কোন কিছু কারো উপর– সে দেশ হোক কিংবা ব্যক্তি, বিশেষ করে স্বাধীনচেতা জনগণের উপর চাপিয়ে দিলে তা যে ধোপে টেকেনা তার প্রমাণ ‘উর্দু ভাষা’। জন্মলগ্ন ১৯৪৭ সাল থেকে জনসংখ্যার দিক থেকে লঘু হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তর বাঙালি গোষ্ঠীর উপর জোরজবরদস্তি উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।
বাঙালিকে দাবাতে গিয়ে দেবে গেল পাকিস্তান, চিরতরে, একাত্তর সালে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাঙালিরে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’। পারেনি। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মোহাম্মদ আলী জিন্নার সেই দাম্ভিক উক্তি ‘উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। সেখানেই হলো কাল, পাকিস্তানের পচন শুরু হলো সেই থেকে।
ভাষার উপর কোন আঘাত আত্মসচেনতা সম্পন্ন কোন জাতি সহ্য করতে পারে না। পারেনি বাঙালি। পারেনি বলেই ‘মাতৃভাষা বাংলা চাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি এক সময় স্বাধিকার আন্দোলন, তারপর স্বাধীনতা আন্দোলনে গিয়ে পূর্ণতা লাভ করে ১৯৭১ সালে, এক নদী রক্ত পেরিয়ে। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাঙালি জাতি মায়ের ভাষার জন্যে যেভাবে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে আর কোন জাতি সেই ত্যাগ দিয়েছে কিনা আমার জানা নেই। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন দেখিনি। তখন আমার জন্ম হয়নি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের কাহিনী আগ্রহভরে পড়েছি, ছবি দেখেছি।
অনুপ্রাণিত হয়েছি। পাকিস্তান শাসনামলে প্রতি একুশের ভোররাতে, নগ্ন পায়ে, বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে, ব্যানার উঁচু করে ধরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাগানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গেয়ে গেয়ে এগিয়ে গেছি শহীদ মিনারের দিকে।
যে সময়ের কথা বলছি তখন বাংলা কাগজে–কলমে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেলেও ‘মর্যাদা‘ বলতে যা বুঝায় তা পায়নি। যে সরকারি পাড়ায় বড় হয়েছি তাতে মোট ১৮টি পরিবার বাস করতো।
এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি পরিবার ছিল অবাঙালি, দুটি পাঞ্জাবি, তিনটি পরিবার বিহারি। বাকি ১৩টি পরিবার বাঙালি। অবাঙালি ছেলে–মেয়ে যারা আমাদের সমবয়সী, যাদের সাথে আমরা ক্রিকেট, বেডমিন্টন, লুডু খেলতাম, আড্ডা দিতাম, তাদের সাথে আমাদের বলতে হতো উর্দু। এটি ছিল যেন এক অলিখিত নিয়ম। আমাদের মনে কখনো প্রশ্ন জাগেনি যে কেন আমরা সংখ্যায় বেশি হয়েও একটি ভিন–ভাষায় কথা বলছি। আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল যে ‘তোমাকে উর্দুতেই কথা বলতে হবে’।
আমাদের মাথায় এটিও ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল যে উর্দু হচ্ছে মুসলিমের ভাষা, বাংলা সংস্কৃত–ভাষা থেকে আমদানি করা, সে হিন্দুদের ভাষা, অতএব বাংলা ‘ছোড়ো, উর্দু বোলো’। ধর্মের দোহাই দিয়ে যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি সে যে কত ঠুনকো ছিল সে আমরা পাকিস্তান সৃষ্টির বছর না পেরোতেই টের পেতে থাকি।
পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে বাঙালির উপর উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার জন্যে। শাসন শোষণ–নির্যাতন করেছে। তা বারবার প্রতিহত করেছে বাঙালি ছাত্র–শিক্ষক–জনতা। বাংলা ভাষা নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের মনোভাব কখনই সহনশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন ছিলনা। এই প্রসঙ্গে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়।
পাকিস্তান সেন্ট্রাল পাবলিক কমিশনের সেক্রেটারি দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা–সম্পর্কিত একটি সার্কুলার জারি করলেন। তাতে ৩১টি কোর্সের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, যার মধ্যে নয়টি ছিল ভাষার উপর। এই নয় ভাষার মধ্যে ছিল উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, জার্মান, এমন কী ‘মৃত ভাষা’ হিসাবে পরিচিত ল্যাটিন ও সংস্কৃত।
কিন্তু পাকিস্তানের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে এই তালিকা থেকে বাদ দেয়া হলো। এর মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর কী পরিমাণ অসম্মানবোধ। প্রতিবাদলিপি ছাপা হলো ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায়। ডিসেম্বর নাগাদ সম্পাদকীয় লিখলেন আবুল মনসুর আহমদ। পরবর্তীতে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এই ভুলের জন্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন।
তারপর তো জিন্নাহর সেই দাম্ভিক উচ্চারণ, ‘উর্দু অনলি উর্দু সেল বি দ্য স্টেট ল্যাংগুয়েজ অফ পাকিস্তান’। উর্দু তো পাকিস্তানের– একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হতেই পারলো না বাঙালির তীব্র প্রতিবাদ, আন্দোলন আর রক্তদানের মুখে। পাকিস্তান মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মাথায়।
পাকিস্তান গেছে। কিন্তু তার প্রেতাত্মারা এখনো আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। নানাভাবে, নানা রূপে। রমনা বটমূলে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখকে আহবান জানাতে গিয়ে এই পাক–প্রেতাত্মাদের বোমায় প্রাণ হারায় হরকতুল আল জিহাদি আল ইসলামীর এক সন্ত্রাসী সহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত দশ দর্শক–শ্রোতা, আহত হন অনেকে।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব, যেমনি এখন প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। স্কুল–কলেজ বয়সে একুশের মিছিলে অংশ নিয়ে গান গাইতে গাইতে যখন শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যেতাম তখন আমাদের ভাবাবেগ ছিল ভিন্ন। এক ধরনের আবেগ কাজ করতো আমাদের মাঝে। এখন এই একুশকে ঘিরে গোটা দেশ জুড়ে চলে দিনব্যাপী, মাসব্যাপী উৎসব, নানা অনুষ্ঠান, বই মেলা, গানের আসর, কবিতা–গল্প পাঠের আসর, বই প্রকাশনা উৎসব, মেলা ইত্যাদি।
বিগত বছরগুলিতে বার কয়েক গিয়েছিলাম এই ধরনের কোন কোন অনুষ্ঠানে। প্রচুর লোক–সমাগম দেখেছি, তরুণ–তরুণীদের উচ্ছাস দেখেছি, তাদের হেসে–আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে দেখেছি। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় এই যে যাবতীয় আয়োজন, এই বিশেষ দিনটিকে ঘিরে তার পেছনে যে আত্মত্যাগের ইতিহাস সেই ইতিহাস সম্পর্কে তারা খুব একটা জানেনা।
সেটি এমন নিশ্চিত করে বলতে পারছি এই কারণে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের সাক্ষাৎকারে শহীদ মিনার কিংবা একুশে বই মেলায় আসা তরুণ–তরুণীদের কাছে জানতে চেয়েছিল এই দিনটি সম্পর্কে। অবাক করা তাদের বেশির ভাগ সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। এর চাইতে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে।
প্রশ্ন–এর জন্যে দায়ী কে? দিনটিকে না–জানা ওই তরুণ–তরুণীরা? নাকি অন্য কোথায়ও এর শেকড়? ওদের মধ্যে এই নিয়ে চেতনাবোধ জাগাতে না পারার ব্যর্থতা কার? রাষ্ট্রের না পরিবারের? পরিবারের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। এইবার দেশে গেলে এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম দিন কয়েক। দেখলাম আর্থিকভাবে সচ্ছল এক তরুণী–মা তার আদরের ছেলেকে আদর করে বলছে, ‘ব্যাটা (উচ্চারণে উর্দু টোন) এটা খাও’, ‘ব্যাটা ওটা করো’ ইত্যাদি। আমার কানে খটকা লাগে।
আদরের ছেলেকে ‘বেটা বেটা’ বলে ডাকতে হবে কেন? ব্যাঙলায় কি এর চাইতে সুন্দর, মধুর শব্দ নেই? একই প্র্যাকটিস দেখেছিলাম বছর কয়েক আগে, উঁচু পর্যায়ের এক আমলা–বন্ধুর সরকারি বাসভবনে। এতে কি তাদের আভিজাত্যে কিছু যোগ হয়, আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। নাকি এ সব তাদের চিন্তাধারা, মন–মানসিকতার কারণে? এই যেমন আমাদের ইংরেজি–প্রীতি।
আমাদের অনেকের মাঝে কথায় কথায় দু–চারটে ইংরেজি বাক্য, নিদেনপক্ষে ইংরেজি শব্দ না বললেই নয়। কিছুদিন আগে লন্ডনে থাকা এক বাঙালি দম্পতি যেন খুব গর্বের সাথে বললেন, ‘আমাদের সাত বছরের ছেলেটি দুর্দান্ত ইংরেজি বলে, একেবারে ইংরেজি একসেন্ট’।
আমি খুব একটা উৎসাহিত বোধ করিনা। উত্তরে বলি, ‘সে কি বাংলা বলতে পারে?’ ‘খুব একটা না’, তাদের দুজনের তড়িৎ উত্তর, ‘তবে ভালো ইংরেজি বলে’। তাদের বলি, “আপনাদের ছেলে লন্ডনে বড় হচ্ছে, আপনারা না চাইলেও সে ইংরেজি শিখবে।
সেটিই তো স্বাভাবিক। সেতো আপনাতেই হবে। কিন্তু আপনারা যদি তাকে না শেখান, ক’দিন বাদে তো সে তার মায়ের ভাষা, ‘বাংলা’ ভুলে যাবে”। আমার কথায় কোন কাজ হয়েছে বলে মনে হলোনা। তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। এটি কেবল লন্ডনে থাকা এই মা–বাবার মানসিকতা নয়, এটি প্রবাসে থাকা সব না হলেও বেশির ভাগ বাঙালি মা–বাবার দশা।
জীবনের অর্ধেক বয়সে হল্যান্ড আসা মা–বাবারা তাদের সন্তানদের সাথে কথা বলেন ডাচ ভাষায়। প্রায় ক্ষেত্রে ভুল উচ্চারণে ও ভুল ব্যাকরণে। তাতে একদিকে যেমন সন্তানের ডাচ ভাষার ‘বারোটা’ বাজে, অন্যদিকে তারা সন্তানদের বঞ্চিত করেন মাতৃভাষা জানার, শেখার অধিকার থেকে। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে এখানে–ওখানে যেতে হয়।
সেখানে যখন দেখি এদেশে জন্ম–নেয়া ও বেড়ে উঠা ছেলে–মেয়েরা তাদের মা বাবাকে, ‘মামি’, ‘পাপা’ কিংবা আরো আদর করে ‘পাপ’ ডাকে, তখন আমার মনে হয় একী পাপ! এক সময় ওদের কাউকে কাউকে বলতাম, তোরা যদি মা–বাবাকে মামা–মামী ডাকিস তাহলে তোদের মায়ের ভাই (মামা) কিংবা তার স্ত্রীকে (মামী) কী বলে ডাকবি? দোষ ওদের নয়।
দোষ আমাদের মত ‘না ঘরকা না ঘটকা’ জাতীয় মা–বাবার। যাদের অনেকে জানেননা তাদের মূল শেকড় কোথায়। যাদের নিজেদের মধ্যে নেই মায়ের ভাষাকে ভালোবাসার তাড়না। নিজেদের মধ্যে যদি এই বোধটুকু না থাকে তাহলে তারা তা প্রোথিত করবেন কী করে পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর!
প্রবাসে স্থায়ীভাবে বাস করা আমার মত কেউ কেউ হয়তো এই–দিকটার অভাব অনুভব করেন আর মনে মনে পীড়া ভোগ করেন। এছাড়া আর উপায় কী! আমেরিকা–ইউরোপ–অস্ট্রেলিয়ায় যারা আছেন, যাদের সন্তান বড় হচ্ছে, তারা একদিন যদি বাংলা ভাষাকে একেবারেই ভুলে যায়, তাহলে আর কেউ অবাক হলেও আমি অবাক হবোনা। হল্যান্ডে কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে গেলে দেখি একদিকে বুড়োরা অর্থাৎ মা–বাবারা, অন্যদিকে শিশু থেকে শুরু করে কিশোর পর্যায়ের ছেলে–মেয়েরা জটলা পেকেছে।
বুড়োরা বাংলা বলে চলে, কিন্তু দুর্ভাগ্য ছেলে–মেয়েরা– তারা সমানে হয় ডাচ নয়তো ইংরেজি। এ দৃশ্যে আর কার কেমন লাগে জানিনা, আমার ভালো লাগে না, আমার কষ্ট লাগে। এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে এরা অন্য ভাষা শিখুক তা চাই না। আমি বাংলা ভালো জানি, ইংরেজি ভালো জানি, ডাচ জানি, উর্দু, হিন্দি বলতে পারি, দু–একটা জার্মান বাক্য ও ফরাসি শব্দও।
ভাষা যত বেশি শেখা যায়, জানা যায় তত ভালো। তাতে জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। অনেক কিছু জানা যায়, অনেকের সাথে স্বচ্ছভাবে ভাব বিনিময় করা যায়। কিন্তু মায়ের ভাষাকে ভুলে গিয়ে নয়। কিছুতেই নয়। মা–কে ‘মা’ বলে ডাকার মাঝে যে প্রাণের ছোঁয়া মেলে, তা আর কোন ভাষাতে নয়। নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি দিয়ে আজকের এই লেখা শেষ করবো।
তিনি বলেছিলেন, “যদি তুমি কারো সাথে কথা বলো এমন ভাষায় যেটি তিনি বুঝেন, সেটি তার মাথায় প্রবেশ করে বটে, কিন্তু তুমি যদি তার–ভাষায় কথা বলো, তাহলে সেটি পৌঁছে তার অন্তরে”। মায়ের ভাষা, বাংলার জন্যে যে সকল বাঙালি–সন্তান রক্ত দিয়েছেন, যাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের স্মরণ করছি আজকের এই ভাষার মাসে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট