এক নাগাড়ে প্রায় ১৪ বছর দেশ শাসন করার পর গেল সপ্তাহে ডাচ প্রধান মন্ত্রী মার্ক রুতে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার ৩২টি দেশের সমন্বয়ে গড়ে উঠা বিশ্বের সব চাইতে শক্তিধর রাজনৈতিক ও সামরিক জোট, ‘ন্যাটো‘-র সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে যোগ দিলেন। ন্যাটোর সর্বোচ্চ এই পদ করায়ত্ত করার জন্যে অনেক ধাপ পেরোতে হয়। প্রার্থীর শিক্ষাগত ও কর্ম–অভিজ্ঞতা এই পদে নির্বাচিত হবার একমাত্র চাবিকাঠি নয়। প্রার্থী যত যোগ্যই হোক না কেন, যদি ন্যাটোর কোন সদস্য রাষ্ট্র তার ব্যাপারে আপত্তি জানায়, তাহলে তিনি ওই পদের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। আবার সদস্য রাষ্ট্রগুলি কোন প্রার্থীর ব্যাপারে কোন আপত্তি না জানালেও এই জোটের বড় ‘মোড়ল‘ যুক্তরাষ্ট্র যদি কোন কারণে ওই প্রার্থীর উপর ‘নাখোশ‘ থাকে, তাহলে তার নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা একেবারে ‘জিরো‘। প্রার্থী নির্বাচনে প্রত্যেকটি সদস্য–রাষ্ট্র নিজ নিজ স্বার্থ দেখে। কোন–প্রার্থীকে সমর্থন দিলে তার দেশের কী লাভ বা কী ক্ষতি হতে পারে সে বিষয়টা তারা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে। প্রার্থী নির্বাচনে চলে বছরের বেশি সময় ধরে দেন–দরবার, হিসেব–নিকেশ। এই পদের জন্যে যারা প্রার্থী হন তারা সাধারণ কোন প্রার্থী নন। তারা হয় কোন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্র প্রধান, পররাষ্ট্র মন্ত্রী বা উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিবিদ। প্রতিযোগিতার শুরুতে বেশ কয়েক প্রার্থী থাকেন। ধীরে ধীরে কমতে থাকে প্রার্থীর সংখ্যা। এবারের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত হল্যান্ডের প্রধান মন্ত্রী মার্ক রুতের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট ক্লাউস আয়োহানিস। তারা দুজনেই অর্থাৎ রুতে ও আয়োহানিস– ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল অস্ট্রিয়ায় ভূতপূর্ব প্রধান মন্ত্রী ও জাতিসংঘের বিশেষ দূত, স্টল্টেনবেগের্র শূন্য আসন পূরণ করার লড়াইয়ে নেমেছিলেন। শুরু থেকেই ডাচ প্রধান মন্ত্রী মার্ক রুতের সম্ভাবনা ছিল বেশি। তিনি যে মনোনীত হবেন সেটি অনেকটা নিশ্চিত ছিল। কারণ যোগ্যতার বিচার্যে তিনি যোগ্যতর প্রার্থী, সুদর্শন (এটিও অনেক সময় প্রার্থীর প্লাস পয়েন্ট হিসাবে বিবেচিত হয় বলে আমার ধারণা), বিনয়ী, বন্ধুসুলভ ও সৎ। দীর্ঘ ১৪ বছর হল্যান্ডের প্রধান মন্ত্রী থাকাকালীন সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অন্যায়ের কোন অভিযোগ উঠেনি। প্রধান মন্ত্রী হয়েও অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন ৫৭ বছর বয়েসী এই অকৃতদার সফল রাজনীতিবিদ। তার সাথে একবার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। বছর কয়েক আগে স্বস্ত্রীক ডাচ পার্লামেন্ট ভবনের প্রেস সেন্টারে যেতে হয়েছিল কাজে। সেন্টারের পরিচালকের সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিল। তার সেক্রেটারি আমাদের রিসেপশনের পাশে ক্যাফেটেরিয়ায় অপেক্ষা করতে বলে কফির অর্ডার দিয়ে চলে গেলেন। আমাদের কফি–খাওয়া শেষ। ক্যাফেটেরিয়া প্রায় শূন্য। কেবল এক কর্মচারী কাউন্টারে বসা, আর এক টেবিল ঘিরে জনা কয়েক পার্লামেন্টারিয়ান। হঠাৎ সহধর্মিণী সুমনা বলে, ‘দেখো প্রধান মন্ত্রী রুতে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছেন। সাথে কেউ নেই। চলো একটু হ্যালো–হাই করে আসি।‘ আমার দিক থেকে খুব একটা আগ্রহ ছিলনা। যদিওবা এই ডাচ রাজনীতিবিদকে ব্যক্তি হিসাবে আমার পছন্দ। সুমনার অতি–আগ্রহে এগিয়ে গেলাম। ডাচ ভাষায় ‘শুভ সকাল‘ বলে কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেই। তিনি হেসে তার হাত বাড়িয়ে দেন। সুমনাই প্রথমে কথা শুরু করে। আমাদের এমনটিই হয়। ঘরে–বাইরে বা কোন আড্ডায় গেলে কথা বের হয় তার দিক থেকে বেশি। সুমনা প্রধান মন্ত্রীকে বলে, ‘আপনাকে প্রায়শঃ দেখি সাইকেল চেপে অফিস করতে। ভালো লাগে। আমিও প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে আমার অফিসে যাই।‘ প্রধান মন্ত্রী বলেন, ‘স্বাস্থ্যের জন্যে সাইকেলিং খুব ভালো। শুনে ভালো লাগলো।‘ আরো টুকটাক আলাপ আলাপ– বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, তার এক প্রতিবেশী বাংলাদেশ দূতাবাসের জনৈক কূটনীতিকের কথা ইত্যাদি। এক পর্যায়ে ছবি তুলতে চাইলে তিনি সম্মতি দেন। ক্যাশের সামনে বসা কর্মচারীকে ইশারা করলে উনি এসে আমাদের তিনজনের ছবি তোলেন। কত সাধারণ, কোন কৃত্রিম গাম্ভীর্য নেই, তাড়া আছে বলে এড়িয়ে যাবার কোন তাড়া নেই। প্রধান মন্ত্রী হিসাবে কোন নিরাপত্তা নেই তাকে ঘিরে। আমাদের দেশে কল্পনায়ও এমন দৃশ্য ভাবা যায়না। বুঝি এই কারণে এনারা আমাদের চাইতে ভিন্ন, নমস্য। প্রধান মন্ত্রী হয়েও মার্ক রুতে প্রায়শ তার সরকারি বাসভবন থেকে পার্লামেন্ট অফিসে যান তার নিজস্ব সাইকেলে চেপে, কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ। চলার পথে পথচারীদের কেউ কেউ তাকে দেখে হাত নাড়েন। তিনিও হাত নেড়ে প্রতিউত্তর দেন। বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদকে একবার দেখা গিয়েছিল ঘটা করে সাইকেল চালাতে। তবে সেটি ছিল স্রেফ ‘মিডিয়া শো‘। মার্ক রুতেকে একবার দেখা গেল এক হাতে কফি ও অন্য হাতে কিছু কাজগপত্র নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনের সিকিউরিটি পোর্ট দিয়ে ঢুকছেন। এমন সময় হঠাৎ তার হাতে ধরা কাপ থেকে ছিটকে বেশ কিছু কফি ফ্লোরে পড়ে গেলো। দৌড়ে এলো এক কর্মচারী তা মুছতে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে দেখা গেল প্রধান মন্ত্রী ওই কর্মচারীর হাত থেকে কাপড় নিয়ে নিজে নিচু হয়ে ফ্লোরে পড়া কফি মুছতে লাগলেন। এমন অনেক উদাহরণ আছে মার্ক রুতের। প্রধান মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তিনি হেগ শহরের এক হাই স্কুলে সপ্তাহে একদিন ক্লাসও নিতেন। তিনি বলেছিলেন, প্রধান মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর তিনি শিক্ষকতায় যোগ দেবেন। কথায় আছে ‘ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস‘ অর্থাৎ ‘মানুষ চায় এক আর সৃষ্টিকর্তা লিখে রাখেন ভিন্ন।‘ যাই হোক –
২) ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল পদের জন্যে কয়েকটি দেশের সাথে তাকে বোঝাপড়া করতে হয়েছে। দিতে হয়েছে আগাম আশ্বাস। মার্ক রুতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির পুরো সমর্থন পেলেও হাঙ্গেরি, রুমানিয়া ও তুরস্ক তার প্রার্থীতায় শুরুতে আপত্তি জানিয়েছিল। তবে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে তুরস্ক সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাথে সাক্ষাৎ করার পর তুর্কি সরকার মার্ক রুতের প্রার্থিতার উপর তাদের আপত্তি উঠিয়ে নেয়। ন্যাটোর আর এক সদস্য রাষ্ট্র হাঙ্গেরি এই মর্মে আগাম আশ্বাস আদায় করে নেয় যে রুতে ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হলে তিনি ইউক্রেনে সামরিক সাহায্য দেবার ব্যাপারে হাঙ্গেরিকে কোন ধরনের চাপ দেবেন না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হাঙ্গেরি ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধে ইউক্রেনে সামরিক সাহায্য দেয়ার বিপক্ষে। মার্ক রুতে এই মর্মে আশ্বাস দিলে হাঙ্গেরির প্রধান মন্ত্রী ভিক্টর ওরবান তার ইঙ / টুইটারে রুতের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান। অন্যদিকে রুমানিয়ার প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ক্লাউস আয়োহানিস তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলে মার্ক রুতের ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল হওয়াটা নিশ্চিত হয়ে পড়ে। ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হবার দিন কয়েক আগে মার্ক রুতে বলেছিলেন, তার জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধ। ন্যাটোর দায়িত্ব গ্রহণ করার দুদিনের মাথায় তিনি উড়াল দেন ইউক্রেনে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তিনি ছিলেন ইউক্রেনের বড় সমর্থক এবং রাশিয়ার কড়া সমালোচক। যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তবে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন–ইস্যুতে তার (রুতে) অবস্থান কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি বলেন, ‘ইউরোপের উচিত যারা ডান্স–ফ্লোরে আছেন তাদের সাথে কাজ করা।‘ উল্লেখ্য, ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা দেয়ার বিপক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন অবস্থায় ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে মার্ক রুতে কী করবেন বা করতে সক্ষম হবেন সেটি দেখার বিষয়। তবে অতীতে দেখা গেছে যে ট্রাম্পের সাথে রুতের ‘ক্যামেস্ট্রি‘ বেশ ভালো এবং ওভাল অফিসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে এক সাক্ষাতের পর ট্রাম্প রুতে সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আই লাইক দিজ গাই‘।
৩) ক্রেমলিনের ‘বেপরোয়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন‘ বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও ইউক্রেনে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কোন আসন্ন হুমকি দেখছেন না বলে জানান মার্ক রুতে। এদিকে ইউক্রেন রাশিয়ার সামরিক স্থাপনায় দূরপাল্লার পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন চাওয়ার পর রাশিয়া এই বলে হুমকি দেয় যে, পরমাণু শক্তিধর কোন দেশের সমর্থন নিয়ে ইউক্রেনের মত পরমাণু শক্তিধর নয় এমন কোন একটি দেশ যদি রাশিয়া আক্রমন করে তাহলে ক্রেমলিন তাকে ‘জয়েন্ট এট্যাক‘ বা ‘যৌথ আক্রমন‘ হিসাবে বিবেচনা করবে এবং তখন রাশিয়া তার সামরিক মতবাদ পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করবে। ন্যাটোর দায়িত্ব নেবার পর পরই রুতে ন্যাটো–সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে ইউক্রেনকে যত বেশি সহায়তা দেব তত তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ হবে।‘ ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে তার পূর্বসূরির প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে রুতে বলেন, ‘বর্তমানে ইউক্রেনকে সমর্থন করতে গিয়ে আমরা যে মূল্য দিচ্ছি তার চাইতে অনেক বেশি মূল্য আমাদের দিতে হবে যদি আমরা পুতিনকে প্রতিহত না করি।‘ মার্ক রুতে এমন সময় ন্যাটোর দায়িত্ব নিয়েছেন যখন ইউক্রেন ইস্যু ছাড়াও ইউরোপের কয়েকটি দেশে, যেমন জার্মানি, ফ্রান্স, হাঙ্গেরিতে ডান পন্থী শক্তিগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অন্যদিকে, তুরস্কের ক্ষমতায় রয়েছে পশ্চিমের দৃষ্টিতে এরদোগানের স্বৈরাচারী সরকার। কার (গাড়ি) ডিলারের সন্তান মার্ক রুতে অন্যের উপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেয়ার পরিবর্তে একটি ‘কমন গ্রাউন্ড‘ বা সবার জন্যে গ্রহণযোগ্য পথ খুঁজে বের করতে পছন্দ করেন। এখন দেখা যাক আগামী দিনগুলিতে তিনি কী ভাবে ন্যাটোর মধ্যে বিরুদ্ধ–পক্ষকে সামাল দেন। (১০–১০–২০২৪)
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।