কয়েকশ কোটি টাকার রপ্তানি পণ্য নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ডুবতে বসা এমভি হাইয়ান সিটি নামের বিদেশি কন্টেনার জাহাজটি অবশেষে সিঙ্গাপুরের পথে যাত্রা করেছে। একটি অয়েল ট্যাংকারের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটি দুই মাসেরও বেশি সময় পর ১ হাজার ১০৫ টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে গতকাল দুপুরে সিঙ্গাপুর যাত্রা করে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় জাহাজটি নোঙর তোলে এবং সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বাংলাদেশের জলসীমা ছেড়ে যায়। প্রান্তিক মেরিন বেঙ্গল সালভেজ নামের দেশীয় একটি উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠান বিদেশি জাহাজটি মেরামত করে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিনে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেনার নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ভিয়েতনামের পতাকাবাহী কন্টেনার ভ্যাসেল এমভি হাইয়ান সিটি। পতেঙ্গা থেকে ১৪ নটিক্যাল মাইল দূরে বাংলাদেশি অয়েল ট্যাংকার এমটি ওরিয়ন এঙপ্রেসের সাথে জাহাজটির সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে হাইয়ান সিটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ঘটনায় জাহাজটির পোর্ট সাইডে কার্গো হোল্ডে ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকে ৭ ডিগ্রি কাত হয়ে যায়। পানি ঢোকায় জাহাজটির ড্রাফট বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৭ মিটারে। ওই সময় একটি খালি কন্টেনার পানিতে পড়ে যায়। জাহাজের কন্টেনার রাখার শৃঙ্খলাও নষ্ট হয়ে যায়। জাহাজটিতে ৭১৮ টিইইউএস পণ্য বোঝাই এবং ৩৮৭ টিইইউএস খালিসহ মোট ১১০৫ টিইইউএস কন্টেনার ছিল। এতে প্রায় ৮শ কোটি টাকার রপ্তানি পণ্য ছিল, যার অধিকাংশই তৈরি পোশাক। জাহাজটি নিয়ে বিশ্বের শিপিং সেক্টরে শঙ্কা তৈরি হয়। তৈরি পোশাক আমদানিকারক ইউরোপ, আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলোও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহাজ জাহাজটি উদ্ধার করে মেরামত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দেশীয় জাহাজ উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠান প্রান্তিক মেরিনের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন এবং উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করে বিষয়টি নিয়ে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেন। পরে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ১৭২ মিটার লম্বা এবং ১০.৭ মিটার ড্রাফটের জাহাজটিকে বন্দর চ্যানেলে প্রবেশ করিয়ে মেরামত করানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ের একটি ডক ইয়ার্ডের জেটিতে জাহাজটিকে বার্থিং দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জেটির সামনে নদী ড্রেজিং করে ড্রাফট বাড়ানোর পর শক্তিশালী টাগ বোটসহ প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে জাহাজটিকে চ্যানেলে নিয়ে আসা হয়। প্রান্তিক মেরিনের পক্ষ থেকে জাহাজটি উদ্ধার করে ভিতরে আনা হলে পুরো কার্যক্রম নিবিড় মনিটরিং করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
দুর্ঘটনার ২০ দিন পর জাহাজটিকে ৪ মে ডক ইয়ার্ডের জেটিতে বার্থিং দেয়া হয়। পরদিন প্রান্তিক সালভেজ জাহাজটি মেরামতের কাজ শুরু করে। শুরুতে জাহাজের কার্গো হোল্ড থেকে পানি ফেলে দিয়ে জাহাজটির ড্রাফট কমানো হয়। পরে কন্টেনার নামিয়ে ড্রাফট আরো কমানো হয়। এরপর ছিদ্র হয়ে যাওয়া কার্গো হোল্ডের ভিতরে-বাইরে নতুন প্লেট লাগিয়ে জোড়া দেয়া হয়। ১৯ জুন পর্যন্ত জাহাজটির মেরামত কার্যক্রম চলে।
মেরামত কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের পর বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গতকাল জাহাজটি কন্টেনারগুলো নিয়ে সিঙ্গাপুর যাত্রা করে। এ সময় কান্ডারি-১ ও কান্ডারি -৩ সহ শক্তিশালী টাগবোটগুলো জাহাজটিকে পাহারা দিয়ে বন্দর চ্যানেল পার করে দেয়। বেলা দেড়টা নাগাদ জাহাজটি কর্ণফুলীর মোহনা অতিক্রম করে। সন্ধ্যা ৭টায় জাহাজটি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমা পার হয়ে গেছে বলে বন্দর কন্ট্রোল রুম সূত্র জানিয়েছে।
জাহাজটির উদ্ধারকারী এবং মেরামতকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠান প্রান্তিক সালভেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার গোলাম সারওয়ার আজাদীকে বলেন, এটি অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা সুষ্ঠুভাবে জাহাজটি উদ্ধার এবং মেরামত করে পাঠিয়ে দিতে পেরেছি। এটি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, বিদেশি জাহাজটির বিদেশ যাত্রা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য স্বস্তির। জাহাজটি বড় ঝুঁকিতে পড়েছিল। এটির মেরামতও অনেক কঠিন ছিল। আমরা সবকিছু ঠিকভাবে করতে পেরেছি। এটি আমাদের জন্য অনেক বড় সান্ত্বনা।
অপর একটি সূত্র জানায়, জাহাজের বিদেশি মালিক বন্দর কর্তৃপক্ষ, ডক ইয়ার্ড এবং সালভেজ কোম্পানির যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করে জাহাজটি নিয়ে গেছে।