৭ই মার্চের ভাষণ নিরন্তর প্রাসঙ্গিক

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১১ মার্চ, ২০২৩ at ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে এটি সুষ্পষ্ট যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তি অর্জনের ইতিহাসে একটি অনন্য সাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি ঐতিহাসিক বলা যথেষ্ট নয়। সেই ভাষণ ছিল এই ধরিত্রীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। ভাষার শক্তিতে, আবেগের স্ফুরণে এবং বক্তব্যের শাণিত ক্ষুরধারে ৭ মার্চের যুগান্তকারী ভাষণ ছিল অসাধারণ এবং অদ্বিতীয়। পৃথিবীর আর কোন দেশে কোনো রাজনীতিবিদ বা গণনায়ক কখনো এমন বলিষ্ঠ ভঙ্গিতেতেজোদ্দীপ্ত ভাষায় এবং সময়োপযোগী বক্তব্য রেখেছেন তার দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল। এজন্যই বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুকে শুধু বাঙালি জাতির জনক নয়, পৃথিবী নামক এই গ্রহে মহাকালের মহানায়ক অভিধায় অভিষিক্ত করে বিশ্বব্যাপী বিপুল সংখ্যক কবিতাসাহিত্যগানরচনায় অভিনব সৌকর্যের মোড়কে উপস্থাপিত হয়েছে। বাঙালি কবি ও লেখক অজয় দাশ তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু: আদিগন্ত যে সূর্য’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে যেসব সহজ সরল পংক্তিতে চিত্রায়িত করেছেন, তা হল “বাঙালি কি বাঙালি হয় শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি ছাড়া/ থাকে না তার বর্গ কিছুই না থাকলে টুঙ্গিপাড়া/ সুরঅসুরে হয় ইতিহাস, নেই কিছু এ দু’জীব ছাড়া/বাংলাদেশের ইতিহাসে দেবতা নেই মুজিব ছাড়া/………………. বাংলাদেশের মুক্তিও নেই মুজিব নামের সূর্য ছাড়া”।

প্রয়াত বরেণ্য সাংবাদিক শ্রদ্ধাভাজন আব্দুল গাফফার চৌধুরী’র ভাষায়, ‘৭ মার্চের এই ভাষণ বিশ্বের রাজনৈতিক সাহিত্যে একটি বিরল ভাষণ। এই ভাষণ ১৬ কোটি বাঙালির হৃদয়ে মুদ্রিত বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির মহাকাব্য।’ দেশের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ এই ভাষণকে মহাকাব্য এবং ভাষণদাতা বঙ্গবন্ধুকে মহাকবির বিশেষণে ভূষিত করেছেন। তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় অনবদ্য চরণে লিপিবদ্ধ করেছেন – “কখন আসবে কবি?/ কখন আসবে কবি?/ শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা/ জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা/ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি;/ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’/ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।”

২০১৩ সালে জ্যাকব এফ. ফিল্ড এর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘WE SHALL FIGHT ON THE BEACHES – THE SPEECHES THAT INSPIRED HISTORY’ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একচল্লিশটি ভাষণের এক অনবদ্য সংকলন। বইটির নামকরণে সম্পাদক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষণের এক উল্লেখযোগ্য বাক্য ব্যবহার করেছেন। যখন জার্মানির হিটলার ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোলান্ড এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিলে নরওয়ে দখলে নেন, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চ্যাম্বারলিকে হিটলারের এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যর্থতার জন্য পদত্যাগে বাধ্য করে চার্চিলকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। অল্প বিরতিতে ফ্রান্সসহ হিটলারের অন্য দেশ দখলের জন্য ঘধুর বাহিনীর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে ১৯৪০ সালের ৪ জুন চার্চিল তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘We shall fight on the seas and oceans, we shall fight with growing confidence and growing strength in the year………, we shall fight on the beaches,……… We shall fight in the fields and in the streets and ………, we shall never surrender” ঠিক একইভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্সে গর্জে বলেছিলেন “আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।”

উল্লেখিত গ্রন্থে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭’র রোনাল্ড রিগেনের ভাষণসহ মোট একচল্লিশটি বিশ্ব শ্রেষ্ঠ ভাষণের অন্যতম ছিল বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের The Struggle This Time is the Struggle for Independence ভাষণটি। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভাষণের মধ্যে ছিল : 431 BC  Funeral Oration – Pericles, 326 BC Address at Hydaspes River – Alexander the Great, 48 BC Address before the Battle of Pharsalus – Julius Caesar, 1453  The Final Stand – Emperor Constantine XI, 1653 Dismissal of the Rump Parliament – Oliver Cromwell, 1716 Speech to the Council of Perth – James Francis Edward Stuart, 1783 The Newburgh Address – George Washington, 1805 Speech Before and After the Battle of Austerlitz – Napoleon Bonaparte, 1862 Blood and Iron – Otto von Bismarck, 1865 Second Inaugural Address – Abraham Lincoln, 1917 An Appeal to the Read Army – Vladimir Lenin, 1917 War message to Congress – Woodrow Wilson, 1940 We Shall Fight on the Beaches – Winston Churchill, 1941 A Date Which Will Live in Infamy – Franklin D. Roosevelt, 1941 Address on the Anniversary of the October Revolution – Joseph Stalin, 1944 Serve the People – Mao Zedong, 1945 Declaration of Independence – Ho Chi Minh, 1973 Farewell to the Nation – Salvador Allende

বাংলার মানুষ কী কঠিন বাস্তবতায় পাকিস্তানের সকল শোষণকে সহ্য করেছিল এবং তারই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিকারের আশায় অসম সাহসের সাথে সকল অন্যায় অবিচারকে প্রতিরোধের শপথ নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এর প্রতিফলন ঘটেছিল অতি জোরালোভাবে। কিভাবে বাংলার মানুষের উপর নিপীড়ননির্যতন চালানো হয়েছিল এবং এদেশের আয় উপার্জন থেকে অন্যায় ও অবৈধভাবে অস্ত্র কিনে তা এদেশের জনগণ নিধনে ব্যবহার করা হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু সাবলীল ও সহজ ভাষায় অপরিসীম সাহসীকতামেধাপ্রজ্ঞার সমীকরণে তা বাংলার জনগণের কাছে তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকঠিন নির্দেশনাসমূহ এখনো অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতায় অত্যুজ্জ্বল। চলমান তথাকথিত ক্ষমতালিপ্সু দেশবিরোধী শক্তির আস্ফালন অবাঞ্চিতঅযৌক্তিক কর্মসূচি, নাশকতাসন্ত্রাসমূলক অপকর্ম ঘটিয়ে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত বিশেষ করে দেশপ্রেমিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলকে দুর্বল করার ভঙ্গুর অপচেষ্টায় নিয়োজিত। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়চেতা নির্দেশনার নিবিড় অনুকরণঅনুশীলনের আবশ্যকতা বাংলার জনগণের ধারণায় নতুন করে স্পন্দিত হচ্ছে। কঠোর আত্মসংযমআত্মনির্ভরশীলআত্মউপলব্ধির শিক্ষায় মনোযোগী হওয়ার প্রচণ্ড তাগিদআকর্ষণ এখনো নিগূঢ় অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল সকল ধর্মবর্ণশ্রমিকছাত্রধনীগরীব নির্বিশেষে সমগ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এক অভাবনীয় দিক নির্দেশনা যাতে শুধু স্বাধীনতা নয়; সামগ্রিক মুক্তির রোডম্যাপ রচিত হয়েছিল। সকল শ্রেণিপেশার বাঙালি পরবর্তীতে একটি ক্ষুধাদারিদ্রশোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে ধারণ করতে পেরেছে এবং তা বাস্তাবায়নে তাঁরই সুযোগ্য তনয়া গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিরলস সংগ্রামে সমগ্র জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

স্মরণযোগ্য যে, মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামমুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতির অসামান্য ত্যাগবিসর্জনকে স্বীকৃতি দিতে ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বসভা সমগ্র মানবজাতির জন্য অবিস্মরণীয় ঐতিহ্যিক দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বিভিন্ন সভাসমাবেশ, রাষ্ট্রীয়আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানসমূহে প্রদত্ত ভাষণগুলোর মৌলিক নির্যাস যথার্থ অনুধাবনে জাতির অগ্রগতি অবশ্যই কন্টকামুক্ত হবে। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে মুক্তিসংগ্রামের যে ঘোষণা বঙ্গবন্ধু সেদিন দিয়েছিলেন তা পরিপূর্ণ কার্যকরদৃশ্যমান করার উদ্দেশ্যে দেশের সম্পদ সুরক্ষায় এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে স্বয়ংসম্পূর্ণস্বনির্ভর করার উচুমার্গের বজ্রকঠিন উচ্চারণ এখনো জাতিকে পথ দেখানোর সর্বোৎকৃষ্ট প্রণোদনাময় অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচ্য। এরই আলোকে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে; প্রকৃত মানবসম্পদ বা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্যে নির্মোহযোগ্যমেধাবীদেশপ্রেমিক সোনার মানুষগুলোকে যথাযোগ্য মূল্যায়নে যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা না হলে জাতি শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; ভবিষ্যতকে আলোকময় করার সকল সৎ উদ্যোগও বিফলে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। মহান স্রষ্টার কাছে বঙ্গবন্ধু যেভাবে দুর্বৃত্তদের বিচার প্রার্থনা করেছেন; আপামর জনগোষ্ঠী এখনো সেই প্রার্থনায় অবিচল রয়েছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষিণ জেলা পূজা পরিষদের ঢেউটিন বিতরণ