“হাল চই দিয়ে…” এমনটি বলতেন রনিদা। কোনো কাজে একটু–সেদিক হলেই চিৎকার করে বলতেন এই সংলাপ। আর আমরা হাসতাম। রনিদাও হাসতেন। তারপর আবারও নতুন করে দেখিয়ে কাজটুকু শেষ করতেন। এই হলো সদা হাসোজ্জ্বল সুব্রত বড়ুয়া রনি।
রনিদার অনেক পরিচয়। সুরেলা, সোলস–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ড্রাম বাজাতেন। সৈকতচারী’র সাথে যুক্ত ছিলেন। অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের একজন নিবেদিত নাট্যকর্মী। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। সাংস্কৃতিক সংগঠক, সেট ডিজাইনার, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থেকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গনকে সারা বছর মাতিয়ে রাখতেন রনিদা।
২০২১ সাল চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে অনেকটা শূন্য করে দিয়েছে তিন জনের মহাপ্রস্থান। ২০২১ সালের মার্চ, এপ্রিল, মে– এই তিন মাসে লোকান্তরিত হলেন কবি, চিত্রশিল্পী খালিদ আহসান (২২ মার্চ), সাংস্কৃতিক সংগঠক আবদুস সালাম আদু (২৭ এপ্রিল) এবং সংগীতশিল্পী, চারুশিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সুব্রত বড়ুয়া রনি (২৬ মে)। তাঁদের এই চলে যাওয়ায় চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন নিঃস্ব হয়ে গেল অনেকটাই।
রনিদা এমন এক সাংস্কৃতিক সংগঠক ছিলেন, যিনি সারা বছরই নাটক, গানের অনুষ্ঠান, চিত্র প্রদর্শনী, বাংলা বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ফ্যাশন ডিজাইন, মেলা কিংবা উৎসব আয়োজনে নিত্যনতুন পরিকল্পনা করে মাতিয়ে রেখেছিলেন চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে। আদুভাই, নেওয়াজ ভাই এবং রনিদা– এই তিনজন একসাথে থাকলে যেকোনো অনুষ্ঠান জমকালো রূপ নিতো। এমন আয়োজন আমরা দেখেছি, তাঁদের সাথে যুক্ত ছিলাম বলেই আজ কেমন শূন্যতা বোধ করি। অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের সপ্তাহব্যাপী, পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানের সফল রূপকার ছিলেন এই ত্রয়ী। নেওয়াজ ভাই এখন এসবের থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছেন।
অনেক স্মৃতি আছে রনিদার সাথে। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে অরিন্দমের নাট্য উৎসবের কাজ চলছে। শুরুর আগে বলতেন, ঠিকঠাক করো কাজ। খাওয়া হবে। আমরাও নেমে পড়তাম। ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা সারা চট্টগ্রাম শহরে রাতে পোস্টার লাগিয়েছি। আদু ভাই রনিদাকে সাথে নিয়ে গাড়িতে চড়ে ঘুরে ঘুরে দেখতেন ঠিকঠাক করছি কিনা। মজার মজার কথা বলে আমাদের চাঙা রাখতেন। তারপর জম্পেশ প্রাতঃরাশ।
রনিদা আবার পূর্ণিমা রাত ও সমুদ্র সৈকত পছন্দ করতেন। কখনো আদু ভাইয়ের গাড়ি, আবার রনিদার নিজের গাড়িতে চলে যেতাম পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। আমরা ছিলাম অনেকটা নিশাচরের মতো। বকুল ভাবী ও মিতি বৌদি এজন্য আমাদের অনেক জ্বালাতন সহ্য করেছেন। এখনো মনে পড়ে এক রাতের কথা। ঘুরতে ঘুরতে এত রাত হয়ে গেল, খাবার জন্য কোনো হোটেল খোলা নেই। শেষে আবু ভাইয়ের (আবু তাহের, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, দি প্যাভিলিয়ন) মোহরাস্থ শশুর বাড়িতে গিয়ে খেলাম। রাত তখন দুইটা হবে। আবার কখনও এমনও হয়েছে না খেয়ে জোসনা দেখে আদু ভাইদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বায়েজিদস্থ মালিক রি–রোলিং মিলে গিয়ে সময় কাটিয়েছি। তো, এই হলো রনিদার পূর্ণিমা এবং সাগর পারে গিয়ে জোয়ার দেখার ইচ্ছে পূরণের কাহিনী।
অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ে রনিদা বরাবরই নেপথ্যের কর্মী। সেট ডিজাইনার, প্রকাশনা, মিউজিকের কাজ করেন। আমিও রনিদার সাথে আছি। তবে ১৯৯৪ সালে অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের মুক্তিযুদ্ধের নাটক “সাজনমেঘ” (নির্দেশনা: শিশির দত্ত। রচনা: শান্তনু কায়সার)- এ আকস্মিকভাবে রনিদার মঞ্চে অভিনয় করার সুযোগ হয়ে যায়। একজন গ্রামবাসীর চরিত্র। আর আমিও কেমন করে যেন কৃষকের ভূমিকায় অভিনয় করি। রনিদার সাথে আমারও অরিন্দমে এই একটি নাটকে অভিনয়। মৃদঙ্গ বাজিয়ে রনিদা মঞ্চে প্রবেশ করেন রনিদা। আর আমি “এই থি থি ব ব” বলে রাখালের সাজে প্রবেশ করি দলবল নিয়ে। মোরশেদ ভাই (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) ও আমি নাটকের একটা দৃশ্যে রনিদাকে বলতাম, পেন্নাম দাদা। রনিদা মাথা দোলাতেন। পরে ঐ দৃশ্য শেষে বকা দিয়ে বলতেন: ঐ, তোরারে কনে কইয়ে পেন্নাম দাদা কইবার লাই। আমরা হাসতাম। পরে রনিদাও হাসতেন। এমন টুকরো টুকরো অনেক চমৎকার অভিজ্ঞতা আছে।
রনিদা ২০২০ সালে মাছরাঙা টেলিভিশনে “রাঙা সকাল” অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। ঢাকায় যাবেন। আমারও কাজ ছিল নীনা আপার সাথে (নীনা সারোয়ার, চেয়ারম্যান, দি সারিনা)। দুইজনে একসাথে ঢাকা গেলাম। উঠলাম রনিদার মেয়ে রুম্পির বাসায়। ছোট্ট রুম্পি ততদিনে সংসারী। মেয়ের বাসায় প্রথম থাকবেন। একটু লজ্জা ছিল। যাহোক, রুম্পি আমাদের আদর যত্নের কোন ত্রুটি রাখেনি। আসলাম চট্টগ্রাম একসাথে। পথে রনিদা জানতে চাইলেন, “রুম্পি কেমন সংসারী বলো তো? পারবে তো?” বাবা হিসেবে রনিদার চিন্তা বা উদ্বিগ্ন হওয়া বড্ডো স্বাভাবিক। খুব ভালো লেগেছে সেই মুহূর্তটি। পরে মিতি বৌদিকে বলেছিলাম এই কাহিনী।
২০২০ সালে আমি ফেসবুকে অনলাইনে সরাসরি একটি অনুষ্ঠান করা শুরু করি। রনিদাকে দিয়ে যাত্রা। তখন রনিদা অসুস্থ। তারপরেও পরম ধৈর্য ধরে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। স্বাধীনতা উত্তর কালে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতকে যে কয়জন সমৃদ্ধ করেছিলেন, রনিদা তাঁদের একজন নিঃসন্দেহে। সেই সাক্ষাৎকারে রনিদা বলেছিলেন সুরেলা, সোলস গঠন কিভাবে হলো। সৈকতচারী দলটির কথাও বললেন। আজ এসব ইতিহাস হয়ে গেছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক শুক্রবার। সকালে ফোন করে বললেন রনিদা: “কী করো। ভালো লাগছে না। চলে এসো। সিআরবি শিরিষতলায় যাবো। অনেক দিন যাওয়া হয় না।” আমিও কি মনে করে ক্যামেরা নিয়ে রনিদার বাসায় গেলাম। পরে দুইজনে সিআরবি শিরিষতলায় গেলাম। আনমনে রনিদা ঘুরলেন। দেখছিলেন বড় বড় গাছ। আমি ছবি তুলতে থাকি রনিদাও বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তুললেন। এরপর আর রনিদা শিরিষতলায় যেতে পারেননি।
যে মানুষটি সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে প্রবেশ করতেন, সেই মানুষটি ২০২১ সালের ২৬ মে সকালে প্রবেশ করলেন নিথর দেহে। এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আজও মনকে বোঝাতে পারি না। যখন সাইফুল (সাইফুল আলম বাবু, তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, চট্টগ্রাম) মাইকে বলছিল: রনিদাকে এমনভাবে শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে আনবো, এটা আমাদের ভাবনারও বাইরে।” পাশে থাকা আমার মতো সকল সংস্কৃতিকর্মী নির্বাক হয়ে চোখের পানি ফেলছে। আসলেই তো, অন্তত রনিদাকে আমরা এভাবে দেখবো, বিদায় জানাবো তা কখনোই চিন্তা করিনি।
২৬ মে ২০২১ তারিখে শেষ বিকেলে রনিদাকে নিয়ে যাওয়া হলো চান্দগাঁস্থ বৌদ্ধ শ্মশানে। উদয়নদা, নাসিম ভাই, সাইফুল ও আমি দেখলাম– রনিদার অন্তিম বিদায়। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। গাছের ফাঁকে চাঁদও উঠলো। আর এমন সুন্দর মুহূর্তে রনিদা বিলীন হয়ে গেলেন মহাকাশে।
রনিদা, আপনার আত্মার শান্তি কামনা করছি। যেখানেই থাকুন, পরম শান্তিতে থাকুন।