হাসপাতাল চাই, তবে পরিবেশ বিপন্ন করে নয়

ড. আবদুল্লাহ আল মামুন | শনিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

আমি হাসপাতাল গড়ার বিপক্ষে নই। যে দেশে প্রতি দশ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র পাঁচ জন ডাক্তার, প্রতি দু’হাজার মানুষের জন্য বরাদ্দ মাত্র একটি করে হাসপাতালের বেড, যৌক্তিকভাবে সেই দেশে আরো হাসপাতাল নির্মাণ জরুরি। সমপ্রতি করোনকালের ভয়াবহতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কতটা সঙ্কটের মুখে রয়েছে আমার স্বাস্থ্যখাত। দেশের বিত্তশালীরা সাধারণতঃ বিদেশের হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। কিন্তু বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় করোনা আক্রান্ত অনেক বিত্তশালী মানুষও হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ বেড পেয়ে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন।
চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য-সেবা বৃদ্ধির জন্য আমরা আরো হাসপাতাল চাই। কিন্তু প্রয়োজন আছে বলে সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবশেকে বিপন্ন করে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে কেনো?
গাছ ও সবুজ বনাঞ্চল হচ্ছে প্রাকৃতিক শোধনাগার। মানব দেহের ফুসফুস রক্তে অক্সিজেন গ্রহণ করে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে দেয়। অন্যদিকে গাছ সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নিয়ে বাতাসে অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। সিআরবির সবুজে গিয়ে আমরা বিশুদ্ধ হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারি বলেই সিআরবিকে বলা হয় চট্টগ্রাম শহরের ফুসফুস। সিআরবির গাছের সারি যুগ যুগ ধরে কালো ধুয়োগুলো শুষে নিয়ে প্রকৃতপক্ষে বৈশ্বিক উষ্ণায়নসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় নীরবে কাজ করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর আমাদের আশেপাশে যে পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে সে পরিমাণ বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে না। গাছের অভাবে অক্সিজেন যদি দিন দিন এভাবে কমতে থাকে তাহলে একসময় কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অতিরিক্ত হারে বেড়ে গিয়ে মানব জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
চুয়েটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম শহরে প্রতি বছর ৯% হারে সবুজ বনাঞ্চল হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে স্বল্প বৃষ্টিপাতেই পাহাড়ে ঢল নামে যা কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি করে এবং বালি, মাটিতে নালা, নর্দমা, ডোবা, পুকুর ও খাল ভরাট ভরে দেয়। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশে বর্তমান বনভূমির পরিমান মাত্র ১১.২ শতাংশ।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে গাছ এবং বনাঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবকে প্রশমিত করতে পারে। একটি দশ বছর বয়সী গাছ বছরে বাতাস থেকে ২৫-৩০ কেজির কার্বণ-ডাই-অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে এবং দশটি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে বছরের পর বছর, কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর দূষণরোধ করে পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে। জাতিসংঘের বিশ্ব পরিবেশ সংস্থার তথ্য মতে, একটি বয়স্ক বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
গাছ যত বুড়ো হয় তার কার্বণ ধারন ক্ষমতা কিন্তু কমে না। বরং মাটির নিচে ছড়িয়ে থাকা শেকড়ের মধ্যে কার্বন ধারণ করে রাখে। সিআরবি এলাকাটিতে রয়েছে প্রায় শ’খানেক বড় বৃক্ষ। যার মধ্যে আছে শতবর্ষী গর্জন ও শিরীষ গাছ। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, এক একরের সম পরিমাণ বনাঞ্চল বছরে ২.৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। সেই হিসাবে কেবল সিআরবির বনাঞ্চল বছরে প্রায় ছয় শত টন কার্বন শোষণ করতে সক্ষম।
পৃথিবীর বনাঞ্চল বছরে ১৬ হাজার কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বনাঞ্চল উজাড় করে দেয়ার ফলে প্রায় ৫০% কার্বন আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসছে। ফলে বনাঞ্চলে সঞ্চিত থাকছে ৮ হাজার কোটি টন কার্বন। ২০১৯ সালে বায়ূমন্ডলে মোট ৩৬ হাজার টন কার্বন নির্গত হয়েছে। পৃথিবীর বনাঞ্চল এর কেবল এক পঞ্চমাংশ ধরে রাখতে সক্ষম। বাকি ২৮ হাজার জন কার্বন বায়ুমণ্ডলে থেকেই যাচ্ছে।
তবে এটা ঠিক, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের সবচেয়ে বেশি আসছে চীন, আমেরিকা, ইউরোপ এবং ভারতের মতো দেশগুলো থেকে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের নিঃসরণের পরিমাণ খুবই নগন্য যেমন মাত্র ০.২১ শতাংশ। কিন্তু ভয়ংকর কথা হল, বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণের পরিমান প্রতি বছর ৪% হারে বেড়ে চলেছে। তাই এখন থেকে সচেতন না হলে নিশ্চিত বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সিআরবিতে যে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট বেসরকারী হাসপাতালের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তাতে কি আম-জনতা চিকিৎসার সুযোগ পাবে? সমমানের বেসরকারী হাসপাতালের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, প্রায় ৯০% মানুষই হাসপাতালের আকাশচুম্বি খরচ দিয়ে সেবা নিতে পারবে না।
চট্টগ্রাম রেলওয়ের আরো বহু জায়গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চট্টগ্রাম শহরে। মানব সেবাই যদি মুখ্য হয়, তাহলে তেমন একটি রেলওয়ের জমিতে একটি সরকারী হাসপাতাল করা হচ্ছেনা কেনো? এছাড়া সিআরবিতে যে হাসপাতালটি রয়েছে সেটাকেও আধুনিকায়ন করা যেতে পারে। কিন্তু জনসেবার নামে যে স্বাস্থ্যবাণিজ্যের পাঁয়তারা চলছে, তা দেখে সত্যিই কষ্ট হয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী চট্টগ্রামের রেলওয়ে ভবন একটি ঐতিহ্য ভবন এবং সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে স্বীকৃত। এছাড়া সিআরবিতে বাণিজ্যিক স্থাপনা চট্টগ্রাম নগরের মাস্টারপ্ল্যানের লঙ্ঘন। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে কিভাবে সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানি না।
চট্টগ্রামে যারা বড় হয়েছেন তাদের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতিতে, ভালো লাগায় জুড়ে আছে সবুজ সিআরবি আর শিরীষ তলা। ডিসি হিলের পর এখানেই গড়ে উঠেছে সিআরবি কেন্দ্রিক একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিতে, এক মুঠো নির্জনতা উপভোগ করতে এখানে ছুটে আসেন নগর জীবনের ব্যস্ততার ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্থ মানুষ। অথচ ইতিহাস সমৃদ্ধ এমন একটি অনন্য এলাকাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে একটি চক্র। তবে আশার কথা হল, সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে দল-মত এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে যে সচেতনা তৈরি হয়েছে, তাতে আগামীতে শহরের অবশিষ্ট পাহাড় ও সবুজ বনাঞ্চলগুলো রক্ষায় সবাই সোচ্চার হবে।
সিআরবি রক্ষার দাবিকে অনেকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন। তারা বলছেন, হাসপাতালের বিরোধিতা করা মানে দেশনেত্রী শেখ হাসিনার বিরোধিতা করা। যা সত্যিই হাস্যকর এবং স্ববিরোধী। কারণ গত ৮ জুলাই জলবায়ু পরিবর্তজনিত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী সবুজায়ন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া পরিবেশ বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাদ দেয়ারও সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাই সবুজ বনানী ধ্বংস করে সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল হোক, এটা প্রধানমন্ত্রী কখনো চাইবেন না। আমার বিশ্বাস, এ নিয়ে সরকার সহসা একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন। আর রক্ষা পাবে আমাদের প্রাণের সিআরবি।
লেখক : সিডনী প্রবাসী প্রকৌশলী ও জলবায়ু গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআশাকে প্রত্যাশায় রূপান্তর করা ভুল
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে