ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১৯ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ

মহান স্রষ্টার অপরিসীম কৃপায় মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম-মহান মুক্তিযুদ্ধ-যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে নানামুখী বৈশ্বিক ও দেশীয় চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র-বিরূপ কটূক্তি সংহার করে বাঙালি জাতি ও জাতিরাষ্ট্রকে সংকটমুক্ত রেখেছেন। প্রবল আত্মবিশ্বাস-আত্মপ্রত্যয়ের ভিত্তিতে দৃঢ়চেতা বঙ্গবন্ধু প্রগাঢ় মেধা-প্রজ্ঞার উৎকর্ষতায় মানব ও প্রকৃতিসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপনে সার্থক হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মহামন্দার পূর্বাভাসে টালমাটাল বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের সরকার প্রধান হিসেবে দেশবাসীর জীবন-জীবিকার সচলতা নিশ্চিতকল্পে আশাজাগানিয়া বক্তব্য প্রদান করে শুধু হতাশামুক্ত নয়; কর্মমুখী মানুষকে অধিকতর কর্মযোগী হওয়ার অত্যধিক উৎসাহ-উদ্দীপনা নির্মাণ করে চলছেন। এটি সর্বত্রই গ্রহণযোগ্য যে হতাশাগ্রস্ত জাতি কখনোই অন্ধকারকে নিধন করে আলো প্রজ্বলনের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে পারে না। ‘ইনশাআল্লাহ দেশে কোন দুর্ভিক্ষ হবে না’ বক্তব্য দিয়ে তিনি আপামর জনগণের মনোবলকে জাগ্রত রাখার যে পবিত্র দায়িত্ব পালন করছেন তা প্রকৃত অর্থেই তাৎপর্যপূর্ণ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে জোরালো খাদ্য সঙ্কট বা দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে। তাদের ভাষ্য মতে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ তথা- ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া এবং সাউথ সুদানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রবল। শুধু এশিয়া-আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকা নয়; ইউরোপেও বাড়ছে সঙ্কট। সংস্থাগুলো যুদ্ধ ও নানা ধরনের সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে বন্যা-খরা-অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টিতে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস, সার-ডিজেলসহ কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এফএওসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার প্রক্ষেপণে পুরো বিশ্বে চলতি বছর খাদ্যশস্য উৎপাদন কমার সম্ভাবনা রয়েছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য উৎপাদন কমবে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের বাকি সব মহাদেশ-অঞ্চলেই খাদ্যশস্য উৎপাদন কম-বেশি হারে কমবে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে অক্টোবর থেকে বিশ্বব্যাপী ধানের উৎপাদন কম হবে। তন্মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ভিয়েতনামসহ প্রধান প্রধান খাদ্য রপ্তানিকারক দেশসমূহ।
জাতিসংঘের সমীক্ষাতেও বিশ্বময় খাদ্য সংকটের ভয়াবহ চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। সমীক্ষা মতে, বিশ্বের সাড়ে ৩৪ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। শুধু না খেতে পেয়ে বিশ্বে প্রতি চার সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি মানুষ দিনানিপাত করছে অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরিপেও খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবী, কেবল খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্য সংকট তৈরি হয় না; এর জন্য খাদ্য বন্টনের অসামঞ্জস্যতাসহ নানা সমস্যাই দায়ী। ৫ নভেম্বর ২০২২ গণমাধ্যম সূত্রমতে, সংকট সমাধানে ইতিমধ্যে ২৫টি দেশ নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে ৬৪টি পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। পণ্যগুলোর মধ্যে- ডাল, গম, ময়দা, সার, সবজি, ফল, চিকিৎসাসামগ্রী, মিনারেল ওয়াটার, ভোজ্যতেল, মাংস, মাছ ইত্যাদি অন্যতম। অনেক দেশের নিষেধাজ্ঞা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকলেও কোন কোন দেশ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিয়ে গেছে।
১৯৪৩ সময়ে বাংলা আরেকটি বৃহৎ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। ১৯৩৮ সন থেকে লাগাতার ফসলহানি-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আরও কিছু ধ্বংসাত্মক ঘটনা বাংলাকে দুর্ভিক্ষে নিপতিত করে। জাপানিদের দ্বারা বার্মার পতন ঘটায় সেখান থেকে খাদ্যশস্যের আমদানি বন্ধ, যুদ্ধাবস্থার কারণে পূর্বাঞ্চলে খাদ্যশস্যের বাণিজ্য ও চলাচলে বিঘ্ন, প্রাদেশিক-জেলাভিত্তিক কর্ডন প্রথার কারণে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চলাচল বন্ধ, সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং শরণার্থী আগমন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষকে বেগবান করে। যুদ্ধের শুরুতে মনুষ্যসৃষ্ট সঙ্কট মোকাবেলায় প্রশাসনের দূরদৃষ্টিহীনতা দুর্ভিক্ষকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। প্রায় সমগ্র বাংলায় এ দুর্ভিক্ষ আঘাত হেনে মোট ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭০ দশকের প্রথমে বাংলাদেশকে ঘূর্ণিঝড়-খরা-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতি এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য-সার-তেলসঙ্কটের মোকাবেলা করতে হয়েছে। সর্র্বোপরি মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও সামাজিক বিপর্যয়ে দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী হয়। সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পিছিয়ে পড়ে। এ চরম অবস্থার শিকার হয়েছিল শিল্প শ্রমিক, ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষি শ্রমিক এবং নিম্ন বেতনভুক্ত মানুষ। ১৯৭৩ সালে তেল সঙ্কটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে সরকারের পক্ষে খাদ্য আমদানি দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। অধিকন্তু পরাজিত শক্তির দেশীয়-আন্তর্জাতিক চক্রান্তে যথাসময়ে খাদ্যশস্যের সরবরাহকে বাধাগ্রস্ত করে বাজারে চালের অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য, স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণে সমস্যা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী বিশ্ব সম্প্রদায়ের অসহযোগিতা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা আরও জটিল করে তোলে।
১১ নভেম্বর ২০২২ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুবলীগের মহাসমাবেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশে ইনশাআল্লাহ কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না। তার জন্য আমাদের এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী। বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করলেও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’ দেশের আর্থিক পরিস্থিতির বর্ণনায় তিনি জানান, রিজার্ভ জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হচ্ছে। দেশের টাকা দেশেই থাকছে। যারা বলেছিল দেশ শ্রীলঙ্কা হবে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে। দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আজ রিজার্ভ আমাদের কাজে লাগছে, কারণ আমরা করোনার টিকা দিয়েছি। আমাদের খাবার-তেল সবকিছু বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে। তারপর দুই বছর পর যখন বিশ্ব উন্মুক্ত হয়েছে তখন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এসেছে। আমাদের রিজার্ভ তো ব্যবহার করতেই হবে। আট বিলিয়ন আমরা আলাদাভাবে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছি। রিজার্ভ জমিয়ে রাখলে তো হবে না। সে টাকা কাজে লাগাতে হবে।’
১৪ নভেম্বর ২০২২ মন্ত্রী পরিষদের নিয়মিত বৈঠকেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনার ধাক্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং চীনের পণ্য আসা কমে যাওয়ার কারণে ২০২৩ সালে সম্ভাব্য সঙ্কট মোকাবিলায় ছয়টি নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনাগুলো হচ্ছে- খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বিদেশে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা, খাদ্য মজুত ঠিক রাখা এবং খাদ্য আমদানিতে উৎসে কর বাদ দিয়ে আমদানিকারকদের স্বস্তি দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ। তিনি বিভিন্ন শস্যের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন এবং থার্ড পার্টির কাছে না গিয়ে সরাসরি বিদেশ থেকে খাদ্যপণ্য কেনার পরামর্শ দেন। এছাড়া বিগত কয়েক মাস আগে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সীমিতকরণ, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাসকরণ, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সে নগদ সহায়তা প্রদান, বিলাসবহুল পণ্যে করারোপ করা, পতিত জমি ন্যূনতম অনাবাদি না রেখে সকল প্রকার খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সরকারের বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগ-নির্দেশনা ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে সর্বত্রই সমধিক প্রশংসিত হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরাও অর্থনৈতিক মহামন্দা-খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ এড়াতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য আমদানি কমালে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট থেকে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব বলে তারা মন্তব্য করেন। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে চলমান কর্মসংস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কুটির-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পকে চাঙা রাখার পদক্ষেপ নেওয়ারও প্রস্তাব দেন। একই সাথে সার, চাল, গম সংগ্রহ করার সুপারিশ করেছেন।
প্রাসঙ্গিকতায় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশের খাদ্যের খুব বেশি সংকট হবে না। কৃষি উৎপাদনে জোর এবং দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্যের বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাহলে বড় ধরনের ধাক্কা বাংলাদেশে আসবে না। কেননা শীতে দেশে সবজি, ধান, গমের উৎপাদন বেশি হয় বলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার খাদ্য নিয়ে স্বস্তিতে থাকবে। এপ্রিল মাসে ইরি আসলে তখনও সরবাহ বাড়বে। সংকটটা হতে পারে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। এর জন্য আমদানি বা মজুত প্রয়োজন।’ সামগ্রিক বিবেচনায় এটুকু দাবি করতে কোন সংশয় নেই যে অতীতের মত দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে কথিত পুঁজিবাদী বিশ্বের কতিপয় রাষ্ট্রের কদর্য এজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত দেশীয় বর্ণচোরাদের নানা অপপ্রচার বা বিভ্রান্তি সৃষ্টির সকল অপচেষ্টা ব্যর্থ হবেই। তুলনামূলক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান; বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে দেশের প্রাণস্পন্দন হিসেবে বিবেচ্য কৃষকসমাজ অনেক বেশি আধুনিক চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ এবং তারা সচেতনভাবেই সম্ভাব্য সকল সংকট মোকাবিলায় যথাসময়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করবেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধঅবশেষে ঢাকায় এলেন নোরা ফাতেহি