যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর। আরো প্রায় বছর দুয়েক পর। কিন্তু এখন থেকেই নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন এই নিয়ে আলোচনা, গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। স্বাভাবিক নিয়ম অনুয়ারি নির্বাচন হবার বছর দুয়েক আগ থেকে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলীয় আগ্রহী প্রার্থীরা তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। প্রথমে তাদের লড়তে হয় নিজ দলের মধ্যে, ‘প্রাইমারীতে’। এরপর দলীয় পর্যায়ে নির্বাচিত ঘোষণার পর শুরু হয় প্রতিপক্ষের সাথে
নির্বাচনী লড়াই। তবে আগামী প্রেসিডেন্ট–নির্বাচনের প্রেক্ষিত একটু ভিন্ন। আসন্ন নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন এই নিয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট এই দুই দলের মধ্যে বেশ কটি ফ্যাক্টর কাজ করছে। রিপাবলিকান দল দিয়ে শুরু করা যাক– মাস কয়েক আগেও অনেকটা নিশ্চিত ধরে নেয়া হয়েছিল যে রিপাবলিকান পার্টি
থেকে ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই হবেন একমাত্র প্রার্থী। তার বিরোধিতা করেন তেমন কোন শক্তিশালী বা সাহসী নেতা তখন সে দলে ছিলনা। ট্রাম্পের ছিল একটি বিশাল ভোট ব্যাংক, যা রিপাবলিকান পার্টিকে পুনরায় ক্ষমতায় নিয়ে যাবে– তেমন একটা ধারণা বা বিশ্বাস ছিল দলের তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ের
নেতাদের। যে কারণে ট্রাম্পকে, তার অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসকের মত কার্যকলাপকে অপছন্দ করলেও প্রকাশ্যে তার সমালোচনা বা নিন্দে করার মত সাহস কারো ছিলনা। কয়েক মাস আগেও ট্রাম্পের রিপাবলিকান দল ও দলের বাইরে ছিল এক চেটিয়া আধিপত্য। গোটা দলকে তিনি পুরো নিজ দখলে রেখেছিলেন।
কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই পরিস্থিতি এখন অনেকটা পাল্টে গেছে। বছর খানেক আগেও দলের কেউ সাহস করেননি তার বিরুদ্ধে প্রার্থিতা ঘোষণা দেবার। ভয়, তার রোষানলে পড়বেন। আর ট্রাম্পের রোষানলে পড়া মানে রাজনৈতিক মৃত্যু। সে আমরা দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেইনীর মেয়ে
লিজ চেইনীকে। ট্রাম্পের অবৈধ কার্যকলাপের বিরোধিতা করায় এবং ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা–ভোটে ভোট দেয়ায় তাকে (লিজ) গত মধ্যবর্তী নির্বাচনে তার আসন হারাতে হয়। তবে এখন আর ট্রাম্পের সেই ‘সোনালী দিনগুলি’ নেই। এখন দলের মধ্যে অনেকেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেছেন।
আর তাতে প্রথম যিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে আগামী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি স্বয়ং ট্রাম্পের এক সময়ের অনুগত, জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, ভারতীয় বংশোদ্ভুত ৫১ বছরের মহিলা, নিকি হ্যালি। অনেক দিন ধরে কানাঘুষা চলছিল যে নিকি আগামী নির্বাচনে
প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন। কিন্তু যখন এই ধরনের কথাবার্তা বাতাসে ভাসছিল তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে দলের কারো কিছু বলা অনেকটা ভাবনারও অতীত ছিল। তাই গেল সপ্তাহে নিকি যখন এই মর্মে ঘোষণা দেন তখন অনেকেই কিছুটা অবাক হয়েছিলেন। জাতিসংঘে নিকিকে
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত করেছিলেন ট্রাম্প। এই ব্যাপারে সে–সময় নিকিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘ট্রাম্প যদি আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাহলে তিনি তাকে চ্যালেঞ্জ করবেন না’। কিন্তু নিকি এখন তার সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন এবং আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়বেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পেতে দলীয় প্রাইমারীতে লড়তে হবে আগ্রহী প্রার্থীদের। আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে এই ‘প্রাইমারী’ শুরু হবার কথা। উল্লেখ্য, নিকি দুই মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন।
ইতিমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি আগামী নির্বাচনে আবারো প্রার্থী হবেন। নিকি হ্যালির আগেও আর এক রিপাবলিকান নেতা আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে লড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি হলেন ফ্লোরিডার নির্বাচিত গভর্নর রন দিসেন্টিস। মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর এই
ঘোষণা দিয়েছিলেন ৪৪–বছরের সুদর্শন সেন্টিস। তাতে খুব ক্ষেপেছিলেন ক্ষেপাটে ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেন্টিসের সমালোচনা করে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি জানিনা তিনি দাঁড়াচ্ছেন কিনা। কিন্তু আমি মনে করি, যদি তিনি তেমনটি করেন, তাহলে তিনি নিজের জন্যে খুব মারাত্মক বিপদ ডেকে আনবেন। তিনি নির্বাচনে
দাঁড়ালে তা দলের জন্যে ভালো হবেনা‘। যে সময় সেন্টিস প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন দলের ভেতর ও বাইরের অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের বদলা হিসাবে সেন্টিস উপযুক্ত প্রার্থী। ইদানীং অবশ্য সেন্টিসের নাম খুব একটা শোনা যাচ্ছেনা। সময় বলে দেবে তিনি আদৌ এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবেন কিনা।
‘প্রাইমারীতে’ সফল হলে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় অভিবাসীদের কন্যা, নিকি হ্যালি হবেন প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রথম মহিলা এবং প্রথম এশীয়–আমেরিকান। নিকির জন্ম দক্ষিণ ক্যারোলিনায়। জন্মের সময় তার নাম ছিল নিমরতা নিকি রাধোয়া। ভারতীয় শিখ পরিবারে তার জন্ম। বাবা অজিত সিং
রাধোয়া ও মা রাজ কাউর রাধোয়া পাঞ্জাবের অমৃতসর জেলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এমিগ্রেট করেন। নিকির বাবা ছিলেন পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং মা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রিধারী। নিকির বাবা ইউনিভার্সিটি অব বৃটিশ কলম্বিয়া থেকে স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান কানাডা এবং ১৯৬৯
সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে ফিরে যান দক্ষিণ ক্যারোলিনায় এবং সেখানে এক কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। মজার ব্যাপার হলো, প্রার্থিতা ঘোষণা করার সময় নিকি ট্রাম্পের সমালোচনা থেকে দূরে ছিলেন। তবে বলেন, ’৭৫ বছরের বেশি বয়সী রাজনীতিবিদদের জন্যে বাধ্যতামূলক মানসিক দক্ষতা পরীক্ষা
দরকার’। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বয়স ৮২ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৭৬। নিকি এই দুয়ের কারো নাম উচ্চারণ না করলেও তার এই মন্তব্য যে এই দুইজনকে লক্ষ্য করে সে বলা বাহুল্য। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই নারী তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের সমালোচনা করে বলেন,
পররাষ্ট্র নীতিতে তিনি ব্যর্থ এবং আমেরিকার অবস্থান দুর্বল করে তুলেছেন। চীনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, কম্যুনিস্ট চীন ইতিহাসের ছাইয়ের স্তুপে শেষ হবে। তবে সে কাজের জন্যে এমন কাজ করতে হবে যা আমরা কখনো করিনি। যেমন এক শক্ত নখের মহিলাকে হোয়াইট হাউসে পাঠানো। সেটি কি নিজেকে
লক্ষ্য করে বলা, অনেকের প্রশ্ন।
তবে নিকি হ্যালিই একমাত্র ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান নন। প্রেসিডেন্ট লড়াইয়ে রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে আরো এক ভারতীয় বংশোদ্ভুত লড়বেন বলে গেল সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি হলেন, বিবেক রামস্বামী, বয়স ৩৭, পেশা প্রযুক্তিখাতে উদ্যোক্তা, মানবাধিকারকর্মী ও বিনিয়োগকারী। সমপ্রতি মার্কিন
গণমাধ্যম ফঙ নিউজের প্রাইম টাইম শোতে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই আমেরিকাকে শীর্ষে দেখতে চাই। তাই এ জন্যে সবার আগে আমাদের আমেরিকা কী তা বুঝতে হবে‘। বিবেকের জন্ম আমেরিকায় হলেও তা মা–বাবা এসেছেন ভারতের কেরালা রাজ্য থেকে। তবে কেবল যে এই দুই ভারতীয়
বংশোদ্ভুত আমেরিকান দলের প্রার্থিতা নিয়ে লড়বেন, তা ভাবার কোন কারণ নেই। আরো সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন, ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, মাইক পম্পিও, প্রাক্তন ন্যাশনাল নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন, ডিক চেইনি কন্যা লিজ চেইনি, এবং আরো বেশ কয়েকজন। এখন পর্যন্ত নিকি হ্যালিকে শক্তিশালী প্রার্থী হিসাবে ধরে নেয়া হচ্ছে।
রিপাবলিকান পার্টির যখন এই অবস্থা তখন দেখা যাক, ডেমোক্রেটিক পার্টির কী অবস্থা। সিটিং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতিমধ্যে ২০২৪ সালে পুনরায় নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন। তার এই সিদ্ধান্তে দলের ভেতর ও বাইরে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকেই তার প্রার্থিতার বিরুদ্ধে, প্রধানত তার বয়সের কারণে।
তাদের যুক্তি ২০২৪ সালে বাইডেনের বয়স হবে ৮২ বছর, ওই বয়সে তার চিন্তাশক্তি কতটুকু কাজ করবে এই নিয়ে অনেকের শংকা রয়েছে। শতকরা ৫২% ডেমোক্র্যাক্টস চান না বাইডেন পুনরায় নির্বাচন করুক। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দেখা গেছে, সিটিং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না করলে ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রেসিডেন্ট
পদের জন্যে লড়েন। কিন্তু বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট, কমলা হেরিস (তিনিও ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান ও প্রথম এশীয় মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট) বিগত দুই বছরে তেমন কোন ক্যারিশমা দেখাতে পারেননি। ফলে দল থেকে তিনি মনোনয়ন পাবেন তেমন সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। এই ব্যাপারে
তিনিও এখনো পর্যন্ত মুখ খুলেননি। শুরুতেই বলেছি, নির্বাচনের আরো প্রায় বছর দুয়েক বাকি। এই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটতে পারে। কোন দুই প্রার্থী শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে নির্বাচনী মাঠে অবতীর্ণ হবেন সেটা দেখার জন্যে আমাদের আরো অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট











