জীবনের পথপরিক্রমায় শিক্ষা ব্যবস্থার গতিধারা

ড. নারায়ন বৈদ্য | শনিবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ

জীবন পরিক্রমায় শিক্ষা জীবনের বন্ধুদের ছাড়াও কত লোকের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছি। এ সংক্ষিপ্ত জীবন পরিক্রমায় যেখানে সুযোগ পেয়েছি সেখানে কত মানুষের উপকার করেছি। আমারও উপকার করেছে অনেকেই। কত মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব করেছি। তারা এখনও খবর নেয়, সুখ দুঃখের কত কাহিনী নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু শিক্ষা জীবনের গুটি কয়েক বন্ধু ছাড়া অন্যদের সাথে এখনও বহাল তবিয়তে যোগাযোগ আছে। আমার গ্রামের স্কুলের নাম গশ্চি উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সালে এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত লেখাপড়ার প্রতিযোগিতা করার পরও আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় ছিল। এ রকম আমার এক বন্ধু ছিল স্বপন চৌধুরী (ছদ্মনাম)। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর সেই বন্ধু উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পায়। স্বাভাবিকভাবে কর্মস্থলের ব্যস্ততায় দুইজনের মধ্যে তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। ২০০১ সালে শিক্ষকদের মধ্যে মামলা ও প্রতি মামলা নিষ্পত্তি হলে মন্ত্রণালয় কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করে। পদোন্নতির এ প্রক্রিয়ায় ২০০১ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চলে যাই কক্সবাজার সরকারি কলেজে। প্রায় দশ বছর সরকারি সিটি কলেজে থাকার কারণে কক্সবাজার কলেজ থেকে বদলি হয়ে শহরের কলেজে আসার জন্য চেষ্টা করতে থাকি। তারই ধারাবাহিকতায় একদিন বিকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করি। কিন্তু বদলির দায়িত্বে নিয়োজিত উপসচিব মহোদয় সেদিন বিভিন্ন মিটিং-এ ব্যস্ত থাকার কারণে তাঁর সাথে দেখা করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এদিকে বিকাল ৪.০০ টা বেজে গেছে? অবশেষে বিফল মনোরথ হয়ে বিকাল ৪.৩০ মিনিটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নেমে হেঁটে গেইটের দিকে আসতেছি। এমন সময় আমার পিছনে একটি জিপ গাড়ি এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। গাড়ির ভেতর থেকে একজন লোক হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রাখে। আমি অবাক হয়ে মানুষটির দিকে তাকালাম। দেখি মানুষটি আমার নাম ধরে ডাক দিয়ে বললো- কোথায় এসেছিস্‌। চিনতে আমার দেরি হলো না। এ হলো আমার স্কুল জীবনের বন্ধু স্বপন। পকেট থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে দিয়ে বললো- আমার অফিসে আসিও। বললাম- ঠিক আছে, আমি যাবো।
রাত্রিবেলা হোটেলে ফিরে সেই পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগের স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে গেলো। ভাবলাম স্বপন এখনো আমাকে ভুলেনি। আমার ছুটি ছিল না বলে ঐদিন রাত্রে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে এসেছি। ইতিমধ্যে আরো কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো। আমি কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে বদলি হয়ে সাতকানিয়া সরকারি কলেজে যোগদান করেছি। পরবর্তী দুই বছর আর বদলীর জন্য কোন চেষ্টা করিনি। কারণ এ সময়ে আমার দ্বিতীয় বই ‘অর্থনীতিবিদদের জন্য পরিসংখ্যান’ লেখায় হাত দিয়েছি। এটি ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতি বিষয়ের একটি পাঠ্যবই। অবশ্য এ গ্রন্থটি আর একজন অধ্যাপককে সাথে নিয়ে লিখেছিলাম। গ্রন্থটি ২০০৪ সালে লিখা শেষ করি। ফলে শহরের কলেজে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি। এবার আমার বন্ধু স্বপনের সাহায্য নেয়ার জন্য তাঁর সাথে যোগাযোগ করি। সে তখন মন্ত্রণালয়ে মৎস্য বিভাগে কর্মরত ছিল। আমার একজন জুনিয়র কলিগকে সাথে নিয়ে একদিন মন্ত্রণালয়ে স্বপনের সাথে দেখা করি। স্বপন আমাদেরকে আপ্যায়ন করিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলীর দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাকে একটি ফোন করলো। কারণ ঐ কর্মকর্তা ছিল স্বপনের একই বেসমেইট। কথা বলার পর স্বপন আমাকে বললো- তুমি যাও ঐ কর্মকর্তার কাছে। তোমার বদলীর আবেদনটা দিয়ে এসো। আমিও আমার জুনিয়র কলিগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উঠে ঐ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রুমে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করি। তাঁকে যথাযথ সালাম দিয়ে স্বপনের কথা বলে বদলীর আবেদনটি দিতেই তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। উনার রাগান্বিত কথার মধ্যে একটি বাক্য এখনো আমার মনে আছে। তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেন “আমি রামপাল পর্যন্ত চাকরি করে এসেছি, আর আপনি সাতকানিয়া কলেজে চাকরি করতে পারছেন না? যান, বাইরে বদলির আবেদন দেয়ার একটি বাক্স আছে। সেই বাক্সে দরখাস্ত রেখে যান।” কোন কথা না বলে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলাম। আমার জুনিয়র কলিগ বললো ‘স্যার এ কথাগুলো আপনার বন্ধুকে বলবেন না, যদি বলেন, তবে তাদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। তার কথা গ্রহণযোগ্য বলে মনো হলো। তাই বন্ধু স্বপনের সাথে আসার সময় দেখা করে বলেছি, তুমি চিন্তা করো না, বদলি হয়ে যেতে পারি। আমার বন্ধুর সাথে পরবর্তী দুই বছর আর বদলির জন্য দেখা করিনি। ইতিমধ্যে আমি একটি সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষকে সাথে নিয়ে কয়েকবার ঢাকা গিয়ে সাতকানিয়া সরকারি কলেজ থেকে চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম (নাসিরাবাদ মহিলা কলেজ)-এ বদলি হয়ে আসি। তখন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রায় ১৭ বৎসর প্রভাষক থেকে শহরের কলেজগুলো থেকে সব টিচার দূরবর্তী কলেজে প্রমোশন জনিত কারণে বদলি হতে হয়েছে। কারণ একজন বিজ্ঞ শিক্ষা সচিব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব নেবার পর তিনি এ বলে প্রমোশন দিলেন যে, প্রমোশন প্রাপ্ত সব টিচারকে নিজ বিভাগে বদলী করা যাবে না। তাই প্রমোশন প্রাপ্ত সব টিচার নিজ বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগের কলেজগুলোতে পদোন্নতি পায়। এ কারণে শহরের কলেজগুলোতে পদ খালি হচ্ছিল না। প্রায় দুই বছর পর হঠাৎ অর্থনীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপকের একটি পদ চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, চট্টগ্রামে খালি হওয়াতে উক্ত পদে আসার জন্য প্রতিযোগী ছিল পাঁচ জন। আর যেদিন আমি সাতকানিয়া সরকারি কলেজ থেকে চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ-এ যোগদান করছি সেদিন ঐ পদে আসার জন্য প্রতিযোগীরা হতাশ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য উক্ত কলেজে বেশিদিন আমাকে থাকতে হয়নি। মাত্র দেড় বছর পর আমি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ চট্টগ্রামে যোগদান করি। অবশ্য আমার স্কুল জীবনের বন্ধু স্বপন কোন সময় আমাকে বিমুখ করেনি। জীবনের শেষ প্রান্তে অধ্যাপক হয়ে কলেজ প্রশাসনে যেতে চাইনি। কারণ যে বৎসর আমি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাই সেই বৎসর আমার বড় মেয়ে তুলি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর হঠাৎ একটি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসের ১৬ তারিখে মারা যায়। এ বেদনা আমাকে এতই আঘাত করেছে যে আমি কিছুতেই অধ্যক্ষের দায়িত্বভার নিতে চাইনি। ফলে এ পদের জন্য চেষ্টাও করিনি। কিন্তু দুই বছর পর মেয়ের মৃত্যু শোক থেকে বাঁচার জন্য আমি ঝঝঈঊগ নামক একটি তিন মাসের কোর্স করার জন্য ঢাকায় চলে যাই। এ তিন মাস অবস্থানকালে বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে অবশেষে অধ্যক্ষ পদে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য আবেদন করি এবং মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে সিলেক্ট হই।
কিন্তু শহরের কলেজে পদায়ন পাওয়ার জন্য প্রায় দশ বছর পর আমার স্কুল জীবনের বন্ধু স্বপনের সাথে দেখা করি। সে তখন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে কর্মরত ছিল। কিন্তু একটি কৌশলগত কারণে শহরে পদায়ন হওয়া সম্ভব হয়নি। অবশেষে গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করি। প্রায় ৩ বছর অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত থাকার পর অবশেষে ২০১৭ সালে মে মাসে উক্ত কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করি। অনেক আগেই আমি পি-এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেছি। তাই কর্মময় জীবনকে দীর্ঘায়িত করার জন্য একমাস পর বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে যোগদান করি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় জীবনের গল্প এখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু হঠাৎ একদিন টেলিফোন পেলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুর কাছ থেকে, যে আমাকে তার বাসায় যাওয়ার পর একটু আপ্যায়নও করেনি। পরিচয় পর্বের পর বললো- তুমি তো অধ্যক্ষ পর্যন্ত হয়েছ। অতএব তোমার দুঃখ তো থাকার কথা নয়। বললাম- আমার দুঃখ নিয়ে তোমাকেতো কোনদিন কোন কথাতো বলিনি। তুমি হঠাৎ করে এ কথা বলছো কেন? সে আমাকে ঢাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো। এর কয়েকদিন পর আমি একটি ম্যাসেজ পেলাম। তাতে সে লিখেছে- “আমি অত তারিখে চট্টগ্রাম এসে রেস্ট হাউসে থাকবো, তুমি আসিও।” যেহেতু আমার পড়ন্ত বিকালের জীবনে আর অপমানিত হতে চাইনি সেহেতু আমি সেখানে যাইনি। এমনকি ব্যাচ ’৭৯ (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) কর্তৃক যে পিকনিকের আয়োজন করেছে সেখানেও অংশগ্রহণ করিনি। যদিও সেই পিকনিকে আমার ঢাকার বন্ধু গিয়েছিল। আজ একটি জিনিস মনে পড়ে, আমার বন্ধুর ন্যায় কম পেলাম নাকি বেশি পেলাম সেই হিসাব জীবনের পড়ন্ত বেলায় করি না। বরং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো যে ছড়াতে পেরেছি সেটিই আমার বড় প্রাপ্তি।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধ‘মনের গোপন কথা’ ইউটিউবে