কাল ফিরে যাব ঘরে, দিন শেষে পাখি যেমন ঘরে ফেরে। ঠিক তেমনি। কথা হলো আমার ঘর কোথায়? হল্যান্ড না বাংলাদেশ? হল্যান্ড সে যত স্বর্গসম দেশ হোক না কেন, ঘর সে আমার কখনো হতে পারেনা। যদিও বা পরকে–ঘর করা এই অতি উন্নত ইউরোপীয় দেশটি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে, যা আমি দেশে কস্মিনকালেও হয়তো পেতাম না। দেশে পথ চলতে গিয়ে বাস, ট্রাকে চাপা পড়ে সাধের জীবন যাবার অযুত সম্ভাবনা নেই সে দেশে।
নেই প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি নামক ক্যান্সার। এবার দেশে এসে আবারো দেখলাম ভুক্তভোগীদের কী করুণ দশা। সরকারি অফিসে। এক পর্যায়ে এক তরুণী মা কেঁদেই ফেললেন। বললেন, এন আই ডি কার্ডে নামের বানান ভুল হওয়ায় তার মেয়ে পরীক্ষা দিতে পারছেনা। তার অশ্রুভেজা চোখ দেখে আমার মনটা কাতর হলো, কিন্তু যার কাছে এই মহিলার আবেদন–নিবেদন তিনি সীমারের মত বললেন, ‘এই সব ইমোশনাল ব্যাপার–স্যাপার এখানে দেখিয়ে লাভ হবে না‘।
পাশে থাকা বন্ধু নিচু স্বরে বলে, ‘ফেল কড়ি মাখো তেল‘। এত বছর পর আমাকেও যেতে হলো সোনার হরিণ নামক এই ‘এন এই ডি‘ কার্ডের জন্যে। শুরুতে আমাকে কিছুটা ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে। সেটি আরো দীর্ঘায়িত হতো যদি আমার দুই ক্ষমতাধর বন্ধু হস্তক্ষেপ না করতেন।
তাদের একজন উচ্চ পর্যায়ের এক আমলা বন্ধু (এডিশনাল সেক্রেটারি) আর একজন চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ডাক্তার সেলিম আকতার চৌধুরী। যাই হোক –দীর্ঘ দু–মাস অনিয়ম আর অব্যবস্থার মাঝে থেকে আমার আবারো ঠাঁই হবে অতি সভ্য ও উন্নত একটি দেশে যেখানে মানুষের জীবন নিয়ম আর সময়ের বেড়াজালে কাটে। এবার অনেকটা সময় কেটেছে নিকট বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, গল্পগুজব করে, আর কিছু পারিবারিক কাজ নিয়ে।
পরিচয় ঘটেছে বেশ কিছু নতুনের সাথে। তাদের মধ্যে রয়েছেন নামকরা ডাক্তার, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক সহ বিভিন্ন পেশাজীবী। আগেই লিখেছি এই ‘কলামে‘ দেশে এলে গোটা সময়ের সিংহভাগ কাটে চাটগাঁয়। অথচ ঢাকায় থাকে আমার নিকটজনেরা, আপন ভাই–বোন, তাদের ছেলে–মেয়েরা।
কিন্তু ঢাকা আমায় টানে না। অসহনীয় ট্র্যাফিক জ্যাম ছাড়াও সেখানকার মানুষগুলোও (ব্যতিক্রম ছাড়া) আমার কাছে মনে হয় চাটগাঁর লোকজনের মতো অন্যকে কাছে টানেনা। সিনিয়র্স ক্লাবের কথাই যদি ধরি, তাহলে বলতে হয়– সেখানে যাদের সাথেই পরিচয় ঘটেছে তাদের সবার কাছ থেকে পেয়েছি আন্তরিকতার ছোঁয়া। কোন লোক–দেখানো নয়। ক্লাবে আমার এই পরিচিতির সংখ্যা বেড়েছে, বলতেই হয়, বন্ধু ডাক্তার সেলিম চৌধুরীর কল্যাণে।
সময়ে–অসময়ে, বিনা প্রয়োজনে তিনি ফোন করে ডেকে নিতেন, কখনো গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন, নিজেও বাসা থেকে যাবার পথে তুলে নিতেন, কিংবা ক্লাব থেকে ফেরার সময় বাসার সামনে নামিয়ে দিতেন। সদস্য না হয়েও ক্লাবের বোর্ড মিটিং উপস্থিত থেকেছি। সবার আন্তরিকতা পেয়েছি, পেয়েছি বন্ধুসুলভ আচরণ।
বোর্ড সদস্যদের সবাই নিজ নিজ পেশায় সফল, সে পরবর্তীতে পরিচয় হয়ে জানতে পারি। যে বিষয়টি ভালো লেগেছে তা হলো, তাদের কারো মাঝে সামান্যতম অহংবোধ বা অহমিকা চোখে পড়েনি। অথচ অনেক সময় কাউকে কাউকে দেখি ‘আমি কী হনুরে‘ জাতীয় হাবভাব, কিছু না হয়েই।
এদের মধ্যে যাদের কথা মনে থাকবে তারা হলেন, কমিটি সদস্য এম এয়াকুব আলী। পটিয়াকে নিয়ে তার অনেক গর্ব। আমার বাড়ি পটিয়া জানতে পেরে সুদর্শন এই ব্যবসায়ী–রাজনীতিবিদ বলেন, ভালো লাগছে দেখে আমাদের পটিয়ার অনেকে বিদেশে ভালো অবস্থানে আছেন। মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম (মিরাজ), নব–নির্বাচিত কমিটি সদস্য। যখনই দেখা হয়েছে হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আব্বাস, মনে হলো স্বল্পভাষী,
কিন্তু বিনয়ী। মজার চরিত্র দুলাভাই। আসর জমাতে পারেন বেশ। ব্যবসার পাশাপাশি বাইরের খবরাখবর বেশ রাখেন বলে মনে হলো। ক্লাবের প্রেসিডেন্টের কল্যাণে মাঝে মধ্যে নির্দিষ্ট কামরায় খাবারের সাথে চলতো ধুমসে আড্ডা। ধারে–কাছে ফরমায়েশ খাটার জন্যে স্ট্যান্ডবাই থাকতো চটপটে তরুণ, রতন।
প্রেসিডেন্ট যখন তাকে ডাকেন, মনে হতো সে ডাক ক্লাবের বাইরে গিয়ে পৌছাতো। গতকাল দুপুরে এমনি এক আড্ডায় ক্লাবে পরিচয় লালা বাবুর সাথে, পুরো নাম জি কে লালা। তার রয়েছে হোটেল ব্যবসা। তার বাড়িও পটিয়া। বললেন, দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার পড়েন। মোবাইল খুলে দেখালেন কক্সবাজার সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার চমৎকার হোটেলের ছবি।
সিনিয়র্স ক্লাবের সাথে আমার প্রথম পরিচয় বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার দত্তের মাধ্যমে। দেশে এলে তিনি আমন্ত্রণ জানাতেন ক্লাবে। পানীয়ের সাথে বেশন দিয়ে লইট্টা মাছ ভাজি প্রথম খাইয়েছিলেন তিনি। রাশিয়া থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাশ দিয়ে এলেও বনে গেলেন সফল গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। ছাত্র হিসাবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করেছিলেন। এখন তো দেদারসে দেশ–বিদেশের বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায় ইংরেজিতে লেখালেখি করছেন। মূলতঃ গবেষণাধর্মী লেখা। তার সাথে প্রথম পরিচয় নব্বই–দশকের শুরুর দিকে। সাংবাদিক বন্ধু মনসুরের (ওসমান গনি) সাথে তিনি স্বস্ত্রীক (ডাক্তার ও লেখিকা অঞ্জনা দত্ত)
গিয়েছিলেন হল্যান্ড। আমাদের সাথে ছিলেন দিন কয়েক। তারপর থেকে দেশে এলে ক্লাবে তার অতিথি। জীবনে লিফটে প্রথম আটকে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল তার সাথে। ঘটেছিল এই চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাবে। সে সন্ধ্যায় বাইরে ঝড়ো–বৃষ্টি। বারে যাবো। লিফটে তিনে বোতাম টিপ্ দিতেই বিদ্যুৎ গেল চলে, লিফট
গেলো আটকে। আর আঁতকে উঠি আমি। আমার সাথে ছিল সুমনা, আমার স্ত্রী। প্রদীপদার অনেক ডাকাডাকির পর লোক এলো, আমরা বেরিয়ে এলাম। বন্ধু ডাক্তার সেলিমকে ঘিরে যে টিম, সেই টিম এবং টিমের প্রায় সকল সদস্যদের সাথে পরিচয় হয়েছে ইতিমধ্যে। কেবল পরিচয় না, আড্ডা দেয়া হয়েছে বেশ
কয়েকবার। টিমের বাইরেও সদস্যদের অনেকের সাথে পরিচয় হয়। তাদের অনেকের কাছে লেখক তার এই ‘কলামের‘ মাধ্যমে পরিচিত। কেউ কেউ প্রশংসা করে বলেন,’আপনি তো আমাদের অনেক দিনের পরিচিত, আপনার লেখা সব সময় পড়ি‘। তাদের একটু শুধরে দিয়ে বলি, ‘আমার লেখা দেখেন, চোখে
পড়েছে এতেই আমি খুশি। আর সব লেখা সব সময় পড়া হয়ে উঠেনা, সম্ভবও না। লেখক হিসাবে তেমন চাওয়াও উচিত নয় আমার‘। শুনে তারা হাসেন। ভালো লাগে। এবারের আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ডাক্তার সেলিমের অনুপ্রেরণায় ক্লাবের সদস্য তালিকায় নাম লেখানো। ইউরোপিয়ান পাসপোর্টের কল্যাণে ঢাকায় ডাচ ক্লাবের সদস্য হলে সেখানে আমার যাতায়াত নিতান্তই কম। সেই কবে সেখানে একটা পার্টি দিয়েছিলাম বন্ধু ও ঢাকার বিভিন্ন পেশার কিছু
পরিচিতজনদের নিয়ে। এরপর ওমুখো আর হইনি। সময় ও ব্যস্ততার কারণে।
সিনিয়র্স ক্লাবের যে বিষয়টি আমাকে টানে তা হলো এর সৃষ্টির পেছনের ইতিহাস। যারা এর সাথে জড়িত তাদের দেখিনি, সে প্রায় একশ বছর (৯৬) আগের কথা। কিন্তু তাদের নামের সাথে পরিচয় স্কুল বয়স থেকে। কে সি দে, ড. খাস্তগীর নামগুলির সাথে পরিচয় ঘটে স্কুল ও সড়কের কারণে। কে না চেনে চট্টগ্রামের
কে সি দে রোড আর ড. খাস্তগীর গার্লস স্কুলকে। আর এই স্কুলের অনেকটা গা–ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আজকের চিটাগং সিনিয়র্স ক্লাব, যার গোড়াপত্তন ১৯২৭ সালে। অন্যদিকে, আজকের যে চিটাগাং ক্লাব তার শুরু ইংরেজদের হাত ধরে, ১৮৭৮ সালে। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবের মত সেখানে কোন নেটিভ নাগরিকের প্রবেশাধিকার ছিলনা। সে সময়কার চট্টগ্রামের ডিভিশনাল কমিশনার ও ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সদস্য শ্রী কে সি দে চিটাগাং ক্লাবের সদস্য পদের
জন্যে আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যান হয়। এই বর্ণবাদী আচরণে তিনি এতো ক্ষুদ্ধ ও অপমানিত বোধ করলেন যে তিনি নির্দেশ দিলেন চট্টগ্রামে চিটাগাং ক্লাবের ধারে–কাছে কোথায়ও একটি জায়গা খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য একটি অভিজাত ক্লাব নির্মাণ। এগিয়ে এলেন সে সময়ের বিখ্যাত চিকিৎসক ও জমিদার ড. রাজেন্দ্র নারায়ণ খাস্তগীর। বর্তমান খাস্তগীর স্কুলের পাশে যে জমি তা ছিল তার মালিকানাধীন, তিনি তা দান করলেন ক্লাবের জন্যে। সমাজের
প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গঠন হয় নতুন ক্লাব। নাম চিটাগং ইনস্টিটিউট লিমিটেড, যা পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে নুতন নাম ধারণ করে হয়, চিটাগং সিনিয়র্স ক্লাব। সেদিনকার ‘কটেজ–টাইপ‘ ক্লাব আজ বহুতল ক্লাবের আকার ধারণ করেছে। দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক চিটাগং সিনিয়র্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন (২০০৩–২০০৫) এবং জানা যায় ক্লাবের নতুন স্ট্রাকচার গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
পরিশেষে: ‘প্রেসিডেন্ট‘স ম্যান‘ বলে একটা কথা আছে। তাতে বাড়তি সুযোগ–সুবিধা পাওয়া যায়। আমি ক্লাবের কেউ নই। কিন্তু ক্লাবের সকল কর্মকর্তা–
কর্মচারীর কাছ থেকে বাড়তি খাতির পাই। কোন যোগ্যতায় নয়। লেখক হিসাবে কেউ কেউ পছন্দ করেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রেসিডেন্টের কাছের লোক বলে এই বাড়তি মনোযোগ পাই বলে আমার ধারণা। দিন কয়েক আগে রিসেপশনে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম ‘এক্সপ্যাট্রিয়ট‘ সদস্য যারা তারা ক্লাবে ‘নন–লোকাল‘ গেস্ট আনতে পারেন কিনা। ডেস্কে যিনি ছিলেন বিষয়টা তিনি জানেন না বলে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। কিন্তু পরক্ষণে হেসে বলেন, ‘স্যার, আপনি
তো প্রেসিডেন্ট স্যারের ‘খাস–মানুষ‘, আপনার জন্যে কোন সমস্যা হবে না‘। উত্তরে বলি, ‘নিষেধ হলে তা করবো না.কিন্তু আমার বন্ধু আজ প্রেসিডেন্ট আছেন, আগামীকাল তো নাও থাকতে পারেন‘। আবারো মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেন, ‘স্যার, আমরা আছি না? আমরা তো আপনাকে চিনি‘। যাই হোক– গতকাল দুপুরে
ক্লাবে গেলে প্রেসিডেন্ট সাহেব আমার হাতে ক্লাবের এক গাদা ম্যাগাজিন ধরিয়ে দিলেন। তার একটি ইংরেজিতে লেখা বাই–ল‘স‘। তাতে ২য় পৃষ্ঠার ১২ নম্বরে উল্লেখ রয়েছে, কেবল স্থায়ী ও লাইফ মেম্বাররা অ–স্থানীয়–গেস্ট ক্লাবে আনতে পারবেন‘। দেখে কিছুটা নিরুৎসাহিত হলাম। এই কারণে আজ ঢাকা থেকে
এসেছিলেন বিশিষ্ট এক ব্যক্তি, জাতীয় পর্যায়ের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে যার মোটামুটি যোগাযোগ আছে।
তার সাথে আমার ঢাকায় মিটিং হবার দিনক্ষণ ঠিক হয়ে আছে। ভাবলাম তিনি যখন চাটগাঁ তাহলে কাজটা এখানেই সেরে ফেলা যায়। একবার ভেবেছিলাম তাকে নিয়ে ক্লাবে বসি, মিটিং সারি। কিন্তু দ্বিধায় পড়ে তা বাতিল করলাম। বন্ধু ড. সেলিমকে বললে, আমি নিশ্চিত জানি, তিনি আনন্দের সাথে আমাদের
আহবান জানাতেন। কিন্তু তা থেকে বিরত থা। চিটাগং সিনিয়র্স ক্লাবের নতুন কমিটি এই দিকটা দেখবেন বলে আশা করি। তাতে দেশের বাইরে যারা থাকেন, যাদের মোটামুটি ভালো অবস্থান তারা এই প্রেস্টিজিয়াস ক্লাবের সদস্য হতে আগ্রহী হবেন বলে আমার বিশ্বাস। এতে তারা যেমন নিজেদের সম্মানিত বোধ
করবেন, ঠিক তেমনি ক্লাবেরও ইমেজের জন্যে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে আমার ধারণা। তবে আমার ধারণায় কার কী এসে যায়। আমার অনেক–পছন্দের এই ক্লাবের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট।