হারিয়ে যাচ্ছে গরিবের ‘এসি বাড়ি’

কর্ণফুলী প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:২১ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতেও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী গরিবের ‘এসি বাড়ি’ খ্যাত মাটির ঘর। যদিও মাটির ঘরের ছবি গুলো উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের ডাকপাড়া ও ফকিরনীরহাট গ্রামের।

বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচিবোধে পরিবর্তন এসেছে। নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কারণে মানুষ এখন আর মাটির ঘরে থাকতে চায় না। বর্তমান বিত্তশালী প্রজন্ম বাপ-দাদার ঐতিহ্য বহনকারী মাটির ঘর ভেঙে রড-সিমেন্টের বিলাসবহুল বাড়ি বানাচ্ছে। আর যাদের অর্থবিত্ত একটু কম, তারা টিনের চালা আর বেড়া দিয়ে বানাচ্ছে ঝকঝকে ঘরবাড়ি। তবুও মাটির ঘরে আর না। মাটির মানুষ মাটি থেকে দুরে হারাচ্ছে।

অথচ পাকা ভবন কিংবা টিনের ঘরের তুলনায় মাটির ঘর বেশি আরামদায়ক। শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই এসব ঘরে নিশ্চিত থাকে আরামদায়ক বাসস্থান। কারণ প্রচণ্ড গরমেও ঘরের ভেতর থাকে তুলনামূলক শীতল। আবার তীব্র শীতে মাটির ঘরের ভেতরটা বেশ উষ্ণ থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে আগ্রহী ছিল বেশি। মাটির সহজলভ্যতা, হাতের কাছে প্রয়োজনীয় উপকরণ পাওয়া ও শ্রমিক খরচ কম হওয়া ছিল এ আগ্রহের প্রধান কারণ। যদিও তখন আধুনিকায়ন ছিলো না।

সম্প্রতি, কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কয়েকটি মাটির ঘরের দেখা মিলে ৷ এক সময় উপজেলার প্রতিটি মহল্লার বাড়িতে ছিল মাটির ঘর। প্রায় ৯০ শতাংশ ঘরই ছিল মাটির। কিন্তু সেখানে এখন মাটির ঘরের দেখা মেলাই ভার। ক্রমেই তা স্মৃতির পাতায় উঠে যাচ্ছে।

চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের প্রবীণ মুরুব্বি শাহ আলম জানান, পশ্চিম পটিয়া তথা কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়ন শিকলবাহা, বড়উঠান, চরলক্ষ্যা, জুলধা ও চরপাথরঘাটার ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে ছিল মাটির ঘর। সাম্পান আর ডিঙি নৌকা। কিন্তু এখন আর সে সব নেই। সবই স্মৃতি। আমরাও হারিয়ে যাচ্ছি দিনদিন।

বর্তমানে ওইসব গ্রামে হাতে গোনা কিছু বাড়িতে মাটির ঘর থাকলেও অধিকাংশ বাড়িতে দালান ও সেমি-পাকা টিনের ঘর। উপজেলার যেসব জায়গায় লাল মাটি ও এঁটেল মাটি পাওয়া যেত সেসব এলাকার লোকজনই বাড়িতে মাটির ঘর বানাত।

জুলধার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, লাল মাটি ও এঁটেল মাটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে পাঁক করা হতো। পরে সেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হতো ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল। প্রতিবার ১-২ ফুট উঁচু করে দেয়াল তৈরি করে ৫-৬ দিন রোদে শুকানো হতো। পর্যায়ক্রমে ১০-১২ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মাণ করা হতো। পরে দেয়ালের ওপর টিন বা ছন দিয়ে চালা (ছাউনি) দেওয়া হতো।

তারা আরও জানান, প্রতিটি ঘর নির্মাণ করতে সময় লাগত ২-৩ মাস। পরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘরের ভেতরের দেয়ালে ধানের তুষ (কুঁড়া) দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়। বাইরের দিকে দেওয়া হতো চুনের প্রলেপ বা আলকাতরা। চুনের প্রলেপ দিলে ঘরের সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি পেত, তেমনি ঝড়বৃষ্টি থেকেও রক্ষা পেত। বন্যা বা ভূমিকম্প না হলে এসব ঘর শত বছর টিকে থাকত। মাটির ঘর নির্মাণের কারিগরদের বলা হতো ‘দেয়ালি’।

খোয়াজনগরের আব্দু শুক্কুর জানান, ‘মাটির বাড়ি তৈরি করার উপযুক্ত সময় কার্তিক মাস। কারণ এ সময় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রতি হাত ৩-৪ হাজার টাকা চুক্তিতেও ঘর নির্মাণ করা হতো। মানুষ এখন আর মাটির ঘর তৈরি করে না।’

বড়উঠানের মিজানুর রহমান বলেন, আগে উপজেলার প্রতি বাড়িতেই মাটির ঘর ছিল। বর্তমানে মাটির ঘরের সংখ্যা খুবই কম। এ ছাড়া গ্রামের লোকজন এখন নানা কারণে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। তাদের রুচিবোধেরও পরিবর্তন হচ্ছে। আবার প্রবাসীরা দেশে এসে পরিবারের নিরাপত্তা ও সৌন্দর্যের কথা ভেবে মাটির ঘর ভেঙে পাকা ভবনসহ বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করছে।

কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা এড. গোলাম মওলা সুজন বলেন,’ মাটির ঘর শুধুই পূর্বপুরুষের স্মৃতি নয়। এটি বাঙালির অস্তিত্বও। কনকনে শীতে ঘরের ভেতর উষ্ণ পরিবেশ ও গরমকালে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বিরাজ করায় মাটির ঘর গরিবের কাছে যেমন আরামের তেমনি ধনীদের কাছে ছিল বিলাসিতা। তবে যুগের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে অস্তিত্ব বিলীনের পথে আজ মাটির ঘর খ্যাত ‘এসি বাড়ি।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধচোলাই মদসহ সিএনজি আটক, গ্রেপ্তার-২
পরবর্তী নিবন্ধসংস্কারাধীন কালুরঘাট সেতুতে লাইটারেজ জাহাজের ধাক্কা