হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:২০ পূর্বাহ্ণ

শূন্যে ভাসমান জলের ফোঁটার উপর যখন সূর্যের আলো পড়ে তখনই আমরা রংধনু দেখতে পাই। অপূর্ব চোখ ধাঁধানো সাত রংয়ের রংধনু। স্কুল বয়সে, কেবল স্কুল বয়স বলি কেন, এখনো এই বয়সে এসে প্রকৃতির এই অপূর্ব লীলা দেখে মুগ্ধ হই।

 

অবাক হয়ে দেখি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টি, যাকে উদ্দেশ্য করে নজরুল গেয়েছেন, ‘খেলিছ এই বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে’। এই বিরাট শিশুর কত যে লীলাখেলা।সব চাইতে দর্শনীয় রংধনু দেখা দেয় যখন আকাশের অর্ধেকখানি মেঘে ঢাকা থাকে এবং যখন পর্যবেক্ষক সূর্যের দিকে পরিস্কার আকাশ সহ একটি স্থানে অবস্থান নেয়। এই কারণে সাধারণত সকালে পশ্চিম আকাশে এবং সন্ধ্যার দিকে পুবআকাশে আমরা রংধনু দেখতে পাই।

 

এই রংধনু নিয়ে একাধিক বিশ্বাসও রয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন রংধনু স্বর্গ এবং পৃথিবীর মধ্যে একটি যোগসূত্র। বৌদ্ধদের কাছে রংধনু হলো ‘নির্বানে’ পৌঁছানোর পূর্বে আধ্যাত্মিক কৃতিত্বের সর্বোচ্চ ধাপ বা রূপ। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ছিলেন প্রথম পণ্ডিতদের একজন যিনি রংধনু সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণে আংশিকভাবে সঠিক ছিলেন।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে তিনি জানতেন যে রংধনুগুলি জলের ফোঁটা থেকে প্রতিসৃত আলোর নাচানাচির ফল। লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, ইন্ডিগো (নীলাভ) ও বেগুনিএই সাত রংকে নিয়ে রংধনু হলেও প্রথমে তিনি বলেছিলেন এতে পাঁচ রঙের সমাহার। বাংলায় যা ‘রংধনু’ ইংরেজিতে সেটিই ‘রেইনবো’।

আর রংধনু নিয়ে এতো কথা বলার পেছনে কারণ হলো ‘রোটারি ক্লাব অব চিটাগং রেইনবো’। গেল সংখ্যায় এই ক্লাবটির সদস্যের সাথে গিয়েছিলাম রাউজান, বনভোজনে। সেখানে যে কেবল খাওয়াদাওয়া আর হইহুল্লোড় হয়েছে তা ভাবার কোন কারণ নেই, যদিও বা বনভোজন বা পিকনিক বলতে আমরা তাই বুঝি। আগের সংখ্যায় লিখেছিলাম, পিকনিকের শুরু ফরাসি বিক্তবানদের হাত ধরে, প্রাকফরাসি বিপ্লব সময়ে। পরবর্তীতে এটি সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। রোটারি ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব বিক্তবানদের মিলনস্থল।

কিন্তু এই সমস্ত ক্লাবের কর্মকান্ডের মধ্যে যে বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় তা হলো, ‘বিত্তের সাথে চিত্তের’ সমন্বয়। আমাদের সমাজে অর্থবানের অভাব নেই, কিন্তু দৃষ্টিকটুভাবে অভাব রয়েছে চিত্তবানের। আমার সাংবাদিক বন্ধু রোটারিয়ান এম নাসিরুল হক দাবি করেন, তাদের এই ক্লাবে সমন্বয় ঘটেছে বিত্ত ও চিত্তবানদের। আর সে কারণেই ক্লাবের অন্যতম লক্ষ্য আনন্দের পাশাপাশি সমাজের বিত্তহীনদের পাশে দাঁড়ানো, তাতে নেই কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা।

সেই কবে ১১৮ বছর আগে ১৯০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর এটর্নি পল হ্যারিস ‘রোটারি ক্লাব অব শিকাগো’ গঠন করে রোটারির যাত্রা শুরু করেন। শুরুতে উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন পেশাজীবীরা এক হয়ে নানা বিষয়ে মতামত বিনিময় করবেন এবং অর্থবহ ও দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্ব তৈরি করবেন। পরবর্তীতে রোটারির কার্যক্রম মানবসেবার দিকে এগিয়ে যায়। যে চার ব্যক্তি প্রথম এক হয়ে ‘রোটারি’ গঠন করেন তারা হলেন, পল হ্যারিস, গুস্তাভুস লোহের, সিলভেস্টার স্কীলি ও হিরাম শোরে।

ভাবতে অবাক লাগে ১১৮ বছর আগে জন্ম নেয়া রোটারি ক্লাব আজ বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে এবং এই ক্লাবের বর্তমান সংখ্যা হলো ৪৬.০০০এর বেশি। বাংলাদেশে, এক পরিসংখ্যান মতে, ৩৫০টি রোটারি ক্লাব রয়েছে, যার সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। নিন্দুকেরা বলেন, রোটারি, লায়ন্স এগুলি হলো ধনবানদের ক্লাব। তারা অভিযোগ করেন, তারা যে সমস্ত সেবামূলক কাজকর্ম করেন বলে দাবি করেন তা গ্রেফ নামকাওয়াস্তে। এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আমার এক রোটারিয়ান বন্ধু বলেন, ‘কথাটা সঠিক নয়’।

তিনি বলেন, ‘ধরুন তারা একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে একশত গরিব ও দুস্থ লোককে শীতকালে কম্বল দিলেন। দেশের প্রতিটি রোটারি ক্লাব এই ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে বিভিন্ন সময়ে গোটা দেশ জুড়ে। দেশের ৩৫০ রোটারি ক্লাবের দেয়া ১০০টি কম্বল যদি যোগ দেয়া হয়, তাহলে এই সংখ্যা বেশ বড় হয়। তখন কিন্তু এই উদ্যোগকে আর খাটো করে দেখার অবকাশ থাকে না’। ওনার কথায় যুক্তি আছে। গত ১৩ জানুয়ারি রোটারি ক্লাব অব চিটাগাং এর কর্মকর্তাদের সাথে পিকনিকে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে রাউজান গিয়েছিলাম।

সেখানে দেখেছি তাদের আনন্দের সাথে দুস্থদের পাশে দাঁড়ানোর কর্মকাণ্ড। দেখে ভালো লেগেছে। সেখানে গিয়ে গোটা রাউজান এলাকার রাস্তাঘাট, গাছপালা, পরিস্কারপরিচ্ছনতা দেখে আক্ষরিক অর্থে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

জেনেছি এর সম্পূর্ণ অবদান স্থানীয় এম পি, এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর। ফজলে করিম চৌধুরীর মত দেশের বাকি এম পিরা যদি তাদের নিজ নিজ এলাকায় এমন চোখেপড়ার মত উন্নয়ন কাজ করতেন, তাহলে গোটা বাংলাদেশের চেহারাটাই যেত বদলে। ফজলে করিম সাহেব যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন তার নিজ এলাকার উন্নয়ন ঘটিয়ে, আশা করি তা অন্যেরা (দেশের বাকি এমপি) দেখে শিক্ষা নেবেন। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা ভালো কিছু দেখেও শিক্ষা নেই না, অনুকরণ করিনা। যাই হোক

রাউজানের ইয়াছিননগর গিয়ে দেখলাম স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম এহেছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুলের আলিশান বাড়িতে আলিশান আয়োজন। কথা ছিল তার গ্রামের বাড়িতে আমাদের ব্রেকফাস্টের আয়োজন করা হবে। কিন্তু আমাদের সে দিনের ‘ফাস্টকে’ ‘ব্রেক’ করার যে আয়োজন দেখলাম, তাতে আমার রীতিমত ‘ভিমরি’ খাবার দশা।

নানা ধরনের পিঠা, মাংস, ফল, মিষ্টি থেকে শুরু করে হেন খাবার নেই যা টেবিলে ছিল না। সেখানে গিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যানের মুখ থেকে একাত্তর সাল ও পরবর্তী সময়ে বিএনপিজামাত এবং এনডিপিবাহিনীর সন্ত্রাসের কাহিনী শুনে শিহরিত হয়েছিলাম। এখন গোটা এলাকায় শান্তি বিরাজ করছে বলে তিনি দাবি করেন। তবে এখনো মাঝে মধ্যে পাহাড়ি এলাকায় কিছু কিছু ঘটনা ঘটে থাকে বলে জানালেন ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান।

তবে রাউজান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এহেছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘পাহাড়িদের জন্যে আমি বাড়ি বানিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে অনেক সাহায্য করেছি এবং এখনো করি। ওদের সাথে আমাদের সদ্ভাব রয়েছে। এখন এই এলাকায় তেমন কোন গন্ডগোল নেই’। আমরা যখন তার বাড়িকে পিছু রেখে পিকনিকের মূল স্পটে গিয়ে পৌঁছি, দেখি সেখানে একদল পাহাড়ি পুরুষমহিলা অপেক্ষা করছেন রোটারিয়ানদের আগমনের। বেশভুষা চেহারা দেখেই বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না এরা দুঃস্থ। এদের মাঝে শীতের কম্বল বিতরণ করা হবে।

বিতরণ করা হবে রোটারি ক্লাবের ব্যানার থেকে যদিওবা তা দান করেছেন চেয়ারম্যান এহেছানুল হায়দর বাবুল। মজার লোক বটে এই চেয়ারম্যান। দুপুরের খাওয়া শেষে ছোটখাট মনোরঞ্জনঅনুষ্ঠানে কৌতুক শোনালেন। সবাইকে হাসালেন। এক পর্যায়ে কিছুটা অভিনয় করেও দেখালেন তিনি। সাবিনা কিউ দোবাস ও আলী মাহবুব হোসাইনের সঞ্চালনায় সে অনুষ্ঠান বেশ উপভোগ্য হয়েছিল। এক পর্যায়ে উপস্থিত দুস্থ পাহাড়িদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হলো।

শহরের সমস্ত কোলাহল ছাড়িয়ে প্রকৃতির মাঝে আয়োজিত সারাদিনের এই আয়োজন অনেক দিন মনে থাকার কথা। অনেকদিন পর ভাপা পিঠা খেলাম। ভাপা পিঠা আমায় তেমন টানে না। কিন্তু সেদিন পড়ন্ত বিকেলে, সূর্য যখন প্রায় অস্তমিত, গায়ে কিছুটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, তখন গরমচায়ের সাথে গরমভাপা পিঠা সত্যি মনে রাখার মত। এর আগে চেয়ারম্যান সাহেবের ছোট্ট পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য, পুকুরের পাড়ে অনেকের ভিড় আর কৌতূহলী দৃষ্টিসব কিছু গোটা দিনকে স্মরণীয় করে রাখবে, অন্তত আমার মাঝে।

যারা দেশে আছেন তাদের এমন সুযোগ, সময় হয়তো আরো অনেক আসবে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তেমনটি হবার নয়। আর দেশ ছেড়ে, নিকটজন ছেড়ে আমরা যারা স্থায়ীভাবে সাত সমুদ্দুর পাড়ির দেশে আছি, তাদের কাছে দেশে ফেলে আসা এমন মুহূর্তগুলি দূর থেকে হাতছানি দেয়। মনে হয় ছুঁটে যাই। পারিনা।

সেদিন সবকিছু পিছু ফেলে রেখে, কেবল স্মৃতিটুকু সাথে নিয়ে রাউজান ছেড়ে আমরা শহর অভিমুখে যখন চলেছি তখন সন্ধ্যা নেমেছে। বন্ধুবৎসল রোটারিয়ান খায়ের আহমেদের বড়সড় গাড়িতে আমরা ক’টি প্রাণী।

গাড়িতে খায়ের ভাই ছাড়াও বন্ধু এম নাসিরুল হক, এরশাদুল হক আর চালক। সারা দিনের ক্লান্তি সবাইকে কিছুটা হলেও কাহিল করেছিল। এক সময় চলন্ত গাড়ির শব্দকে ছাপিয়ে কানে আসে পাশে বসা নাসির ভাইয়ের নাক ডাকার শব্দ। মজার ব্যাপার হলো শব্দ করে নাক ডাকার সাথে সাথে তিনি জেগে উঠে আবার গল্পে মেতে উঠেন।

সেদিনের যে আনন্দ, হাসি,

হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া

শূন্যে ভাসমান জলের ফোঁটার উপর যখন সূর্যের আলো পড়ে তখনই আমরা রংধনু দেখতে পাই। অপূর্ব চোখ ধাঁধানো সাত রংয়ের রংধনু। স্কুল বয়সে, কেবল স্কুল বয়স বলি কেন, এখনো এই বয়সে এসে প্রকৃতির এই অপূর্ব লীলা দেখে মুগ্ধ হই। অবাক হয়ে দেখি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টি, যাকে উদ্দেশ্য করে নজরুল গেয়েছেন, ‘খেলিছ এই বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে’। এই বিরাট শিশুর কত যে লীলাখেলা।

সব চাইতে দর্শনীয় রংধনু দেখা দেয় যখন আকাশের অর্ধেকখানি মেঘে ঢাকা থাকে এবং যখন পর্যবেক্ষক সূর্যের দিকে পরিস্কার আকাশ সহ একটি স্থানে অবস্থান নেয়। এই কারণে সাধারণত সকালে পশ্চিম আকাশে এবং সন্ধ্যার দিকে পুবআকাশে আমরা রংধনু দেখতে পাই। এই রংধনু নিয়ে একাধিক বিশ্বাসও রয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন রংধনু স্বর্গ এবং পৃথিবীর মধ্যে একটি যোগসূত্র।

বৌদ্ধদের কাছে রংধনু হলো ‘নির্বানে’ পৌঁছানোর পূর্বে আধ্যাত্মিক কৃতিত্বের সর্বোচ্চ ধাপ বা রূপ। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ছিলেন প্রথম পণ্ডিতদের একজন যিনি রংধনু সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণে আংশিকভাবে সঠিক ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে তিনি জানতেন যে রংধনুগুলি জলের ফোঁটা থেকে প্রতিসৃত আলোর নাচানাচির ফল। লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, ইন্ডিগো (নীলাভ) ও বেগুনিএই সাত রংকে নিয়ে রংধনু হলেও প্রথমে তিনি বলেছিলেন এতে পাঁচ রঙের সমাহার। বাংলায় যা ‘রংধনু’ ইংরেজিতে সেটিই ‘রেইনবো’।

আর রংধনু নিয়ে এতো কথা বলার পেছনে কারণ হলো ‘রোটারি ক্লাব অব চিটাগং রেইনবো’। গেল সংখ্যায় এই ক্লাবটির সদস্যের সাথে গিয়েছিলাম রাউজান, বনভোজনে। সেখানে যে কেবল খাওয়াদাওয়া আর হইহুল্লোড় হয়েছে তা ভাবার কোন কারণ নেই, যদিও বা বনভোজন বা পিকনিক বলতে আমরা তাই বুঝি। আগের সংখ্যায় লিখেছিলাম, পিকনিকের শুরু ফরাসি বিক্তবানদের হাত ধরে, প্রাকফরাসি বিপ্লব সময়ে। পরবর্তীতে এটি সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। রোটারি ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব বিক্তবানদের মিলনস্থল।

কিন্তু এই সমস্ত ক্লাবের কর্মকান্ডের মধ্যে যে বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় তা হলো, ‘বিত্তের সাথে চিত্তের’ সমন্বয়। আমাদের সমাজে অর্থবানের অভাব নেই, কিন্তু দৃষ্টিকটুভাবে অভাব রয়েছে চিত্তবানের। আমার সাংবাদিক বন্ধু রোটারিয়ান এম নাসিরুল হক দাবি করেন, তাদের এই ক্লাবে সমন্বয় ঘটেছে বিত্ত ও চিত্তবানদের। আর সে কারণেই ক্লাবের অন্যতম লক্ষ্য আনন্দের পাশাপাশি সমাজের বিত্তহীনদের পাশে দাঁড়ানো, তাতে নেই কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা।

সেই কবে ১১৮ বছর আগে ১৯০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর এটর্নি পল হ্যারিস ‘রোটারি ক্লাব অব শিকাগো’ গঠন করে রোটারির যাত্রা শুরু করেন। শুরুতে উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন পেশাজীবীরা এক হয়ে নানা বিষয়ে মতামত বিনিময় করবেন এবং অর্থবহ ও দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্ব তৈরি করবেন। পরবর্তীতে রোটারির কার্যক্রম মানবসেবার দিকে এগিয়ে যায়। যে চার ব্যক্তি প্রথম এক হয়ে ‘রোটারি’ গঠন করেন তারা হলেন, পল হ্যারিস, গুস্তাভুস লোহের, সিলভেস্টার স্কীলি ও হিরাম শোরে।

ভাবতে অবাক লাগে ১১৮ বছর আগে জন্ম নেয়া রোটারি ক্লাব আজ বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে এবং এই ক্লাবের বর্তমান সংখ্যা হলো ৪৬.০০০এর বেশি। বাংলাদেশে, এক পরিসংখ্যান মতে, ৩৫০টি রোটারি ক্লাব রয়েছে, যার সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। নিন্দুকেরা বলেন, রোটারি, লায়ন্স এগুলি হলো ধনবানদের ক্লাব। তারা অভিযোগ করেন, তারা যে সমস্ত সেবামূলক কাজকর্ম করেন বলে দাবি করেন তা গ্রেফ নামকাওয়াস্তে। এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আমার এক রোটারিয়ান বন্ধু বলেন, ‘কথাটা সঠিক নয়’।

তিনি বলেন, ‘ধরুন তারা একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে একশত গরিব ও দুস্থ লোককে শীতকালে কম্বল দিলেন। দেশের প্রতিটি রোটারি ক্লাব এই ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে বিভিন্ন সময়ে গোটা দেশ জুড়ে। দেশের ৩৫০ রোটারি ক্লাবের দেয়া ১০০টি কম্বল যদি যোগ দেয়া হয়, তাহলে এই সংখ্যা বেশ বড় হয়। তখন কিন্তু এই উদ্যোগকে আর খাটো করে দেখার অবকাশ থাকে না’। ওনার কথায় যুক্তি আছে। গত ১৩ জানুয়ারি রোটারি ক্লাব অব চিটাগাং এর কর্মকর্তাদের সাথে পিকনিকে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে রাউজান গিয়েছিলাম।

সেখানে দেখেছি তাদের আনন্দের সাথে দুস্থদের পাশে দাঁড়ানোর কর্মকাণ্ড। দেখে ভালো লেগেছে। সেখানে গিয়ে গোটা রাউজান এলাকার রাস্তাঘাট, গাছপালা, পরিস্কারপরিচ্ছনতা দেখে আক্ষরিক অর্থে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

জেনেছি এর সম্পূর্ণ অবদান স্থানীয় এম পি, এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর। ফজলে করিম চৌধুরীর মত দেশের বাকি এম পিরা যদি তাদের নিজ নিজ এলাকায় এমন চোখেপড়ার মত উন্নয়ন কাজ করতেন, তাহলে গোটা বাংলাদেশের চেহারাটাই যেত বদলে। ফজলে করিম সাহেব যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন তার নিজ এলাকার উন্নয়ন ঘটিয়ে, আশা করি তা অন্যেরা (দেশের বাকি এমপি) দেখে শিক্ষা নেবেন। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা ভালো কিছু দেখেও শিক্ষা নেই না, অনুকরণ করিনা। যাই হোক

রাউজানের ইয়াছিননগর গিয়ে দেখলাম স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম এহেছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুলের আলিশান বাড়িতে আলিশান আয়োজন। কথা ছিল তার গ্রামের বাড়িতে আমাদের ব্রেকফাস্টের আয়োজন করা হবে। কিন্তু আমাদের সে দিনের ‘ফাস্টকে’ ‘ব্রেক’ করার যে আয়োজন দেখলাম, তাতে আমার রীতিমত ‘ভিমরি’ খাবার দশা।

নানা ধরনের পিঠা, মাংস, ফল, মিষ্টি থেকে শুরু করে হেন খাবার নেই যা টেবিলে ছিল না। সেখানে গিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যানের মুখ থেকে একাত্তর সাল ও পরবর্তী সময়ে বিএনপিজামাত এবং এনডিপিবাহিনীর সন্ত্রাসের কাহিনী শুনে শিহরিত হয়েছিলাম। এখন গোটা এলাকায় শান্তি বিরাজ করছে বলে তিনি দাবি করেন। তবে এখনো মাঝে মধ্যে পাহাড়ি এলাকায় কিছু কিছু ঘটনা ঘটে থাকে বলে জানালেন ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান।

তবে রাউজান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এহেছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘পাহাড়িদের জন্যে আমি বাড়ি বানিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে অনেক সাহায্য করেছি এবং এখনো করি। ওদের সাথে আমাদের সদ্ভাব রয়েছে। এখন এই এলাকায় তেমন কোন গন্ডগোল নেই’। আমরা যখন তার বাড়িকে পিছু রেখে পিকনিকের মূল স্পটে গিয়ে পৌঁছি, দেখি সেখানে একদল পাহাড়ি পুরুষমহিলা অপেক্ষা করছেন রোটারিয়ানদের আগমনের। বেশভুষা চেহারা দেখেই বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না এরা দুঃস্থ। এদের মাঝে শীতের কম্বল বিতরণ করা হবে।

বিতরণ করা হবে রোটারি ক্লাবের ব্যানার থেকে যদিওবা তা দান করেছেন চেয়ারম্যান এহেছানুল হায়দর বাবুল। মজার লোক বটে এই চেয়ারম্যান। দুপুরের খাওয়া শেষে ছোটখাট মনোরঞ্জনঅনুষ্ঠানে কৌতুক শোনালেন। সবাইকে হাসালেন। এক পর্যায়ে কিছুটা অভিনয় করেও দেখালেন তিনি। সাবিনা কিউ দোবাস ও আলী মাহবুব হোসাইনের সঞ্চালনায় সে অনুষ্ঠান বেশ উপভোগ্য হয়েছিল। এক পর্যায়ে উপস্থিত দুস্থ পাহাড়িদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হলো।

শহরের সমস্ত কোলাহল ছাড়িয়ে প্রকৃতির মাঝে আয়োজিত সারাদিনের এই আয়োজন অনেক দিন মনে থাকার কথা। অনেকদিন পর ভাপা পিঠা খেলাম। ভাপা পিঠা আমায় তেমন টানে না। কিন্তু সেদিন পড়ন্ত বিকেলে, সূর্য যখন প্রায় অস্তমিত, গায়ে কিছুটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, তখন গরমচায়ের সাথে গরমভাপা পিঠা সত্যি মনে রাখার মত। এর আগে চেয়ারম্যান সাহেবের ছোট্ট পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য, পুকুরের পাড়ে অনেকের ভিড় আর কৌতূহলী দৃষ্টিসব কিছু গোটা দিনকে স্মরণীয় করে রাখবে, অন্তত আমার মাঝে।

যারা দেশে আছেন তাদের এমন সুযোগ, সময় হয়তো আরো অনেক আসবে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তেমনটি হবার নয়। আর দেশ ছেড়ে, নিকটজন ছেড়ে আমরা যারা স্থায়ীভাবে সাত সমুদ্দুর পাড়ির দেশে আছি, তাদের কাছে দেশে ফেলে আসা এমন মুহূর্তগুলি দূর থেকে হাতছানি দেয়। মনে হয় ছুঁটে যাই। পারিনা।

সেদিন সবকিছু পিছু ফেলে রেখে, কেবল স্মৃতিটুকু সাথে নিয়ে রাউজান ছেড়ে আমরা শহর অভিমুখে যখন চলেছি তখন সন্ধ্যা নেমেছে। বন্ধুবৎসল রোটারিয়ান খায়ের আহমেদের বড়সড় গাড়িতে আমরা ক’টি প্রাণী।

গাড়িতে খায়ের ভাই ছাড়াও বন্ধু এম নাসিরুল হক, এরশাদুল হক আর চালক। সারা দিনের ক্লান্তি সবাইকে কিছুটা হলেও কাহিল করেছিল। এক সময় চলন্ত গাড়ির শব্দকে ছাপিয়ে কানে আসে পাশে বসা নাসির ভাইয়ের নাক ডাকার শব্দ। মজার ব্যাপার হলো শব্দ করে নাক ডাকার সাথে সাথে তিনি জেগে উঠে আবার গল্পে মেতে উঠেন।

সেদিনের যে আনন্দ, হাসি, হইচই তার অনেকটা অবদান নাসির ভাইয়ের, সে কথা স্বীকার করতেই হয়। রোটারি ক্লাব অব চিটাগং রেইনবোর কর্মকর্তা ও সদস্যদের সাথে আমার পরিচয় মাত্র কয়েক দিনের, সময়ের নিরিখে মাত্র কয়েক ঘন্টা।

কিন্তু তারা যেভাবে আমায় ‘আপনার’ করে নিয়েছেন তা কিছুতেই ভোলার নয়। তাদের সকলের প্রতি আমি আমার এই লেখার মধ্যে দিয়ে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশে এবারের দীর্ঘ (দেড় মাস) অবস্থানকালে এই দিনটি আমার অনেক অনেক ভালো লাগার একটি দিন। ক্লাবের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

হইচই তার অনেকটা অবদান নাসির ভাইয়ের, সে কথা স্বীকার করতেই হয়। রোটারি ক্লাব অব চিটাগং রেইনবোর কর্মকর্তা ও সদস্যদের সাথে আমার পরিচয় মাত্র কয়েক দিনের, সময়ের নিরিখে মাত্র কয়েক ঘন্টা।

কিন্তু তারা যেভাবে আমায় ‘আপনার’ করে নিয়েছেন তা কিছুতেই ভোলার নয়। তাদের সকলের প্রতি আমি আমার এই লেখার মধ্যে দিয়ে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশে এবারের দীর্ঘ (দেড় মাস) অবস্থানকালে এই দিনটি আমার অনেক অনেক ভালো লাগার একটি দিন। ক্লাবের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোরআন তেলাওয়াতের মর্যাদা ও বিশ্লেষণ
পরবর্তী নিবন্ধকূট-পরাজীবীদের বিতাড়ন অতীব জরুরি