দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, ২০০১ সালের ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে চার দলীয় ঐক্যজোট সরকারের দীর্ঘ পাঁচ বছরের দুর্নীতি–অর্থপাচার–সন্ত্রাস–অপশাসন–মানবাধিকার লঙ্ঘনে জাতি চরম হতাশায় নিমজ্জিত ছিল। নির্বাচনে জয়লাভ করার পরক্ষণেই ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত
করতে একের পর এক দীর্ঘ মেয়াদী ঘৃণ্য অপকৌশল প্রয়োগে ছিল অতিশয় তৎপর। দেশব্যাপী বিরোধী দলের নেতা–কর্মী ও সংখ্যালঘুদের উপর শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। তাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর–জ্বালিয়ে দিয়ে এবং হত্যার মাধ্যমে চলছিল বীভৎসকর নারকীয় উৎসব। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে করা হয়
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দলীয়করণ। দেড় কোটি ভুয়া ভোটার সৃষ্টিসহ নানা অপকর্মে নির্বাচন কমিশনকে এক তামাশার কেন্দ্রে পরিণত করে। কথিত বাংলাভাইসহ জঙ্গীবাদের উত্থানের বিষয়টি কারো অজানা নয়। বিরোধী দলের নেতৃত্বকে পরিপূর্ণ পর্যুদস্ত করে ভয়াবহ সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করার হীন উদ্দেশ্যে
পরিচালিত হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলা। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে চিরতরে নিঃশেষ করার অশুভ অপচেষ্টার আড়ালে ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ–জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনাকে স্বমূলে উৎপাটন। সমসাময়িক পাকিস্তানের মতো দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পক্ষে
ভঙ্গুর রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তনই ছিল এতসব অপকর্ম–অসহনীয় কর্মযজ্ঞের সমীকরণ। তাদের অপরাজনীতি দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে আপামর জনজীবনে বিরাজিত ছিল যারপরনাই অনিশ্চয়তা–আতঙ্ক। ঐক্যজোটের দুঃশাসন–দুর্নীতি–লুটপাটের অবর্ণনীয় অবস্থাসহ একতরফা নির্বাচন নিয়ে তাদের অনড় অবস্থানে
সৃষ্ট উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে তথাকথিত সুশীলসমাজ–আন্তর্জাতিক মহল ও গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির অপতৎপরতায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি আবির্ভাব ঘটেছিল কথিত এক–এগারোর।
নানা গুজব–গুঞ্জন–উত্তেজনাকর ঐদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ডগলাস ফসকেট, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইনোওয়ে মাসাইয়েকি, ইউরোপীয় কমিশনের ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত ড. স্টিফান ফ্রোইন, কানাডিয়ান হাইকমিশনার ও
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রেনাটা ডেজালিয়েন এর মধ্যে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং হলেও আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কেউই কিছু প্রকাশ করেননি। বিদেশি কূটনীতিকদের সাথে প্রধান দলগুলোর বৈঠকের পূর্বে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি আইন–শৃঙ্খলা
সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি, আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন। এর পরপর বৈঠক করেন তিন বাহিনীর প্রধানদের সাথে। বাতিল করা হয় উপদেষ্টা পরিষদের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক। বঙ্গভবনের বৈঠক শেষে সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ বিমান–নৌ বাহিনী প্রধান, পুলিশের
মহাপরিদর্শক, র্যাব–বিডিআরসহ সব আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানদের নিয়ে সেনাসদরে বৈঠক করেন। রাত সাড়ে আটটায় উপদেষ্টাদের পুনরায় বঙ্গভবনে ডেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সবাইকে পদত্যাগের অনুরোধ জানানো হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে
সরে দাঁড়ান এবং অন্য উপদেষ্টারাও পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ড. ফকরুদ্দিন আহমেদকে। সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ গোলযোগে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন এবং বিপদের সম্মুখীন হওয়ার কথিত সম্ভাবনায়
সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে গঠিত হয় সেনাসমর্থিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’।
উদ্বেগ–উৎকন্ঠায় অপেক্ষমাণ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জানান, একই সঙ্গে দুটি দায়িত্ব নেয়ার পর তাকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়। এই অবস্থায় সকল রাজনৈতিক দলের আংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথকে সুগম করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ
থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাতে সরকারের তথ্য অধিদফতর থেকে মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে রাজনৈতিক সংবাদ ও সরকারের সমালেচনামূলক সংবাদ প্রচারে বিরত থাকার জন্য বলা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে টিভিচ্যানেলের খবর ও টকশো বন্ধ করে দেয়। অনভিপ্রেত–অনাকাঙ্ক্ষিত এমন
পরিস্থিতিতে সেনাসমর্থিত সরকারকে দেশবাসী স্বাগত জানালেও অতি শীঘ্রই এই সরকারের মুখোশ উম্মোচিত হতে থাকে। তাদের নানা কর্মকাণ্ড বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তাদের ভাষায় রাজনীতি ‘ক্লিন বা পরিষ্কার’ রাখার জন্যই ছিল সে চেষ্টা। অবাধ, সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবর্তে এই সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিরাজনীতিকরণের নিখুঁত প্রচেষ্টা। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে প্রায় প্রতিটি রাজনীতিবিদদের দমন–পীড়নসহ তাদের দুর্নীতিবাজ প্রমাণে সচেষ্ট থাকে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর
অনেক সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করে বিশেষ আদালতে তাদের সাজাও দিয়েছিল। এক–এগারোর কুশীলবরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বললেও তাদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ছিল পক্ষপাততুষ্ট।
বিভিন্ন গণমাধ্যম–রাজনীতিক–জনশ্রুতিমতে সে সরকারের সর্বাপেক্ষা বড় কুকীর্তি হচ্ছে ‘মাইনাস টু’ থিওরি বাস্তবায়নের অপচেষ্টা। সোজা কথায় দেশের বিদ্যমান রাজনীতিবিদদের রাজনীতি থেকে অবসরে পাঠানোর পদক্ষেপ। তাদের বিশেষ তৎপরতা ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংস্কারপন্থী গ্রুপ সৃষ্টি
করে দুই দলকে নেত্রীমুক্ত করে একটি বিকল্প শক্তিকেন্দ্র গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে উভয় দলের মধ্য থেকে অবাস্তব–অবান্তর এই পরিকল্পনা পরবর্তীতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। তৎকালীন ডিজিএফআই পরিচালকের বর্ণনা মতে, দুই দলের অনেক নেতাও সোৎসাহে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই এবং ৩ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে দুইনেত্রীকে আটক করে জাতীয় সংসদ ভবনের দুটি বাড়িকে সাব জেল বানিয়ে বন্দি রাখা হয়। যদিও দুই নেত্রীকে প্রকাশ্য দৃশ্যপটে আনা হয়; মূলত এই দূরভিসন্ধির টার্গেট ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। সংসদ ভবনের একটি কক্ষে বসানো আদালতে
শেখ হাসিনার বিচারের নামে চলছিল প্রহসনের বিচার। যেখানে অন্য কোন আইনজীবীর প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। শেখ হাসিনার মামলা পরিচালনায় এগিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যরিস্টার রফিক–উল হক এবং ব্যারিস্টার শফিক আহমেদসহ আওয়ামী লীগ দলীয় কিছু ত্যাগী–পরিশুদ্ধ আইনজীবী।
মামলার অভিজ্ঞতা বর্ণনায় ব্যারিস্টার রফিক উল হক বাধ্য হয়ে বলেন, ‘যেভাবে আদালতে বিচারের নামে প্রহসন চলছে, তাতে আইনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে মুক্ত করা কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভব হবে না।’
শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আটক করেই উল্লেখ্য সরকার ক্ষান্ত হয়নি, বিশেষ সংস্থা কর্তৃক আটক ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে অনেক মাঝারি ব্যবসায়ীকে। এছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কিছু সদস্য বর্ষীয়ান সাংবাদিকের সহায়তায় বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক কোটি কোটি টাকা
আদায় করার অভিযোগও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সুশীলদের অনুধাবনে এতটুকু ধারণা ছিল না যে, রাজনৈতিক লড়াইয়ে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনভাবে ঠিকে থাকা সম্ভবপর নয় আর শেষ পর্যন্ত এ দেশের জনগণ রাজনীতিবিদদের উপরই আস্থা রাখে। রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়া
জনগণের একাংশ প্রথম দিকে এসব কর্মকান্ডে উল্লসিত হলেও শেষ পর্যন্ত তারাও এর প্রয়োজনীয়তা ও সুফলের ব্যাপারে আস্থা হারায়। এভাবে ক্ষুব্ধ জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন পেয়েও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা আর ধরে রাখতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুচ্ছ ঘটনায় ছাত্রদের সাথে সেনা
সদস্যদের সংঘর্ষ ও প্রতিবাদী কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে কারাগারে প্রেরণের ঘটনা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিজ্ঞ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, তথাকথিত রাজনৈতিক সরকার চেষ্টা ব্যর্থ হবার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং দলের অভ্যন্তরে জননেত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান–ভাবমূর্তি অধিকতর
উচুমাত্রিকতায় সুসংহত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে চলমান রাজনৈতিক বিশ্লেষণে শীর্ষ নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহস বা ইচ্ছা কারো নেই।
সাধারণ মানুষের ধারণা, জনগণ প্রত্যাখিত ও প্রচণ্ড অজনপ্রিয় কতিপয় ব্যক্তি বিশেষ–প্রতিষ্ঠানের নির্লজ্জ চক্রান্ত–ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়ে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ গণ প্রতিরোধে এর অবসান ঘটলেও এখনও একইভাবে সমচরিত্রের কুশীলবরা গোপনে–অদৃশ্যে তাদের
পূর্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে তাদের বেপরোয়া পদচারণা জোরালোভাবে পরিলক্ষিত। দেশের সার্বিক অদম্য উন্নয়ন অগ্রগতির বিশ্বস্বীকৃত অবস্থানকে প্রাধান্য না দিয়ে বৈশ্বিক সংকটের ধারাবাহিকতায় পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও ডলার–জ্বালানি সংকট ইত্যাদি অধিকমাত্রায় উচ্চকিত করে
অযাচিতভাবে জনগণকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়সমূহের বস্তু–সত্যনিষ্ঠ যাচাই বাছাই ব্যতিরেকে অপসাংবাদিকতায় বিশ্বাসী কিছু চিহ্নিত সাংবাদিক–কথিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আনাগোনা–ঘনঘন বিদেশি দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ–সহযোগী রাষ্ট্র ও দাতা সংস্থাসমূহকে পত্র প্রদানের মাধ্যমে দেশবিরোধী জঘন্য
অপপ্রচার দেশবাসীর হৃদয়ে সন্দেহ–সংশয় তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা চলমান রয়েছে। সুশাসন–মানবাধিকার–নির্বাচন–গণমাধ্যমের স্বাধীনতা–ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা ইস্যু নিয়ে সুশীলদের অবাঞ্ছিত–অযাচিত আলোচনা–সমালোচনা সম্পর্কে দেশবাসী সম্পূর্ণ সচেতন। যে কোন অন্ধকারের পরাজিত–সাম্প্রদায়িক–
অগণতান্ত্রিক–সন্ত্রাস ও জঙ্গিনির্ভর অপকৌশল–অপকর্ম রুখে দিতে দেশপ্রেমিক প্রতিরক্ষা–আইনশৃঙ্খলা বাহিনী–সমূহ গোয়েন্দা সংস্থাসহ দেশের আপামর জনগণ দৃঢ়চিত্তে কঠিন ঐক্যবদ্ধতায় আবদ্ধ – নিঃসন্দেহে তা দাবি করা মোটেও অযৌক্তিক নয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়