স্মৃতিঘেরা রেলওয়ে হাসপাতাল
রেল কর্তৃপক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে কি?
যদি বলা হয় চট্টগ্রামের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ও ইতিহাস-ঘেরা ভবন কোনটি? মুহূর্ত না ভেবে বলা যায়, রেলওয়ে বিল্ডিং যা ‘সিআরবি’ নামে বেশি পরিচিত। আজ থেকে ঠিক ১৫০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৭২ সালে সবুজ প্রকৃতি-ঘেরা লাল সুরকির এই দোতলা ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল। এটি বন্দর নগরীর সবচাইতে পুরানো ভবন। ১৭৬০ সালে নওয়াব মীর কাশিমমের কাছ থেকে ব্রিটিশরা চট্টগ্রামের অধিকার লাভ করার পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাদের শাসনাধীন ছিল এই নগরী। তাদের শাসনামলে দেশের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের জন্যে তৈরি করা হয় এই এলাকার দৃষ্টিনন্দন ভবন ‘সিআরবি’। বুদ্ধি-বয়স থেকে এর সাথে আমার পরিচয়। এই রেলভবনকে ঘিরে আশপাশ এলাকাটি চট্টগ্রাম শহরের সবচাইতে সুন্দর স্থান বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না। এই পিচ-ঢালা পথ ধরে রাণী এলিজাবেথের গাড়ি-বহর এগিয়ে গিয়েছিল সার্কিট হাউজের দিকে। বাবার কাঁধে চড়ে সে বহর দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বাবা চাকরি করতেন রেলওয়েতে, এই ‘রেলভবনে’। সেই সুবাদে আমবাগান, বাটালি হিল যেখানে দাঁড়িয়ে তার ঠিক পাদদেশে ছিল রেলওয়ে কলোনি। তারই একটি বাসায় থাকতাম আমরা। আকারে খুব একটা বড় না। তবে বেশি দিন থাকতে হয়নি সে বাসায়। তখন আমরা ভাইবোন মিলে ছয় জন। পরে আরো দুজন যোগ হয়েছে। আমাদের বাসার কাছেই গাড়ি রাস্তা। তা পেরোলেই স্কুল। আমার প্রথম স্কুল। মনে নেই, তবে পরে শুনেছি প্রতিদিন বাসা থেকে এক দৌড়ে স্কুলে যেতাম। স্কুলে পৌঁছে বেঞ্চে বসে তবেই স্থির। স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাবার ধাত আমার নাকি ছিলনা। চঞ্চলমতি ছিলাম। এর বছর কয়েক পর বাবা চলে এলেন ‘বয়লিউ এভিনিউতে’। এলাকার নামে যেমন একটা আভিজাত্যের গন্ধ, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা দেয়া পাড়াটাও ছিল দৃষ্টিনন্দন। মুখোমুখি দুই সারিতে গোটা সতের সরকারি বাসা। আয়তনে বড়, প্রতিটি বাসার সামনে ছোটরা ফুটবল খেলতে পারে তেমন সাইজের মাঠ। বেড়ার তাঁর দিয়ে যার যার সীমানা ঘেরা দেয়া। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি কংক্রিটের রাস্তা, স্টেশন রোডের দিক থেকে আমাদের পাড়ায় ঢুকে সে রাস্তা মিশে গেছে সিআরবিমুখী রাস্তার সাথে। সেখান থেকে বড় জোর মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ পেরোলেই রেলভবন বা সিআরবি। একটু উপরের দিকে উঠে যাওয়া সে রাস্তার দুদিকে পাহাড়।
এক পাহাড়ের চূড়ায় বড় এলাকা জুড়ে ছিল এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার বাংলো। অন্যদিকে পাহাড়ের উপর রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ক’টি বাংলো। আমাদের বাসার ঠিক পেছন-লাগোয়া যে পাহাড় সেখানে ছিল বড় সাইজের দোতলা ভবন। সেখানে থাকতেন চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটির চেয়ারম্যান। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেই বড় সাইজের দোতলা ভবনকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের ঘাঁটি বানিয়েছিল। গেইটের সামনে বসিয়েছিল বাংকার। মেশিনগান তাক করা নীচের দিকে। পাহাড়ের নীচে ছিল কিছু বস্তি টাইপের বেড়া, বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘর। এক শীতের সকালে সেখানে কান্নার রোল। তাদের এক ১০-১২ বছরের ছেলেকে বাংকার থেকে পাক মিলিটারি গুলি করে হত্যা করে। শীত থেকে নিজেকে বাঁচার জন্যে হতভাগা গরীব ছেলেটি গায়ে-মুখে চাঁদর মুড়িয়ে ধারে-কাছে দোকানের দিকে যাচ্ছিল। পাক সেনারা নিচে নেমে এসে ঘটনা জানতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করে এবং খুব সম্ভবত সামান্য কিছু সাহায্যও করে। তারা ভেবেছিল কোন ‘মুক্তি’। সে সময় আমরা তখন বয়লিউ এভিনিউর ওই বাসায়। আমাদের পাড়ায় বাঙালি পরিবার ছাড়াও ছিল বেশ কটি পাঞ্জাবি ও বিহারি পরিবার। পরিবারের কর্মকর্তারা ছিলেন বাবার সহকর্মী। তাদের আমরা ডাকতাম চাচা এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা ছিল আমাদের খেলার সাথী। যে অবাঙালি মেয়েটি আমাদের সাথে বাসার সামনে বড় মাঠে ক্রিকেট খেলতো তার নাম ছিল নাসরিন। তার ভাই শামীম ছিল আমার বন্ধু। আমাদের পাড়ায় তখন কেবল একটি প্রাইভেট কার ছিল, ব্যাঙের মত দেখতে, ‘ভক্সওয়াগন’। শামীমের বড় ভাইয়ের। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র গাড়ি-প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ‘গান্ধারায়’ কাজ করতেন। পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। দেশ স্বাধীন হতে চলেছে সে বুঝি তারা টের পেয়েছিল। তারা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। ততদিনে পাড়ার অবাঙালি সবাই একে একে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে পশ্চিম পাকিস্তানে। একটি বিহারি পরিবার থেকে গিয়েছিল। আমাদের বাসা যে সারিতে, তার শুরুতে ছিল সে বাসা। বাড়ির কর্তা ছিলেন পুলিশ অফিসার। তারাও এক সময় চলে যায় কোথায়। পাকিস্তানে যাবার চেষ্টা করেও পারেনি। অনেক বিহারীর মত তারাও স্বাধীন বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিল। তবে আগের সে আয়েশ ছিল না। তাদের আশ্রয় হয়েছিল ঝাউতলার এক ক্যাম্পে। তাদের বড় ছেলে ছিল আমার সমবয়সী, নাম জামসেদ, অনেক দিন পর তার সাথে দেখা হলে এই সমস্ত ঘটনা জানায় সে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তখন সে আমার সাথে বাংলায় কথাবার্তা বলছে, যদিও বা কিছুটা উর্দু ‘একসেন্ট’ রয়ে গেছে। তাদের বাগানে ছিল অনেক ফুলের চারা গাছ। বেশ সাজানো-গুছানো। বাগানের সীমানা ঘেঁষে ছিল একটি বড় শিউলী ফুলের গাছ। দুর্গা পূজার দিন-কয়েক আগে মহালয়া উৎসবকে ঘিরে ভোর তিনটার দিকে আকাশবাণী থেকে শুরু হতো ‘চন্ডীপাঠ’। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের ‘চন্ডীপাঠ’ কানে যেন সুধা ঢেলে দিত। ওই সময়টায় শীত নেমে আসতো। বাবা আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। গায়ে চাদরে জড়িয়ে বাবা-মা সহ আমরা রেডিওকে ঘিরে বসতাম। চন্ডীপাঠ যখন যখন শেষ হতো তখন সুবেহ-সাদেক। গায়ে চাঁদর জড়িয়ে আমরা যেতাম জামশেদদের বাগানের দিকে। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা বাগান। ভেতরে ঢোকার উপায় ছিলনা। কিন্তু মন-ভোলানো শিউলী ফুল বাগানের বাইরেও পড়ে থাকতো, কুয়াশা-ঢাকা ঘাসে। আমরা কুড়িয়ে নিতাম। সে সব দিনের কথা মনে পড়লে এখন কেবলি মনে হয় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম…’। বয়লিউ এভিনিউর সে রূপ-গন্ধ সব আজ গেছে, চিরদিনের তরে।
চট্টগ্রামের ভালো কিছু যা ছিল একে একে সব গেছে। সেই আগের অনেক কিছুই নেই আজ। যে রেলভবনে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তার উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে ছিল একটি চমৎকার হাসপাতাল। গত ২০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় এই হাসপাতালকে নিয়ে একটি খবর পড়ে মনটা খারাপ হয়ে এলো। তাতে পড়লাম এই রেলওয়ে হাসপাতাল এখন প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে আছে। অথচ একটা সময়, আমার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় কী প্রাণবন্ত না ছিল এই হাসপাতালটি। এর সেবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চাইতেও উন্নত ছিল। কোন অপারেশন হলে মেডিকেল কলেজের বড় বড় প্রফেসররা এসে অপারেশন করতেন। বাবা কাজ করতেন রেলওয়ের জি এম অর্থাৎ জেনারেল ম্যানেজার অফিসে, জি এমের কাছের লোক। সেই সুবাদে রেলওয়ে হাসপাতালের সিএমও (চীফ মেডিকেল অফিসার) থেকে শুরু করে সব ডাক্তারের কাছে তার ছিল বাড়তি খাতির। তখন হাসপাতালে ছিলেন ডাক্তার রেণুকতা বড়ুয়া, ডাক্তার দুলাল দাশ, ডাক্তার মনসুর। সবার নাম এতদিন পর মনে পড়ছে না। মনে পড়ে আমাদের কারো কোন অসুখ-বিসুখ করলে আমরা হাসপাতালে গিয়ে অপেক্ষা করতাম বাবার জন্যে, বাবা আসতেন অফিস থেকে নেমে। তিনি এলে আমরা রোগীদের লাইনে না দাঁড়িয়ে সরাসরি ভেতরে গিয়ে চেয়ারে বসার ‘প্রিভিলিজটুকু’ পেতাম। তিনি চলে গেলে প্রেসক্রিপশন নিয়ে একই ভবনের পেছনে যেখানে কম্পউন্ডাররা বসতেন সেখান থেকে ওষুধ নিয়ে বাসায় ফিরতাম। বাবা চলে যেতেন তার কাজে। এই সেবা যে কেবল আমরা পেয়েছি তা নয়। নিকট আত্মীয়-স্বজন, তাদের ছেলে-মেয়েরাও, এমন কী কারো ডেলিভারী, কিংবা অপারেশন, বাবার সুবাদে তারাও এই রেলওয়ে হাসপাতাল থেকে বিনা পয়সায় পেয়েছে চমৎকার চিকিৎসা ও সেবা। এই জীবনে একবার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে। তখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। হাসপাতালের সামনের আউটডোর পেরিয়ে পেছনে ইন-ডোর। ঝকঝকে, তকতকে, পরিস্কার। সপ্তাহ দুয়েক ছিলাম। ডা: মনসুর ছিলেন তরুণ ডাক্তার, সুদর্শন। আমার কেবিনের পাশে করিডোর পেরিয়ে বাইরে সবুজ-ঘাসে ঢাকা খোলা চত্বর। চেয়ার নিয়ে সেখানে বসা যেত। স্বাস্থ্যের জন্যে চমৎকার পরিবেশ। মনে হতো যেন কোন রিসোর্টে আছি। চমৎকার ছিল হাসপাতালের খাবার, নার্সদের নিয়মিত সেবা। নিয়মমাফিক ওনারা আসছেন, ডাক্তার আসছেন সময়মত, চেক করছেন। এখন এই সব ভাবতেই দুঃখ হয়। বাংলাদেশের তথাকথিত প্রাইভেট ক্লিনিকেও এই সেবা পাওয়া তো দূরের কথা, চিন্তাও করা যায় না। যখনকার কথা বলছি তখন ডাক্তার, নার্স, আয়াদের বাড়তি কোন টাকা, টিপস দেয়ার কথা চিন্তাই করা যেত না। মাথায়ই আসতো না। আর আজ? সে সবার জানা।
দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরটি পরে দুঃখ লাগলো। এমন একটি সুন্দর প্রতিষ্ঠান ধরে রাখতে পারলাম না আমরা। আজাদী লিখেছে, “প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে সিআরবির বিশাল এলাকা জুড়ে রেলওয়ে হাসপাতালের অবস্থান। চিকিৎসার জন্য চমৎকার পরিবেশ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুদীর্ঘকাল সুনামের সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিল এই হাসপাতাল। তখন হাসপাতালটি রোগীতে পূর্ণ থাকত। ছিলেন পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স। জটিল অনেক অস্ত্রোপচার হতো এই হাসপাতালে। সুদৃশ্য কেবিনের চারপাশ ছিল গাছগাছালিতে ভরা। বর্তমানে নগরবাসী তো দূরের কথা, খোদ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান না। রেলওয়ে হাসপাতালের একই করিডোরে ১০৫ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল এবং ৫৫ শয্যার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। এই দুই হাসপাতাল এখন সারা বছরই থাকে রোগী শূন্য। নেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। হাসপাতালের বিশাল অবকাঠামো জুড়ে নার্স, ওয়ার্ড বয়, ফার্মাসিস্ট, আয়ারা বসে বসে অলস সময় কাটান আর মাস শেষে বেতন নেন।”
যা ছিল যা আছে তা ধরে রাখার কোন উদ্যোগ নেই। উল্টো প্রকৃতিকে খর্ব করে, ধ্বংস করে ষড়যন্ত্র হচ্ছে সেখানে পাঁচ শতাধিক বেডের নতুন হাসপাতাল করার। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে খোদ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ থেকে, ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের সাথে মিলে। প্রতিবাদ উঠেছে চট্টগ্রামের প্রাণভোমরা, ফুসফুস এই ঐতিহ্যবাহী সিআরবি এলাকার সৌন্দর্য ক্ষুণ্ন করে বহুতল নতুন হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে। তীব্র প্রতিবাদের মুখে এই উদ্যোগ কিছুটা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যে স্বার্থান্বেষী মহল এই উদোগ্যের পেছনে পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। হাসপাতাল নির্মাণ নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ, মহৎ উদ্যোগ, যদি হয় তার উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু ভালো যা তা নষ্ট করে নতুন কিছু করা কিংবা ভালো যা ছিল তা ধরে রাখার চেষ্টা না করে, পরিবেশ নষ্ট করে নতুন কিছু করা কতটুকু সমর্থনযোগ্য সেটি ভাবার বিষয়। সবশেষে, রেল কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের ফুসফুসকে অক্ষত রেখে, প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থাকা ‘রেলওয়ে হাসপাতালকে’ নতুন করে ঢেলে সাজাবে, এর হৃত যৌবন ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবে- এই প্রত্যাশা করি।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট