হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

ম্যান প্রপোজেস, বাঁ গড ডিসপোজেস
কথায় আছে, ‘ম্যান প্রপোজেস, বাঁ গড ডিসপোজেস’ অর্থাৎ ‘মানুষ পরিকল্পনা করে বটে, কিন্তু কীভাবে তা ঘটবে তা নির্ধারণ করেন সৃষ্টিকর্তা’। অনেক পাঠকের এই অতি প্রচলিত প্রবাদটি জানা থাকলেও অনেকে হয়তো জানেন না যে ইংরেজ চিত্র শিল্পী স্যার এডুইন লেনসিয়েরের ১৮৬৪ সালে আঁকা একটি বিখ্যাত তৈলচিত্রের শিরোনাম ছিল এটি- ‘ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস’। মূল ল্যাটিন শব্দাবলী, ”Homo proponit, sed Deus disponit’ থেকে এটি নেয়া। পেইন্টিংটি বর্তমানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে (রয়্যাল হলোওয়ে কলেজ) সংরক্ষিত আছে। এই চিত্রকর্মে দেখা যায় উত্তর মেরুতে বরফের আঘাতে ধসে পড়া একটি জাহাজ, যার পাল ভেঙে গেছে, ছিড়ে পড়ে আছে বৃটিশ পতাকা এবং দুটি ধূসর রঙের ভালুকের একটি আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে ডাকছে, অন্যটি ছেঁড়া পতাকা নিয়ে টানাটানি করছে। ছবিটি দেখে তেমনটি মনে হলো। আমার ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক নাও হতে পারে। মজার ব্যাপার হলো এই চমৎকার পেইন্টিং ঘিরে রয়েছে কুসংস্কার আর অন্ধ-বিশ্বাস, এই ইউরোপেও। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ধারণা কেউ যদি এই চিত্রকর্মটি দেখে পরীক্ষায় বসে তবে তার কপালে নির্ঘাত ফেল। উনিশশো বিশ- উনিশশো ত্রিশ দশকে এক ছাত্র তার পরীক্ষার খাতায় ‘পোলার-বিয়ার্স মেইড মি টু ডু ইট’ লিখে ভালুকের চোখে কলম ছুঁড়ে মেরেছিল এবং পরে আত্মহত্যা করেছিল। অবশ্য এই ব্যাপারে তেমন কোন রেকর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বা ছবির গ্যালারিতে নেই। এই বিশ্বাস দৃঢ় হতে থাকে যে পেইন্টিংটি ‘অলুক্ষণে’ এবং পরীক্ষার সময় তা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ১৫৮৮ সালে স্প্যানিশ আর্মাডার বিরুদ্ধে এলিজাবেথান ইংল্যান্ড প্রোটেস্টান বিজয় উপলক্ষে ডাচরা একটি স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করে, তাতে এই শব্দাবলী ‘ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস’ খোদাই করা ছিল। এতো গেল পুরনো দিনের কথা। ফিরে আসি বর্তমানে। এতকথা লেখার পেছনে কারণ হলো- দেশ থেকে হল্যান্ড বেড়াতে আসা বন্ধু ড. সেলিম চৌধুরী ও তার স্ত্রী জেবুন্নেসা চৌধুরীর পরিকল্পনা ও বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণে। ঘটনাটা কিংবা বলা চলে ঘটনাগুলি একটু খোলাসা করেই বলি। ঘটনা তো একটি নয়, কয়েকটি। যা ঘটেছে তা ছিল ভাবনা-চিন্তার বাইরে।
দেশ থেকে বছরের প্রায় সময় কেউ না কেউ আসেন এদেশে। কেউ আসেন অফিসের কাজে, কেউ ব্যবসার কারণে, কেউ বা বেড়াতে। আবার অনেকে আসেন তাদের সন্তান-নাতি-নাতনীদের সাথে মিলিত হতে। মাস খানেক আগে চট্টগ্রাম থেকে এসেছিলেন বন্ধু ড. সেলিম চৌধুরী। ড. সেলিম চৌধুরী চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান হলেও তার আর একটি পরিচয় হলো তিনি বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ভূতপূর্ব মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর মেয়ে জেবুন্নেসা চৌধুরীর (লিজা) স্বামী। দুজনেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট। স্ত্রীর সহোদর মন্ত্রী। অতএব, বলা চলে তারা বেশ ক্ষমতাবান, সৌভাগ্যবান, অর্থবানও। অর্থাৎ ‘বান’ জাতীয় যত শব্দ আছে তা তাদের নামের পেছনে যুক্ত হতে পারে আমার ধারণা। ড. সেলিম সস্ত্রীক এসেছিলেন হল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তাদের দুই সন্তানের সাথে কিছু একান্ত-সময় কাটাতে। ঠিক করেছিলেন তাদের নিয়ে ইউরোপের ক’টি দেশ ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে, ‘ম্যান প্রপোজেস বাঁ গড ডিসপোজেস’। ঠিক করেছিলেন দিন কয়েক ছেলে-মেয়ের সাথে থেকে তাদের নিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরবেন। প্ল্যান করলেন তারা সবাই মিলে বার্লিন যাবেন, সেখান থেকে প্রাগ, কোরেশিয়া, সংগীতের দেশ অস্ট্রিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। পৌঁছুলেন বার্লিন। কিন্তু সেখানে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। বার্লিন শহরে, তাদের ধারণা খুব সম্ভবতঃ ‘উবারের’ টেকসিতে হোটেলে ফেরার পথে তাদের আত্মজা সুবেহ তার ছোট্ট পার্স ফেলে এসেছে, যার ভেতরে শ’ চারেক ইউরো ছাড়াও ছিল তার আই ডি কার্ড। কেবল টাকা হারালে সমস্যা ছিলনা, কিন্তু আই ডি ছাড়া তো অন্য দেশে যাওয়া যাবেনা। সাথে পাসপোর্টও নেই। ইউরোপে আই ডি (আইডেন্টিটি কার্ড) নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সহজে ভ্রমণ করা যায়। দুদিন বাদে তাদের প্রাগ যাবার কথা, হোটেল, প্লেনের টিকেট সব ফাইনাল করা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু আই ডি ছাড়া তো বার্লিনেও চলাচল করা বিপজ্জনক। অগত্যা সমস্ত প্ল্যান বাতিল এবং পুলিশে রিপোর্ট। যোগাযোগ করা হলো উবার অফিসে। ওরা জানালে, প্রাপ্তি সংবাদ পেলে জানাবে। ব্যস ওইটুকু। কোন খবর আসেনা। ধরে নেয়া হলো, ওই পার্স ‘গেছে’। তা আর ফিরে পাবার নয়। খবর দেয়া হলো বার্লিনে ডাচ দূতাবাসে। সুবেহর আই ডি ইস্যুই করা হয়েছে হল্যান্ডে সংশ্লিষ্ট ডাচ কর্তৃপক্ষ থেকে। তারা জানালে সপ্তাহ দুয়েক লাগবে নতুন আই ডি হাতে পেতে। দিন কয়েক হোটেলেই তাদের দিন কাটে, মন সবার খারাপ। বেশি সুবেহর। তার ধারণা তার-পার্স হারিয়ে যাবার কারণে বেড়ানোর সমস্ত প্ল্যান নষ্ট হয়ে গেল। হল্যান্ডে খবর নিলে সেখান থেকে আশ্বাস দেয়া হলো এই বলে, পুলিশী রিপোর্ট নিয়ে ফিরে আসতে বিমান বন্দরে কোন সমস্যা হবেনা। দু-সপ্তাহ তো আর হোটেলে বসে সময়-অর্থ নষ্ট করার কোন অর্থ হয় না। দিন কয়েক হোটেলের কাছাকাছি এদিক-ওদিক ঘুরে তারা ফিরে এলেন হল্যান্ড।
ফিরে এসে মেয়ের আমস্টারডামের স্টুডিও-ধাঁচের বাসায় তাদের দিন যায়, কিন্তু সময় কাটে না। সুমনার বারবার প্রশ্ন সেলিম ভাই অতি ব্যস্ত মানুষ, তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ের বিচার্যে কিছুটা অস্থিরমতি, কী করে মেয়ের বাসায় তিনি সময় কাটাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘এই ফাঁকে গোটা আমস্টারডাম প্রায় দেখা হয়ে গেছে। সুপারমার্কেট যাচ্ছি, শপিং মলে যাচ্ছি, ঘুরছি। আমস্টারডামে দেখার তো আর অভাব নেই। আসলেও হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে (এই নগরীর একটি ডাকনাম রয়েছে, তা হলো ‘মকুম’ গড়শঁস) দেখার জিনিষের অভাব নেই। মেয়ের বাসা রাজধানীর একেবারে সেন্টারে, বলা চলা আমস্টারডামের প্রাণভোমরা। দুনিয়ার তাবৎ পর্যটক সেখানে। কেবল ওই এলাকায় ঘুরে বেড়ালেও সময় চলে যায়। নানা দেশের, নানা বর্ণের, নানা ভাষাভাষীর, নানা আকারের নারী-পুরুষ, সামারের কারণে স্বল্প-বসনা কিশোরী-তরুণীদের এদিক-ওদিক পথচলা, আড্ডা দেয়া, দৃষ্টি কাড়ে, দেখতে মন্দ লাগেনা। আমার তো ভালোই লাগে। যারা বলেন, লাগেনা, তারা নেহায়াৎ যে মিথ্যে বলছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ ও ফটোগ্রাফার-সাংবাদিক বন্ধু তাহেরকে নিয়ে বছর কয়েক আগে যখন আমস্টারডাম ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তখন দেখেছিলাম তিনি প্রাণভরে দেখছেন, উপভোগ করেছেন। যাই হোক, ড. সেলিম চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে ইতিমধ্যে আমাদের বার কয়েক দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। হয়েছে ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া। ড. সেলিম চৌধুরীর জন্মদিনও পালন করা হলো ছোট্ট পরিসরে, ছোট্ট কেক কেটে। সেই কেকের যোগান দিয়েছিল শ্যালিকা পূরবী। থাকে আর এক শহরে। সে সন্ধ্যায় কেকের সাথে ছিল সুমনার ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মাউথ-ওয়াটারিং’ নানা-পদের খাবার। যেদিন হেগ শহরে এলেন বেড়াতে তাদের সাথে আমারও ঘোরাঘুরি হলো- ডাচ রাজার রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস। যেইনা উত্তর সাগর পাড়ের কাছাকাছি পৌঁছি, শরীর বেঁকে বসে ড. সেলিমের গিন্নীর। উত্তর সাগর আর তাদের দেখা হলো না একেবারে কাছে গিয়েও। প্রায় সন্ধ্যা তার কাটলো আমার ড্রয়িং রুমের সোফায় আঁধশোয়া অবস্থায়। ঘোরাঘুরিতে বোধ করি শরীরের উপর বাড়তি ধকল গিয়েছিল। অবশ্য রাত বাড়ার সাথে সাথে অনেকটা সুস্থ বোধ করতে থাকেন তিনি।
আইডি হারিয়ে যাওয়ায় সমস্যা হলো। সন্তান ছাড়াই তারা বেড়াতে গেলেন ভেনিস। ইউরোপ এসে ইতালির ভেনিস নগরী না দেখলে তো ইউরোপ দেখাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কত নামে পরিচিত এই নগরী- ‘কুইন অব আড্রিয়াটিক’, ‘সিটি অব ওয়াটার’, ‘সিটি অব মাস্ক’, ‘সিটি অব ব্রিজেস’ (কেবল এই ভেনিস নগরীতে ৪০০ সেতু রয়েছে), ‘দি ফ্লোটিং সিটি’, ‘সিটি অব ক্যানালস’। উপহৃদ ও নগরীর একটি অংশ ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে তালিকাভুক্ত। ঠিক হলো ভেনিস দেখবেন। তারা গেলেন। কিন্তু ওই, শুরুতে বলেছিলাম, ‘ম্যান প্রপোজেস বাঁ গড ডিসপোজেস’। নগরী দেখতে বের হয়ে ডাক্তার-গিন্নীর পা গেল মচকে। ঘোরা আর হলোনা। ফিরে এলেন আমস্টারডাম, কিছুটা ভাঙা পা নিয়ে। কিন্তু বাসায় তো বসে থাকা যায় না। হুইল চেয়ারে গিন্নি সোয়ার হলেন। কিন্তু পেছন থেকে ঠেলার জন্যে তো একজন চাই। দেশ হলে না হয় বাড়ির জনা কয়েক কাজের লোক ছিল। কিন্তু এই বিদেশ-বিভুঁয়ে! এখানে তো সে সুযোগ নেই। নিজ কাঁধে দায়িত্বটা পরম যত্নে ও ভালোবাসায় নিলেন স্বামী প্রবর ড. সেলিম চৌধুরী। মজার ব্যাপার হলো উনি যখন দেশে নিজ বাসায় যোগব্যায়াম করেন, কতবার মাথা নিচু করছেন আর উপর করছেন, তা এক, দুই, তিন করে গনার জন্যে নির্দিষ্ট আছে কাজের ছেলে। তাকে দেখলাম আমস্টারডাম সহ আরো কয়েকটি শহরে যখনি বেড়াতে গেছেন এই কর্মটি করতে। আবারো বলছি পরম ভালোবাসায়। দেখে হেসে বলি, ‘বেহেশতের দরোজা আপনার জন্য খোলা’। সোশ্যাল মিডিয়ায় হুইল চেয়ারে আসীন এই ছবি দেখে তার স্ত্রীর এক বান্ধবীর মন্তব্য- ‘না হাঁটার জন্য এই সব ভান ধরেছিস’। ওনারা ফিরে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন তাদের সাথে আমাদের কাটানো বেশ কটা দিনের হাসি-ঠাট্টা আর আনন্দে-ভরা মুহূর্ত। সেটিই পরম পাওয়া আমাদের জন্য, আমরা যারা শেঁকড় থেকে অনেক দূরে আছি, প্রবাসে। আমাদের শেকড় তো দেশে। মন যে অণুক্ষণ কাঁদে শেকড়ের জন্য, ‘শেকড় যেমন কাঁদে জলকতার জন্যে’।
কথায় আছে- ‘সব ভালো তার শেষ ভালো যার’। হল্যান্ড ফিরে আসার সপ্তাহ দেড়েক-দুয়েকের মাথায় ইউনিভার্সিটি থেকে সুবেহ মেসেজ পেলো। জানানো হলো, ভেনিস থেকে ডাকযোগে একটি প্যাকেট এসেছে ইউনিভার্সিটির ঠিকানায়, সে যেন যোগাযোগ করে। কী অবাক করা। তাতে সুবেহর হারিয়ে যাওয়া আই ডি কার্ড এবং চারশত ইউরো। সুবেহর আনন্দ আর ধরে না।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধহজরত শায়খ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দি (রহ.)
পরবর্তী নিবন্ধবর্ণচোরাদের মুখোশ উন্মোচন জরুরি