পুরোপুরি না হলেও গণেশ বেশ কিছুটা উল্টে গেল। সবাই ধরে নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির ভরাডুবি হবে, দেশজুড়ে উঠবে ‘রেড ওয়েভ’ বা ‘লাল ঢেউ’, অর্থাৎ বিরোধী দল, রিপাবলিকান পার্টির হবে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টোরি’, বিজয় অবধারিত। এমন কী ডেমোক্রেটিক পার্টিও ধরে নিয়েছিল তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু না, তেমনটি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা গেছে যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলই সব সময় মধ্যবর্তী নির্বাচনে হারে। সেটি দেখা গেছে বিল ক্লিনটনের সময়, দেখা গেছে বারাক ওবামার সময় এমন কী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ও। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান- এই দুই দলের নির্দিষ্ট সমর্থক গ্রুপ থাকলেও নির্বাচনী ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করে সুইং-ভোটার বা দোদুল্যমান ভোটারদের উপর। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার দুই বছর পর এই মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আর প্রায় সময় দেখা যায় এই দুই বছর শাসনকালীন সময়ে ক্ষমতাসীন দল ও প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা কমতির দিকে থাকে। আর তা হয়ে থাকে দেশের মন্দা অর্থনীতি ও নানা ইস্যুকে ঘিরে প্রেসিডেন্টের নেয়া পদক্ষেপের কারণে। দুই বছর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হবার পর বাইডেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কল্যাণে বেশ কিছু তড়িৎ পদক্ষেপ নেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে এসেছিলেন। ক্ষমতায় বসে প্রথমে জো বাইডেন ফিরে যান সেই চুক্তিতে। দেশে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেন, পরিবেশ-বান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে পদক্ষেপ সহ বেশ কিছু কল্যাণমুলক পদক্ষেপ নেন। কিন্তু সামপ্রতিক সময় ইউক্রেন পরিস্থিতিকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি, বাড়ির মর্টগেজ, পেট্রোল ও নিত্য পণ্যসামগ্রীর মূল্য বেড়ে গেলে তার জনসমর্থন দ্রুত কমতে থাকে। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে তার জনপ্রিয়তা ৪০% শতাংশের নিচে কমে আসে। সবাই এমন কী ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা ও দলের সদস্যরাও ধরে নিয়েছিলেন এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে। লাল রংয়ের প্রতীক নিয়ে বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টির ভূমিধস জয় হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে দেখা গেল ডেমোক্রেটিক পার্টি অত্যন্ত ভালো ফল করেছে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে সিনেটে তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যদিও বা তাদের হাউজ অব রিপ্রেসেন্টেটিভস-এ সংখ্যাগরিষ্টতা হারাতে হয়েছে স্বল্প ব্যবধানে। যুক্তরাষ্ট্রের বিগত ৬০ বছরের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন কোন দলের এমন বিজয় হয়নি। ফলে এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠেছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মুখে।
২) অন্যদিকে এই নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে ডোলান্ড ট্রাম্পের। প্রেসিডেন্ট পদ হারানোর পরও এখন অবধি রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে তার (ট্রাম্প) একছত্র আধিপত্য। দলের বাঘাবাঘা নেতারা তার বিরোধিতা করবেন, তার অন্যায় আচরণ, কথাবার্তার সমালোচনা করবেন তেমন সাহস নেই। মধ্যবর্তী নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীদের উপেক্ষা করে তিনি তার নিজ পছন্দের প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। নির্বাচনের আগে তিনি বড় গলায় বলেছিলেন এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির জয়ে দেশজুড়ে ‘লাল ঢেউ’ উঠবে। রিপাবলিকানরা ধরে নিয়েছিলেন যে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জনপ্রিয়তা হ্রাস, গ্যাস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে আমেরিকানদের মাঝে যে ক্ষোভ তা তাদের কংগ্রেসের উভয় কক্ষে – সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভস-এ সংখ্যাগরিষ্টতা পেতে সাহায্য করবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ধরেই নিয়েছিলেন ‘লাল ঢেউ’ উঠবেই। আর সে কারণে তার ফ্লোরিডার বিশাল সাম্রাজ্য ‘মার-এ-লাগোয়’ আয়োজন করেছিলেন বড়সড় নির্বাচনী-জয়োৎসব। কিন্তু হলোনা। এখন রিপাবলিকান দলের অনেকেই, এমন কী কোনো কোন নেতা, যারা এতদিন ট্রাম্পের ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন, দলের এই অভাবনীয় পরাজয়ের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দোষারূপ করতে শুরু করেছেন। ভোটারদের অনেকে রিপাবলিকান পার্টির ট্রাম্পকে ক্রমাগত কাছে টানার বিষয়টা পছন্দ করেননি। দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারাভিযানে তিনি প্রার্থীর পক্ষে বক্তব্য না রেখে নিজের কথা বলে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজে প্রার্থী হবার ইঙ্গিত দেন। (ইতিমধ্যে তিনি ঘোষণা দেন যে তিনি ২০২৪ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন)। এক জরিপে দেখা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে ৫৮% শতাংশ ভোটারই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। মাত্র ৩৯% তার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। আমেরিকা জুড়ে ট্রাম্পের একটি বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে যারা তার অন্ধ সমর্থক। তার এই বিশাল ভোট ব্যাংকের কারণে দলের বড় বড় নেতারা এতদিন তার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, পাছে তারা আগামী নির্বাচনে তাদের আসন হারান। এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল ‘ট্রাম্প কার্ড’ খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। উল্টো দলের বিরুদ্ধে গিয়ে ট্রাম্প যে সমস্ত প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন তাদের বেশির ভাগ নির্বাচনে হেরেছেন। প্রশ্ন- তাহলে কি ভোটাররা ট্রাম্পের ২০২০ সালের নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এই ধরনের অভিযোগ যে কতটুকু মিথ্যা-নির্ভর তা টের পেতে শুরু করেছেন?
৩. প্রশ্ন- জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন নিন্মগামী তখন ইতিহাসকে উল্টিয়ে তিনি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন কী করে? এর পেছনে কি কেবল ডোনাল্ড ট্রাম্প? না। ট্রাম্পের ভূমিকা ছিল বটে তবে নারী ও তরুণ ভোটারদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভোট-প্রার্থী বাছাইয়ে দেশের অর্থনৈতিক উদ্বেগ তাঁদের প্রভাবিত করেনি। তারা চাননি সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুগত প্রার্থীরা জয়ী হয়ে দেশের আইন বদলাক। তাঁরা গর্ভপাত অধিকারেরও সুরক্ষা চেয়েছেন। গর্ভপাত বিষয়টি এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি বছরের জুন মাসে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক গর্ভপাত অধিকার-সংশ্লিষ্ট আইন বাতিল করে দিলে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থন বাড়তে থাকে। বিপুল সংখ্যক ভোটার নিবন্ধিত হতে থাকেন যারা তাদের সমর্থন বাড়িয়ে দেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতি। কেননা এই দলটি গর্ভপাত অধিকার সংরক্ষণের কথা বলেছিল। মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোটারদের বিরূপ মনোভাব থাকলেও গর্ভপাত ইস্যুতে তারা ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীদের ভোট দেন। তারপর রয়েছে সুইং-ভোটার বা দোদুল্যমান ভোটার- এক জরিপে দেখা যায় তারা রিপাবলিকান দের চাইতে ডেমোক্রেটদের ৪৯ থেকে ৪৭ শতাংশ ব্যবধানে ভোট দিয়েছেন এবং এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নারী ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
৪. মধ্যবর্তী নির্বাচনে আশানুরূপ জয় অর্জনে ব্যর্থ হবার পর রিপাবলিকান দলের নেতারা এখন নতুন করে দলের নেতৃত্বকে সাজানোর কথা বলছেন। তাদের কেউ কেউ এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে মুখ সরিয়ে নেবার মতো কথাবার্তা উচ্চারণ করছেন। কিন্তু দলের কাঁধে যে ভূত চেপে বসে আছে তাকে এত সহজে সরানো যাবে বলে মনে হয় না। ট্রাম্প ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। এদিকে দলের অনেক নেতা, এমন কী রিপাবলিকান দলীয় সমর্থকদের অনেকে ট্রাম্পের পরিবর্তে প্রার্থী হিসাবে ফ্লোরিডা থেকে বিপুল ব্যবধানে নির্বাচিত গভর্নর রন ডি সেন্টিসের কথা বলছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দলের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তা টের পেয়ে ক্ষেপেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই প্রসঙ্গে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, “এখন রন ডি সেন্টিস ‘গেইম’ খেলছেন। ফেইক নিউজ (মিডিয়া) ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনী দৌড়ে যোগ দিলে তিনি (রন ডি সেন্টিস) তাতে যোগ দেবেন কিনা এই প্রশ্ন করলে, রন ডিসেন্টিস বলেন, ‘আমি কেবল গভর্নর দৌড়ে মনোনিবেশ করেছি, আমি আগামীর দিকে তাকাচ্ছি না। আনুগত্য ও ক্লাসের বিবেচনায় এটি সঠিক উত্তর নয়।” অর্থাৎ ট্রাম্প চেয়েছিলেন, রন বলুক যে ট্রাম্প নির্বাচনে দাঁড়ালে তিনি দাঁড়াবেন না। রণ ডিসেন্টিসের কথায় তিনি দাঁড়াতেও পারেন সেই আভাস ছিল। আর সেখানেই ট্রাম্পের ক্ষোভ। এখন দেখা যাক দল ও দলের নেতারা পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেন। এতদিন তারা ধরে নিয়েছিলেন ট্রাম্প তাদের তীরে ভিড়তে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু এখন টের পেতে শুরু করেছেন, ট্রাম্প তাদের দলের জন্য বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়। এখন এই বোঝা ঘাড় থেকে তারা নামাতে পারবেন কিনা, কীভাবে নামাবেন সেটি দেখার বিষয়।
৫. এদিকে মধ্যবর্তী নির্বাচনে আশাতীত সাফল্য অর্জন করায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নতুন শক্তি সঞ্চয় করেছেন বলে মনে হয়। ২০২৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কিনা সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আগামী বছরের শুরুর দিকে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’ দলের অনেকেই মনে করেন বয়সের কারণে তার ২০২৪ সালে তার নির্বাচনে না দাঁড়ানোই উত্তম। কেননা ২০২৪ সালে তার বয়স হবে ৮২। তখন নির্বাচনে তার বয়স হয়ে দাঁড়াবে একটি বড় ইস্যু, যা নির্বাচনী ফলাফলে ডেমোক্রেটিক দলের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকের আশংকা। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে জো বাইডেন আমেরিকার ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট