Exit the dragon enter the tiger- ব্রুসলীর বিখ্যাত ছায়াছবি। পাঠকদের অনেকেই হয়তো এই ছায়াছবি দেখে থাকবেন। শ্বাসরুদ্ধকর এই ছবি তৈরি হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। আমার মতো অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে তাতে মূল ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন তিনি হলেন বিশ্বখ্যাত মার্শাল-আর্ট মাস্টার, ব্রুস লী। কিন্তু বাস্তবে সেটি ব্রুস লী ছিলেন না। ছিলেন ‘লুক-এলাইক’ ব্রুস লী, অর্থাৎ ব্রুস লীর মত দেখতে অবিকল আর এক অভিনেতা। ব্রুস লী মারা যান এই ছবিটি নির্মিত হবার তিন বছর আগে, ১৯৭৩ সালে। যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন টোরি দলের নতুন নেতা ও দেশের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ‘এন্ট্রি’ ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সেই সরকারি বাসভবন থেকে ‘এক্সিট’-কে ঘিরে মাস কয়েক ধরে চলা ‘রাজনৈতিক-খেল’ দেখে এই ছায়াছবির কথা মনে এলো। বেচারা বরিস জনসন! এমনতো কথা ছিল না। অন্তত এইভাবে অপমানিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর কথা তার ছিলনা। কেননা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তিনি নিজ দলকে বৃটিশ ভোটারদের কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার বাগ্মীতা, ক্যারিশমা, লন্ডনের মেয়র হিসাবে তার বিগত দিনের অভিজ্ঞতা- সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন জনগণের প্রিয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বেরিয়ে আসা, কোভিডের দুঃসময় সামাল দেয়া এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়ানো ও ইউক্রেনকে সকল সমর্থন দেয়া-এই সব মিলিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কিছু বেসামাল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বক্তব্য, আমেরিকার ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত খামখেয়ালিপনা, মিথ্যে বলা, ভুল করে বারবার ক্ষমা চাওয়া এবং সবশেষে কোভিডের সময় পার্টি-কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নিয়ে বিরোধী দলের কাছ থেকে তো বটেই, নিজ দলের মধ্যেও তিনি তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হন। পার্লামেন্টের দুই বেঞ্চ থেকেই দাবি উঠে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা তিনি হারিয়েছেন এবং তাকে পদত্যাগ করতে হবে। ঠেকানোর জন্যে তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেষমেশ তাকে পদত্যাগ করতে হলো।
কথায় আছে ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’। সর্বনাশ হলো বরিস জনসনের। তিনি গদি হারালেন। কিন্তু কপাল খুলে গেল ৪৭ বছরের বরিস জনসনের অধীনে থাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রী লিজ ট্রাসের। দলীয় প্রধান আসনের লড়াইয়ে এই ইংরেজ মহিলা ভারতীয় বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক ঋষি সুনককে দলীয় সদস্যদের ভোট-যুদ্ধে হারিয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় আসীন হলেন। হলেন বৃটেনের তৃতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী। এর আগে যে দু’জন মহিলা বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তারা হলেন মার্গারেট থেচার ও থেরেসা মে। মার্গারেট থেচার ১৯৭৯ সাল থেকে একটানা ১১ বছর বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, অন্যদিকে তেরেসা মে ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেন। কিন্তু তার ভাগ্যও সুপ্রসন্ন ছিল না। ব্রেক্সিট-ঘিরে দলের মধ্যে প্রচণ্ড বিভেদ ও তর্ক-বিতর্কের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। মজার ব্যাপার হলো এই তিন নারী প্রধানমন্ত্রী কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য। বরিস জনসনের মত পলিটিক্যাল ক্যারিশমা নেই লিজ ট্রাসের, নেই বরিস জনসনের মত বিরোধী দলকে যুক্তি দিয়ে আক্রমণ করে কথা বলার কৌশল। তারপরও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনে বিরোধী দলের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে মন্দ করেননি লিজ ট্রাস। বিবিসির রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মতে শুরুতে তিনি কিছুটা ‘নার্ভাস’ ছিলেন, তবে অল্প সময়ে তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। এদিকে তার দলের কেউ কেউ তার নেতৃত্বের ব্যাপারে ‘এস্কেপ্টিক’। তাদের প্রশ্ন তিনি কি পারবেন ইউক্রেনকে ঘিরে বিরাজমান বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের সময় দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে? পারবেন কি বিশ্ব রাজনীতিতে বৃটেনের অবস্থান শক্ত করতে? তিনি তো আর ‘আয়রন লেডী’ মার্গারেট থেচার নন। মজার ব্যাপার হলো এখন লিজ ট্রাস নিজেকে মার্গারেট থেচারের আদর্শের মশালের ধারক হিসাবে পরিচয় দেন। অথচ আশির দশকে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচারের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিলেন। পরে সুযোগ ও সুবিধা বুঝে নাটকীয়ভাবে নিজের অবস্থান বদল করেন, যা পরবর্তীতে রাজনীতিতে তার উত্থানে বড় ভূমিকা রাখে।
লিজ ট্রাসের সাথে আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিবিদদের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতার মত লিজ ট্রাসকেও বার কয়েক ‘ডিগবাজি’ খেতে দেখা যায়। তিনি এখন টোরি দলের নেতা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে (অক্সফোর্ড) পড়াকালীন সময়ে তিনি লিবারেল পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সে সময় তিনি গাঁজা সেবনের বৈধতা ও ১৯৯৪ সালে লিবারেল পার্টির হয়ে বৃটিশ রাজতন্ত্র উঠিয়ে দেয়ার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, যা তার বর্তমান অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। গতকাল রাজতন্ত্রের শিরোমণি রাণী এলিজাবেথের সাথে সাক্ষাৎ করে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার ‘ডিগবাজি’ খাবার ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ব্রেক্সিটকে ঘিরে যখন ইংল্যান্ডসহ গোটা ইউরোপ উত্তপ্ত, আলোচনার পর আলোচনা চলমান, সেই সময় তিনি বৃটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে অবস্থান নেন। এই ব্যাপারে সরব হন সামাজিক মাধ্যমেও। টুইট করে তিনি লেখেন, ‘যারা ই ইউতে থাকতে চান তিনি আছেন তাদের সাথে’। এর পেছনে যে যুক্তি তিনি দেখান তা হলো, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির জন্যে এটি দরকার। কিন্তু যেই না গণভোটে বৃটেনের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ব্রেক্সিটের পক্ষে তাদের রায় দেন, লিজ ট্রাস রাতারাতি আর এক ‘ডিগবাজি’ দিলেন। বললেন, তিনি এদ্দিন ভুল ধারণা পোষণ করে আসছিলেন, ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন, কিন্তু তা ছিল তার ভুল, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার এই বারবার ডিগবাজি খাওয়ার কারণে অনেকেই তার নীতির ব্যাপারে সন্দিহান। লিবারেল পার্টি ছেড়ে টোরি দলে যোগ দেয়ায় অনেকে বিশেষ করে লিবারেল পার্টির সদস্যরা তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসাবে চিহ্নিত করতে দ্বিধা করেননি।
সময়ের সাথে ভোল পাল্টানো এই মধ্যবয়সী রমণী টোরি দলে যোগ দিয়ে প্রায় প্রতিটি রক্ষণশীল মতামতকে জোরালো সমর্থন দিয়েছেন। কথায় আছে ‘মোর ক্রিস্টিয়ান দ্যান পোপ’ অর্থাৎ ‘পোপের চাইতেও বেশি ক্রিষ্টান’। তবে স্মার্ট এই মহিলা রাজনীতিবিদ। কেউ কেউ বলেন ‘এম্বিশাস’ বা উচ্চাভিলাষী। উচ্চাভিলাষী হওয়া মন্দের কিছু না। উঁচু-অভিলাষ থাকলেই তো উঁচু-স্থানে পৌঁছানো সম্ভব। আর তা ছিল বলেই লিজ ট্রাস তিন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তাদের প্রতি অনুগত ও আস্থাভাজন ছিলেন। আস্থাভাজন ছিলেন বলেই বরিস জনসন যখন রাজনৈতিকভাবে খুব বেকায়দায়, অনেকটা কাদায় হাতি পড়ার মত, যখন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনকসহ বরিসের কাছের অনেকেই তাকে ছেড়ে চলে গেলেন, লিজ ট্রাস তার (বরিস) প্রতি বিশ্বস্ত থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসাবে শেষদিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এখন লিজ ট্রাসের জন্য যা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে তা হলো, দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ জনগণ যে সংকটের মধ্যে পড়েছে তা থেকে উত্তরণ এবং ইউরোপে জ্বালানি গ্যাসের ঘাটতির ফলে যে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে তা মোকাবেলা করা। দায়িত্ব নিয়ে তিনি দেশে কর কমানো, বর্তমান জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া, বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নেবার ব্যবস্থাসহ ভালো চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করার আশ্বাস দেন। লিজ ট্রাস সবে দায়িত্ব নিলেন। এই সমস্ত প্রতিশ্রুতি তিনি কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন সে সময় বলে দেবে। আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে তা দেখার জন্যে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট