হোক বা না হোক, গোয়ালপাড়ায় হোক বা যেখানেই হোক- সিআরবি এলাকায় কোনো হাসপাতাল বা স্থাপনা আমরা হতে দেব না। আমাদের সাফ কথা। প্রয়োজনে রেলওয়ের যে হাসপাতালটি আছে, তার আধুনিকায়ন করা হোক। কিন্তু এই সিআরবি এলাকায় কোনোভাবে আমরা স্থাপনা হতে দেব না। এটি নিয়ে আমরা শুরু থেকে আন্দোলন করে আসছি। প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে।
সিআরবির মতো জায়গায় এ ধরণের প্রকল্প-প্রস্তাবনা যারা তৈরি করেছেন, তাদের চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি বলেন, এটি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত। তারা কিভাবে এ ধরণের একটি প্রকল্প নিলেন। এরা কারা? তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল বা বাণিজ্যিক কোনো স্থাপনা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামের মানুষ কোনোভাবে মেনে নেবে না। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের স্বতস্ফুর্ত আন্দোলন কর্মসূচিই প্রমাণ করে এ সিদ্ধান্ত কতটা গণবিরোধী।
অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ এ বিষয়ে নিজেদের অভিমত তুলে ধরেন। তবে সবার দাবি নগরীর ফুসফুস সিআরবিতে কোনো হাসপাতাল নয়। হাসপাতাল হোক, তবে তা অন্য যে কোনো জায়গায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজিবিকে অত্যাধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা