সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরে এসে
জাতিসংঘের সামনে ঐতিহাসিক ভাঙা চেয়ার
ইংরেজিতে ”landlocked-country’ ‘ বলে একটি শব্দ আছে। যার বাংলা অর্থ ‘স্থলবেষ্টিত–দেশ’। এই স্থলবেষ্টিত দেশ এমন একটি দেশ যার সাথে সমুদ্রের কোন যোগাযোগ নেই। সাধারণত দেখা যায় যে দেশের সাথে সমুদ্রের কোন সংযোগ সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত নয়। তবে সব ক্ষেত্রে যেমন ব্যতিক্রম আছে ঠিক তেমনি এই ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন সুইজারল্যান্ড। অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের ধনী দেশগুলির যে তালিকা তার মধ্যে এই ‘ল্যান্ডলকড’ দেশ, সুইজারল্যান্ডের অবস্থান তৃতীয় স্থানে। এছাড়া রয়েছে লুক্সেমবার্গ। এই দেশটির সাথেও সমুদ্রের কোন মাখামাখি নেই। যে কটি দেশ ধনী–দেশ তালিকায় ‘টপ–টেনে’ রয়েছে তার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে মোনাকো, দ্বিতীয় কাতার। চতুর্থ স্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাত, পঞ্চম ব্রুনাই, ষষ্ট আয়ারল্যান্ড এবং সপ্তমে বিশ্বের মোড়ল হিসাবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র। অতএব, স্থলবেষ্টিত হলেই যে গরিব দেশ হবে তেমন কোন কথা নেই। তবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, খরার দেশ হিসাবে পরিচিত আফ্রিকীয় দেশ ইথিওপিয়া বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ‘ল্যান্ডলকড’ বা স্থলবেষ্টিত দেশ। কথাগুলি মাথায় এলো সুইজারল্যান্ড প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে। গেল সপ্তাহে দিন দুয়েকের জন্যে প্রাচ্যের স্বর্গ হিসাবে পরিচিত দেশটিতে যেতে হয়েছিল। জেনেভায় জাতিসংঘ সদর দফতরে আমার বাৎসরিক গ্রাউন্ড পাস নবায়ন করার জন্যে। এটি থাকলে নিউ ইয়র্ক কিংবা জেনেভায় জাতিসংঘ সদর দফতরে সহজে প্রবেশ করা যায়, দর্শনার্থীদের সারিতে দাঁড়াতে হয়না এবং আরো ভালো লাগার যা তাহলো, কোন স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে পার হতে হয়না। যে প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার সংশ্লিষ্টতা তার কল্যানে এই বিশেষ বাৎসরিক গ্রাউন্ড পাস। চাইলে কাজটি শেষ করে বিকেলে কিংবা সন্ধ্যেয় হল্যান্ড ফিরতে পারতাম। কিন্তু ভাবলাম যাচ্ছি যখন তখন সেখানে চেনাজানা প্রবাসী কয়েক বাংলাদেশীর সাথে দেখা করলে মন্দ কী। সেখানে থাকেন মানবাধিকার কর্মী খলিলুর রহমান। জেনেভার প্রধান রেলওয়ে স্টেশন থেকে হাঁটার দুরুত্বে তার রেস্টুরেন্ট, নাম ‘সাজনা’। মালিক বাংলাদেশি হলেও বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা ইন্ডিয়ান তন্দুরি হাউস। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি মালিকানায় এমন ভারতীয় রেস্টুরেন্ট রয়েছে দেদারসে। জেনেভায় স্থায়ীভাবে থাকে ভাগ্নি রিমি ও তার স্বামী সসীম। তাদের দুটি চমৎকার মিষ্টি দুটি মেয়ে, এলিনা ও রিয়ানা। এলিনার বয়স বড় জোর চার পেরিয়েছে। রিয়ানা এখনো ভালো করে কথা বলতে পারেনা। দুজনেই দাদুর জন্যে অন্তপ্রাণ। সেটিও আর একটি কারণ কাজ শেষে দিনে–দিনে না ফিরে থেকে যাবার। বছরে কম করে হলেও দুই থেকে তিনবার যাওয়া হয়। কখনো এর বেশি। বেড়াতে কোনবারই নয়, কাজে, তবে কাজ শেষে যে বেড়ানো একেবারে হয়না, তা নয়।
হল্যান্ড যদি আমার সেকেন্ড হোম হয় তাহলে সুইজারল্যান্ডকে বলতে পারি ‘থার্ড হোম’। আমি হোম ফিল করি এদেশে এলে। আমার কেন, কার না ভালো লাগে এই দেশটিকে। যাদের সামর্থ আছে তাদের তো পাহাড়–ঘেরা এই দেশটিতে একবার নয়, একাধিকবার আসা চাই। ‘এ হানিমুন ইন সুইজারল্যান্ড’ তো অনেকের কাছে একটি স্বপ্ন। যারা ‘নীল আকাশে মেঘের মেলার’ এই চমৎকার দেশটি ভ্রমণ করার সুযোগ পাননি, তারা হিন্দী ছায়াছবির রোমান্টিক দৃশ্যগুলি দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করেন। নানা কারণে সুইজারল্যান্ড অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে ভিন্ন। প্রথমেই আসে এর ‘অল–রাউন্ড ওয়েদার’। পাহাড়ি এলাকায় যখন প্রচণ্ড শীত, তখন গ্রামের দিকে গরম। সুইজারল্যান্ডের আবহাওয়ার নিজস্ব একটি গতি আছে। পাহাড়ের চূড়ায় বরফ (তুষারপাত) বছরের ছয়মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। আবার গ্রীষ্মে প্রচণ্ড ঠান্ডাও হতে পারে, স্থানভেদে। আকাশের এক কোনায় সূর্য, আবার অন্যদিকে মেঘ কিংবা বর্ষণ হলেও অবাক হবার কিছু নেই এই দেশটিতে। এমন দিনে এক ভোরে আমার যাত্রা। জেনেভা এয়ারপোর্টে নেমে সোজা বেরিয়ে মাটির নিচে রেল স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকি। বছর খানেক আগেও এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার মুখে দুটি মেশিন ছিল। তাতে বোতামে চাপ দিলেই ট্রেন–বাসের টিকেট বেরিয়ে আসতো, কোন কড়ি ফেলতে হতোনা। সেই টিকেট নিয়ে আপনি ট্রেনে বা বাসে চেপে পৌঁছে যেতে পারতেন জেনেভা শহরের মূল রেল স্টেশনে। কিন্তু এখন সুইসরাও মনে হয় ডাচদের মত ‘বেনিয়া’ হবার চেষ্টা করছেন। এখন আর বিনে–পয়সার ট্রেন বাস টিকেট নেই। এখন মেশিনে ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড ঢুকিয়ে তবেই টিকেট। হাতে কোন বাড়তি ব্যাগ নেই। তাড়াও নেই তেমন। সকাল সোয়া সাতটার ফ্লাইটে নেমেছি। রাজধানী আমস্টারডাম থেকে মাত্র ঘন্টা দেড়েকের আকাশ–পথ। স্টেশন থেকে নেমেই মিনিট পাঁচেক হেঁটে আমার হোটেল, হোটেল ক্রিস্টাল। এই সময়টায় জাতিসংঘের সদর দফতরে চলছে বিভিন্ন সেশন। ফলে দেশ–বিদেশ থেকে আসা প্রতিনিধিদের ভিড় শহরে। হোটেল ব্যবসা রমরমা, দামও উর্ধমুখী। আগে যেখানে যে হোটেলে উঠেছি তাতে এক রাতের জন্যে দিতে হতো বাংলাদেশী মুদ্রায় তের–চৌদ্দ হাজার, এখন গুণতে হলো ষোলো হাজার। হোটেল চেক–ইন সময় দুপুর দুটো। হোটেলে যখন পৌছুলাম তখন সবে সকাল সাড়ে দশ। মনে শঙ্কা ছিল চেক–ইন হবে তো? নাকি লবি হবে ঘন্টা কয়েকের আশ্রয়স্থল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। সুবেশধারী কাউন্টারের তরুণ কর্মচারী সময়–প্রসঙ্গ না তুলে, প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আমার হাতে তুলে দিলেন রুমের চাবি।
আগেই উল্লেখ করেছি জেনেভায় ফি–বছর নিদেনপক্ষে বার দুয়েক আসা হয়। একা ঘুরে বেড়াতে সমস্যা খুব একটা হয়না। কেউ থাকলে ভালো লাগে। কিন্তু কাউকে বলিনি, বলিনা, সবাই তো ব্যস্ত, জীবনের তাগিদে, প্রয়োজনে। তারপরও কয়েকজন আছেন যারা খুব কাছের। জানি তাদের বললে তারা আগ্রহের সাথে আসতেন, সঙ্গী হতেন। কিন্তু অহেতুক অন্যকে কেন কষ্ট দেয়া কিংবা অসুবিধায় ফেলা। দেশ থেকে যারা বেড়াতে আসেন তাদের কথা ভিন্ন। হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তারা স্থানীয় কারো সাহায্য ছাড়া প্রবাসে প্রায় অচল।
যাই হোক– জাতিসংঘ সদর দফতরে ব্যাপক সংস্কার–কাজ চলছে, বছর কয়েক ধরে। বিশাল যজ্ঞ। ফলে অনেক কাজ কমিয়ে দেয়া হয়েছে, দর্শনার্থীদের সংখ্যাও। কমিয়ে দেয়া হয়েছে মিটিং, সেমিনার ইত্যাদি। হোটেলের কাছেই রেল স্টেশন লাগোয়া ট্রাম স্টপেজ। সেখানে পৌঁছানোর ক্ষণিক বাদে এলো নির্দিষ্ট ট্রাম। মিনিট দশকের মাথায় পৌঁছে যাই জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে। না চেনার কোন উপায় নেই। বিশাল ভাঙা চেয়ার বিশাল জাতিসংঘ ভবনের সামনের বিশাল চত্বরে। সেই চত্বরে তখন তাবু টাঙিয়ে, স্ট্যান্ড দাঁড় করিয়ে, ব্যানার ছবি লাগিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছে দুটি গ্রুপ– একটি শ্রীলংকার তামিলদের, অন্যটা তিউনিসিয়ার। ওই দেশে সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ। জাতিসংঘ অফিসে গিয়ে বাৎসরিক গ্রাউন্ড পাস কয়েক মিনিটের মধ্যে রিনিউ করে নেই। কয়েকটি ডেস্কে একই কাজ করে চলেছেন কয়েক কর্মী। মহিলা কর্মী জানতে চান নূতন ছবি তুলবো না পুরানোটাই চলবে। প্রথমেবলি, প্রয়োজন নেই নূতনের। পর মুহূর্তে বলি, না নূতন করে তুলি। কয়েক বছরে চেহারার তো পরিবর্তন হয়েছে কিছু না কিছু। গ্রাউন্ড পাস রিনিউ করে ফিরে আসি হোটেলে। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। গতকাল ঘুম একেবারে হয়নি। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তৈরি হয়ে নেই। সুমনা নামিয়ে দিল হেগ শহরের রেল স্টেশনে। অন–লাইনে ট্রেনের টিকেট কাটা ছিল। শিফল এয়ারপোর্ট রেল–স্টেশন মাটির নিচে। এস্কেলিটর বেয়ে উঠে যাই উপরে। দোতলায় ডিপার্চার কাউন্টার। অন–লাইন বোর্ডিং করা ছিল, ফলে অটোমেটিক গেইটে পাসপোর্ট ঢুকিয়ে ইমিগ্রেশন পার, অতএব, সিকিউরিটি জোন। আমার কেবল ল্যাপটপ ব্যাগ। একদিনের সফর, তাই ল্যাপটপ আনিনি, সে ব্যাগে কেবল একটি রাতে ঘুমাবার পোশাক। হোটেলেই রয়েছে কম্পিউটার। সেখানে কাজ করা যায় চাইলে, করেছিও। ঘন্টা খানেক রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ‘সাজনার‘ উদ্দেশ্যে। সাজনার স্বত্বাধিকারী সুইজারল্যান্ডের প্রথম সারির মানবাধিকার কর্মী, খলিলুর রহমান। কিছুদিন আগে সুনীল নামে এক বাংলাদেশিকে সুইস ইমিগ্রেশন পুলিশ জোর করে প্লেনে তুলে দিতে চেয়েছিল। স্থানীয় সোসালিষ্ট পাটির্র নেতাদের ধরে তিনি ও আর এক মানবাধিকার কর্মী, অরুন বড়ুয়া এবং আরো কয়েকজন এই ব্যাপারে প্রতিবাদ, দৌড়াদোড়ি করে এই যাত্রায় সুনীলকে বাঁচিয়েছেন। তারা অভিযোগ করেন, জেনেভাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস এই ব্যাপারে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে এবং সুনীলকে দেশে ফেরত পাঠানো ঠেকানোর পরিবর্তে উল্টো কাজ করে। যাই হোক– সুখের বিষয় সুনীল এখন জেনেভায় অবস্থান করছেন এবং সেদিন তার সাথে দেখা ‘সাজনায়’। তিনি রক্ষা পেলেন, রক্ষা পেল দেশে থাকা তার পরিবার। খলিল সাহেব আমাকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘হল্যান্ড থেকে সব ঠান্ডা আপনি সাথে নিয়ে এসেছেন নাকি?’ তার পরনে মোটা সুয়েটার, কোট, মাথায় টুপি, শীত থেকে নিজেকে বাঁচানোর যাবতীয় ব্যবস্থা। উত্তরে বলি, ‘শীত পড়ছে ঠিক, তবে আপনাকে এমন দশায় দেখে আমার এখন শীত একটু বেশি পাচ্ছে।’ সাজনায় গেলে না– খেয়ে আসা খুব কম হয়েছে। সে দুপুর কিংবা সন্ধ্যে বেলায়। লাঞ্চ সেরে খলিল সাহেব সহ জাতিসংঘ ভবন, সেখানে তার কিছু কাজ ছিল। আমারও। ফেরার সময় বললেন, সন্ধ্যের সময় রেস্টুরেন্টে চলে আসুন, আপনি এসেছেন, কয়েকজনকে ডাকবো, আড্ডা হবে। সন্ধ্যেয় এলেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মিয়া, এক সময় জাতিসংঘে কাজ করতেন। সর্ব ইউরোপীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক। ছিলেন আরো এক ভদ্রলোক, নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। সুইজারল্যান্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম জমাদারও আসার কথা ছিল। এলেন যখন তখন আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেইটে। বিদায় নেব। পারলাম না। আবারো ভেতরে, আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়া। তাগিদ ছিল উঠার, কেননা হোটেলে অপেক্ষা করছে সসীম, ভাগ্নি রিমির জামাই। সুইজারল্যান্ড এলে তাদের বাসায় নিদেনপক্ষে এক বেলা তো খেতেই হবে। সসীমের সাথে অরুন বড়ুয়া। পরের জন্যে অরুন বড়ুয়া মত কেউ এতো নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন, এমন লোক খুব কম দেখেছি। সহজ সরল কিন্তু রাগলে একেবারে ভিন্ন রূপ। তাকে ভালো লাগে। সংখ্যালঘুদের জন্যে, বিশেষ করে হিন্দু–বৌদ্ধদের উপর দেশে যখনই কোন আঘাত এসেছে, তখনই তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কখনো একা, স্রেফ একা। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’– এই বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে কখনো একাই ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাতিসংঘের সামনে ঐতিহাসিক ভাঙা চেয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে। কেবল অরুণ বড়ুয়াই নয়, প্রতিদিন প্রতিবাদ জানানো হয় এই ভাঙা চেয়ারের সামনে। অন্যায়, অত্যাচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে এটি আজ এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট