যেন নিঃশব্দ-চরণে চলে গেল পঁচিশে বৈশাখ
অনেকটা যেন নিভৃতে, নিঃশব্দ-চরণে চলে গেল ২৫ বৈশাখ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মদিন। কবিগুরুর ২৫ বৈশাখ নিয়ে কোন দ্বিধা বা বিতর্ক না থাকলেও তার জন্মদিনের ইংরেজি তারিখ নিয়ে কিন্তু এখনো সংশয়, বিতর্ক ও আলোচনা রয়ে গেছে। সে যে কেবল এখন হচ্ছে তা নয়, সে কবি যখন বেঁচে ছিলেন তখনও এই নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কারো কারো মতে কবির জন্ম ৬ মে, কারো মতে ৭ মে, কেউবা বলেন ৮ মে (১৮৬১ সাল)। তবে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ যে কবি গুরুর জন্মদিন এ নিয়ে কারো কোন সংশয় নেই, ছিল না। বিতর্ক আলোচনা কেবল বাংলা সনের ওই দিনের ইংরেজি তারিখকে ঘিরে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে দিনটি ইংরেজি পঞ্জিকার হিসাবে ছিল ৬ মে ১৮৬১ সাল। কিন্তু রাত ১২টার পর তার জন্ম হয়েছিল বলে স্বাভাবিকভাবে ধরা হয় ৭ মে। পরবর্তীতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ক্যালেন্ডারে সংশোধনের কারণে ইংরেজি তারিখটি আরো একদিন পিছিয়ে যায়, হয় ৮ মে। কবির জন্মদিন ইংরেজি তারিখ নিয়ে বিতর্ক, সংশয়, আলোচনা রবি ঠাকুরের জীবদ্দশায়ও কম হয়নি এবং তিনি যদ্দুর জানি এই ব্যাপারে খোলাসা করে কিছু বলেননি। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চিরকালই তারিখ সম্বন্ধে আমি অত্যন্ত কাঁচা। জীবনের বড়ো বড়ো ঘটনারও সন-তারিখ আমি স্মরণ করিয়া বলিতে পারি না; আমার এই বিস্মরণশক্তি নিকটের ঘটনা এবং দূরের ঘটনা, ছোটো ঘটনা এবং বড়ো ঘটনা, সর্বত্রই সমান অপক্ষপাত প্রকাশ করিয়া থাকে।’ লেখক বিষুপদ চক্রবর্তীর (জন্ম ২৯ নভেম্বর ১৯৪৭) ‘বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে রবি ঠাকুরের জন্ম ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ এবং ৭ মে ১৮৬১ হিসাবে উল্লেখ রয়েছে। জন্মদিন নিয়ে কালিম্পঙ থেকে ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কিশোরীমোহন সাঁতরাকে কবি লেখেন, ‘আগে তোমার সঙ্গে জন্ম তারিখের হিসেব নিকেশ করা যাক। তুমি হলে হিসেবি মানুষ। যে বছরের ২৫ বৈশাখ আমার জন্ম, সে-বছরের ইংরাজি পাজি মেলাতে গেলে-চোখে ঠেকবে ৬ মে। কিন্তু ইংরেজের অদ্ভূদ রীতি অনুসারে রাত দুপুরের পরে ওদের তারিখ বদল হয়। অতএব সে গণনায় আমার জন্ম ৭ই।’ পাঠক বলে নেই, এতে আমার গর্ব হয়, এই ভেবে এই দিনে (৭ মে) আমারও জন্ম। কথাটা ঠাট্টা করে বলি আমার ১৯ বছরের সন্তান, অতীশকে। কথাটা আমলে না নিয়ে সে যে প্রতিক্রিয়া দেখালো, তার মর্মার্থ এই দাঁড়ায়- কোথায় কী, কার সাথে কী তুলনা। যাই হোক, কবি এই প্রসঙ্গে আরো বলেন, ‘গ্রহণক্ষেত্রের চক্রান্তে বাংলা পাঁজির সঙ্গে তাল রেখে চলবে না- ওরা প্রাগ্রসর জাত, পঁচিশে বৈশাখকে ডিঙিয়ে যাচ্ছে- কয়েক বছর ধরে হল ৭ই মে, তারপরে দাঁড়িয়েছে ৮ই।’ মজার ব্যাপার হলো এই জন্মদিনকে ঘিরে বিতর্ককে নিয়ে ‘মজা’ করতে কবিও পিছিয়ে ছিলেন না। এই প্রসঙ্গে কবির রসবোধের পরিচয় পাই যখন তিনি লেখেন, ‘তোমরা ওই তিন দিনই যদি আমাকে অর্ঘ্য নিবেদন করো, ফিরিয়ে দেবো না, কোনোটাই বেআইনি হবে না। এ-কথাটা মনে রেখো।’
রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে যা ৫ ও ৬ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের জমিদার বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের সব চাইতে বড় তিনটি ঘটনা এই বাড়িতে ঘটেছিল। এই বাড়িতেই তার জন্ম, বিয়ে এবং মৃত্যু। তার জন্মের কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। তার বয়স যখন ২২ বছর সাত মাস তখন তিনি বিয়ে করেন ১০ বছরের ভবতারিনীকে, যার নাম তিনি বদলে রেখেছিলেন, মৃণালিনী এবং এই ঠাকুরবাড়িতেই তারা বিয়ের পর ছিলেন। এই বাড়িতেই ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (বাংলা ১৩৪৮, ২২ শ্রাবণ) দুপুর ১২টার কিছু সময় পর ৮০ বছর ৩ মাস বয়সে তার মহাপ্রয়াণ ঘটে। পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কবি সংসার’ গ্রন্থে দেখা যায়, বৌঠানের (কাদম্বরী দেবী) আত্মহননের পর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর বেশিদিন জোড়াসাঁকো রইলেন না। তিনি রাঁচি যাওয়ার পূর্বে প্রায় কুড়ি বছর ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়িতে। সেখানে প্রায়ই যেতেন রবীন্দ্রনাথ। এই প্রসঙ্গে সরলা দেবী লিখেছেন (জীবনের ঝরাপাতা)- ‘রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব করাই আমি। তখন মেজ মামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৪৯নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে উল্টোডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তার ঘরে তার বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনান বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া দুটি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাকে জাগিয়ে দিতুম। তখন সবাই জেগে উঠলেন-পাশেই নূতন মামার ঘর। “রবির জন্মদিন বলে” একটি সাড়া পড়ে গেল।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম উৎসব প্রথম উদযাপিত হয় শান্তিনিকেতনে, বাংলা ১৩১৭ সালে তার ৫০ বছর পদার্পণে। এই উদযাপন চলেছে তার মহাপ্রয়াণের বছর তক। পরের বছর যখন ৫০ বছর পূর্ণ করলেন সেবার প্রথমবারের মত জাঁকজমকভাবে কবির জন্মদিন পালিত হলো শান্তিনিকেতনে। সে দিন ছিল ১৯১১ সালের ৮ মে, কবি ৫১ বছরে পা রাখলেন। কবি তার ৬১ বছর বয়সে নিজ জন্মদিন উপলক্ষে লিখলেন এই গানটি: ‘হে নূতন,/ দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।/তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন/ সূর্যের মতন।’ কবি গুরুর জন্মদিন উদযাপিত হয়েছে বিদেশেও, অনেকবার, মাঝ সাগরেও, বিদেশ যাত্রা পথে, একবার জাপান যাবার পথে, আর একবার সিংহল যাত্রাপথে। বিদেশ ভ্রমণ তালিকায় যে সব দেশ তার মধ্যে হল্যান্ডও ছিল। যে সমস্ত দেশ তিনি ভ্রমণ করেছিলেন তা এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে হয়। সব চাইতে বেশি ভ্রমণ করেছেন ইংল্যান্ড, মোট ৮ বার, ১৮৭৮ থেকে ১৯৩০ সাল তক। আমেরিকায় ৫ বার, জাপান ৪ বার। ভাবা যায়! সেই সময় সমুদ্রপথে, উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে। এছাড়া যে সমস্ত দেশ তিনি ভ্রমণ করেছিলেন তা হলো: জার্মানি, সুইডেন, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, ফ্রান্স, নরওয়ে, হাঙ্গেরি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড (৩ বার), বুলগেরিয়া, মিশর, ইরান। কবি যেদিন ৭১ বছরে পা দিলেন তখন তিনি ছিলেন তেহরান, ইরানের রাজধানী। ১৯৩২ সালের ৬ মে। ইরানী শিক্ষামন্ত্রীর বাড়িতে কবিগুরুর জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এক অনুষ্ঠানের। তাতে কবি এতই আপ্লুত হয়েছিলেন যে তিনি লিখেছিলেন:
‘ইরান তোমার যত বুলবুল,
তোমার কাননে বসন্ত ফুল
বিদেশি কবির জন্মদিনেরে মানি
শুনালো তাহারে অভিনন্দনবাণী।’
কষ্ট হয়, ব্যথা জাগে যখন দেখি পরবর্তীতে কবি লেখেন ‘চলে যাব কয় বর্ষ পরে’। লিখেছিলেন মংপুতে বসে। সেখানে তিনি ছিলেন মৈত্রেয় দেবীর আতিথ্যে। মৈত্রেয়ী দেবী তার ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জন্মদিন এগিয়ে এল, আয়োজন চলছে, রথীদারা (কবি পুত্র) শীঘ্রই আসবেন, উনি (কবি) খুশি হয়ে অপেক্ষা করছেন। পঁচিশে বৈশাখের দু’তিন দিন আগে একটা রবিবার এখানে উৎসবের বন্দোবস্ত হোলো। সকাল বেলা দশটার সময় স্নান করে কালো জামা কালো রং এর জুতো পরে বাইরে এসে বসলেন। কাঠের বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে একজন বৌদ্ধ স্ত্রোত্র পাঠ করলেন। কবি ঈশোপনিষদ থেকে অনেকটা পাঠ করলেন। সেই দিন দুপুরবেলা ‘জন্মদিন’ বলে তিনটা কবিতা লিখেছিলেন, তার মধ্যে বৌদ্ধবৃদ্ধের কথা ছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন ৮০ বছরে পা দিলেন লিখলেন: ‘সাবিত্রী পৃথিবী এই, আত্মার এ মর্তনিকেতন/ আপনার চতুর্দিকে আকাশে আলোকে সমীরণে/ ভূমিতলে সমুদ্রে পর্বতে/ কী গূঢ় সংকল্প বহি করিতেছে সূর্যপ্রদক্ষিণ/সে রহস্যসূত্রে গাঁথা এসেছিনু আশি বর্ষ আগে,/ চলে যাব কয় বর্ষ পরে’। তার আরো ‘কয় বর্ষ’ পর এই পৃথিবী থেকে চলে যাবার যে মনোবাঞ্ছনা তার লেখার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তা পূরণ হলো না। পরের বছরই তাকে চিরবিদায় নিতে হলো। কবির শেষ জন্মদিন পালিত হয় ১৯৪১ সালের ৬ মে। তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ। সে অবস্থায় তিনি ‘উদয়ন’ থেকে লিখলেন:
আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা,
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।
শূন্য ঝুলি আজিকে আমার
দিয়েছি উজাড় করি,
যাহা কিছু আছিল দিবার
প্রতিদানে যদি কিছু পাই-
কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা-
তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই
পারের খেয়ায় যাব যবে
ভাষাহীন শেষের উৎসবে।’
মর্ত্যলোকের কবি যাত্রা করলেন অমৃতলোকে। বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর ভাষায়- “জন্মদিনের মজার খুনসুঁটি-মাখানো বিতর্ক গেল মুছে। শুধু অমর্ত্য হয়ে রইল ‘২৫ বৈশাখ’।” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মদিবসে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট