আত্মহত্যাকে না বলুন

করবী চৌধুরী | শনিবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

‘প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে মেধাবী কলেজ ছাত্রের আত্মহত্যা’, ‘পরীক্ষায় পরপর দু’বার অংকে ফেল করায় নবম শ্রেণির ছাত্রীর বাসার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা’। ‘পিতামাতার দাম্পত্য সমস্যা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব নির্যাতন ইত্যাদিতে অতিষ্ঠ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর আত্মহত্যা’। উল্লেখ্য তিন ঘটনা ছাড়াও সংবাদপত্রের পাতায় প্রায় প্রতিদিন চোখে পড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আত্মহত্যার খবর। সবসময়ই ছিলো, কিন্তু হঠাৎ করে যেন দেশে এর প্রবণতা বেড়ে গেছে খুব! একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলেই পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সবাই বলাবলি করে, ‘মা- বাবার কথাটা একবারও ভাবলো না? শুধু নিজেকেই বড় করে দেখলো? তার সমস্যাগুলো নিয়ে আমাদের সাথে তো একটু আলাপ করতে পারতো! আমরা কি চেষ্টা করতে পারতাম না ওর মন ভালো করার? আসলে এখনকার ছেলেমেয়েদের এই এক ফ্যাশনরোগ হয়েছে, ডিপ্রেশন! আরে বাবা, ডিপ্রেশন বলে কি কিছু হয়? এটা জাস্ট imaginary concept of our mind!
মনের ভুল সব।… ইত্যাদি ইত্যাদি মন্তব্যে দু’ চারদিন চারদিকটা মাতিয়ে রেখে অতঃপর সবাই ভুলে যায়। চলে যায় আপন গন্তব্যে। পেছনে পরে থাকে সব হারানো পরিবারটির হাহাকার! ‘ডিপ্রেশন’, বর্তমানে খুবই প্রচলিত এবং জোরালো একটা শব্দ। আত্মহত্যার মূল কারণ হিসেবে মনের এই রোগটাকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়। আবার ডিপ্রেশনেরও রয়েছে বহুবিধ কারণ। সেগুলো এতটাই বিস্তৃত যে বর্ণনা করতে গেলে এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। আট থেকে আশি বছর বয়সের সকলের ক্ষেত্রেই ডিপ্রেশনের প্রভাব সমানভাবে প্রযোজ্য। আসলে আমরা কেউই কখনও কোনো মানুষের ডিপ্রেশনের মূল কারণগুলো খতিয়ে দেখি না, সবাই শুধু ফলাফল দেখতেই অভ্যস্ত।
বেকারত্বের জ্বালা ঘুচাতে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে যে হঠাৎ করে ভুল আবেগের বশবর্তী হয়ে যে কেউ আত্মহত্যার মত চরম পথকে বেছে নিচ্ছে তা নয়, খোঁজ নিলে জানা যাবে দীর্ঘদিন ধরেই তাদের মনে এই আত্মহত্যার প্রক্রিয়াটা চলছিল বর্তমানে যেটার নাম দেয়া হচ্ছে ‘ডিপ্রেশন, সেটা ভিকটিমের পরিবার- পরিজন বা বন্ধুবান্ধব কেউ আমলেই নেয়নি।
মনের এই কঠিন রোগটির শিকার কি শুধু কি তারাই? না, অনেক বড় বড় সেলিব্রিটি অথবা যারা জীবনে সাফল্যের তালিকার শীর্ষে রয়েছে তারাও নিজেকে শেষ করে দিতে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার মত এই দুঃখজনক পথটি!
‘মৃত্যু’ শব্দটা বড্ড ছোট বটে, কিন্তু এর অনিবার্যতার কথা চিন্তা করলেই আমাদের সবার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত অজান্তেই বয়ে যায়।এটা অনেককেই বলতে শুনি যে, ‘কেন ছেলেটা/মেয়েটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর মত পরিণতিকে মেনে নিল? এটা তো কোনো সমাধান হতে পারে না’! সঠিকই বলছেন বটে তারা কিন্তু বিশ্বাস করুন, যারা নিজেদের জীবন আর না রাখার এই সিদ্ধান্ত টা নেয় তারা মোটেও সেই পরিস্থিতির মধ্যে থাকে না যে, তারা ঠিক করছে নাকি ভুল করছে। যদি থাকতো তাহলে এই ভুল পথটা তারা বেছে নিত না। দীর্ঘ মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশন নিশ্চিতভাবেই তাদের সেই চিন্তাচেতনার ক্ষমতাটা বিলোপ করে দিয়েছিলো, এই সহজ কথাটা আমাদের বুঝতে হবে। এটাও অনেক ক্ষেত্রে বলতে শোনা যায় যে, ‘একটুও লড়াই করতে পারলো না লোকটা? এভাবে হেরে গেলো জীবনের ময়দানে? এতটা দুর্বলচিত্তের মানুষ ছিলো জানতাম না তো!’
এইধরনের কথাগুলো শুনলে আমার খুবই অবাক লাগে। কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন দু’জন মানুষকে চিনতাম, যারা জীবনে খুবই সফল এবং লোকচক্ষে দৃঢ়চিত্তের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তাঁরাও নিজেদের জীবনের অন্তিম পরিণতি হিসেবে আত্মহত্যাকেই বেছে নিয়েছিলেন। পরে জেনেছি, ভিন্ন ভিন্ন কারণে দু’জনেই ছিলেন চিকিৎসাধীন মানসিক অবসাদের রোগী, যা বাইরের কারো কাছে জানা সম্ভব ছিল না। তাই নিজেদের মনগড়া ‘সবল মন আর দুর্বল মন’ এর মাপকাঠিটা নাই বা চাপিয়ে দিলাম সবার উপরে!
আসলে পরিস্থিতি আর সময়ের উপরে কারোও তো হাত নেই, তাই না? কে কখন, কোনো অবস্থায় মনকে আপন গতিতে পরিচালিত করতে অপারগ হচ্ছে, তাতো আর বাইরের লোকের জানা সম্ভব নয়! তাই এই ব্যাপারে জাজমেন্টাল না হয় নাই হলাম আমরা!
আত্মহত্যার পেছনে কারণও থাকে অনেক। হতে পারে কেউ দীর্ঘদিন ধরে সাংসারিক/আর্থিক কোনো মানসিক সংকটের মধ্যে যাচ্ছে, আবার অনেক সময় এটাও হয় যে, অন্য কেউ তার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে তার নিয়মে চালিত করছে ভিকটিমকে, অথবা কোনো অপ্রাপ্তির জন্য সাময়িক আত্মহত্যার প্রবণতা, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় ‘সুইসাইডাল ইমপালস ’… এসব কিছুর জন্যই ভিকটিম থাকে গভীর মানসিক অবসাদে, আর যার ফলাফল হলো আত্মহত্যার ঘটনাগুলো। আত্মহত্যার ব্যাপারে আরোও একটা বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে ভাবলে লক্ষ্য করা যায়, একই পরিবারে একাধিক লোক একইভাবে আত্মহত্যার শিকার। সেক্ষেত্রে হয়তো পুরো পরিবারটাই মেন্টাল ডিপ্রেশনের আওতাধীন। বলা যায়, ডিপ্রেশন হয়তো বা জিনঘটিত কোনো স্নায়বিক রোগ, যা একটুখানি সচেতন হলেই চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। তবে নিরাময়ের কথাই যদি বলি, তাহলে সর্বাগ্রে আসে সচেতনতা, যা রোগীর নিজের চেয়েও অনেক বেশি বর্তায় তার পরিবার আর পরিচিতজনদের উপর।
একটা করুণ পরিণতি ঘটে গেলে বন্ধুবান্ধবদের এটা বলতে শোনা যায়, ‘একবারও আমাকে বললো না যে, ওর মনে এসব চলছে! এতটাই সমস্যায় ছিল সেটা বললে তো সাহায্য করতে পারতাম!’ তাই কী? আচ্ছা ভেবে দেখুন তো, সত্যিই কি তাকে বলার মত জায়গাটা দিয়েছিলেন তখন? আর যদি দিয়েও থাকেন তাহলে সেই মানুষটা যে বলেনি সেটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে? হতেও তো পারে, সে তার কোনো কথার মাধ্যমে তার ক্রাইসিস আপনাকে বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আপনি সেটা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন নি! মজার ছলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন! আসলে অনেক মানুষ আছেন যারা নিজেদের ভেতর চলতে থাকা আবেগটাকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। স্বভাবে যে তারা আবার অন্তর্মুখী এমনটা নয়, কথা প্রচুর বললেও মনের ভেতর কী চলছে, সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হন।যখন কেউ বলে, ‘আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না! জীবনটা মূল্যহীন হয়ে গেছে’… তখন আমরা ক’টা মানুষ তাকে মনোযোগ দিয়ে শুনি? শুনে তার মনোকষ্টটা লাঘবে এগিয়ে আসি? বরঞ্চ সেক্ষেত্রে হয়তো তাকে কিছু নীতিবাক্য শোনাই অথবা ভুলবুঝে রূঢ় আচরণ করি। যেটা তাকে আরোও গভীরভাবে মানিসিক অবসাদে ডুবিয়ে দেয়। নিজেকে তখন সে স্নেহহীন, এক গুড ফর নাথিং ভাবতে থাকে। আত্মবিশ্বাসটা তখন একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছায় তার। ফলাফলস্বরূপ, তার উপকার করার পরিবর্তে চরম অপকারটা করে বিসি সেই হতভাগ্যটার জীবনে!
তাই বলছি, কোনো মানুষ যদি আপনাকে তার ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কথা বলতে চায়, তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন প্লীজ! হতেই তো পারে যে, আপনিও কোনো সময় সেই একই পরিস্থিতিতে ছিলেন কিন্তু দৃঢ়চেতা বলে তা কাটিয়েও উঠেছেন! এই মানুষটা পারছে না, সংকটমোচনের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না! কিন্তু তাই বলে তাকে ব্যর্থ হিসেবে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা আমাদের কারোরই নেই, তাই না? আমাদেরকে বিপদগ্রস্ত মানুষটার মনের কথাগুলো শুনতে হবে, তার মনটাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যদি মনে হয় যে এসব সাধারণ সমস্যা, আর এর থেকে তাকে উৎরে নেওয়া খুব একটা কঠিন কিছু নয় সেক্ষেত্রে তাকে বোঝাতে হবে। তাকে সর্বক্ষণ সঙ্গ দিতে হবে। বোঝাতে হবে, ‘বেঁচে থাকাটা বড্ড সুন্দর’! তবে কারোও কোনো প্রসঙ্গ টেনে বা কোনো উদাহরণ দিয়ে নয়। কারণ, উদাহরণ সবসময় ভালো প্রভাব নাও ফেলতে পারে। আর যদি দেখা যায় যে সমস্যা জটিল এবং দীর্ঘদিনের, তখন তাকে চিকিৎসার পরামর্শ দিতে হবে। তবে সেক্ষেত্রেও তার পরিবারের লোকজনদের খুব মার্জিত থাকতে হবে। কারণ, মানসিক রোগের চিকিৎসা নিয়ে এখনো আমাদের দেশের মানুষদের অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়ে গেছে। মনেরও যে রোগ হয় সেটা অনেকে বুঝতেই চান না। তারা মনে করেন মনের রোগ মানে পাগল! ভিকটিমের চরিত্রে যেহেতু পাগলামির কোনো লক্ষণ নেই তাহলে সে সুস্থ। অথচ বর্তমানে রোগ হিসেবে মানসিক অবসাদগ্রস্ততাকে এক ধরনের মারণরোগ হিসেবেই আখ্যা দেওয়া যায়। তাই আত্মহত্যা ঠেকাতে ডিপ্রেশন রোগের চিকিৎসা খুবই জরুরি!
পরিশেষে এটাই বলতে চাই, মানুষের সাথে কথা বলুন, তাকে সুষ্ঠুভাবে নিজের কথাগুলো বলার জন্য একটু স্পেস করে দিন। একটু সহানুভূতিশীল হোন! বিশ্বাস করুন, যারা খুব চুপচাপ প্রকৃতির তাদেরও নিজের কথা বলার জন্য একটু জায়গা লাগে।
আমরা যদি একজন একজন করেও সেই জায়গাটা দিতে পারি আমাদের চারপাশের অবসাদে তলিয়ে যাওয়া বা ভীষণরকম মনখারাপের মধ্যে থাকা মানুষগুলোকে, তাহলে আত্মহত্যার পরিসংখ্যানটা শূন্যের কোঠায় না হলেও কিছুটা অন্তত নামিয়ে আনতে পারি। সব মানুষ সমান হয় না, সবাই দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হয় না, সবার চিন্তাভাবনাও সমান হয় না। কিন্তু আমরা সুস্থ মনের যারা আছি তারা সবাই কিন্তু ওদের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে খুব করে সহানুভূতিশীল হতে পারি। সবাই ভালো থাকুন। সবাইকে ভালো রাখুন। ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ সফল হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের ঐতিহ্য দৈনিক আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে