হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিধানকার হিসেবে খ্যাতিমান। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের নিরলস সাধনায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ নামে একটি অভিধান সংকলন প্রণয়ন করেন তিনি। এই সংকলনটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি মূল্যবান সম্পদ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৬৭ সালের ২৩ জুন ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগণার রামনারায়ণপুরে। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার শুরু পৈত্রিক গ্রাম মশাইকাটিতে। মাধ্যমিকে বেশ কয়েকবার স্কুল বদল করতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ভর্তি হন কলকাতা মেট্রোপলিটান কলেজে। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে বি.এ তৃতীয় বর্ষেই তাঁকে লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয়। কর্মজীবনের সূচনা শিক্ষকতায়। এরপর খানিকটা উলটো পথের ডাক আসে। রবিঠাকুরের পতিসরের জমিদারির কাছারিতে তত্ত্বাবধায়কের কাজে যোগ দেন হরিচরণ। আর সেই সাথে তাঁর সামনে খুলে যায় নতুন দিগন্ত। কবির কাছাকাছি আসবার সুযোগ ঘটে তাঁর। আর রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখভাল করতে এসে তাঁর নতুন এই কর্মচারীর সংস্কৃত জ্ঞানের গভীরতা দেখে তাঁকে নিয়ে আসেন শান্তিনিকেতনে। এখানে হরিচরণ ব্রহ্মচর্যাশ্রমে সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছর তিনি শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯০৫ সালে কবিগুরুর অভিপ্রায়ে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ সংকলনটির কাজ শুরু করেন। নিবিড় অধ্যাবসায়, পরম নিষ্ঠা, অক্লান্ত পরিশ্রম আর অপরিসীম ধৈর্যে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় ১৯৪৫ সালে এর কাজ সমাপ্ত হয়। এবং ১৯৪৫ সালেই বিশ্বভারতী থেকে মূল্যবান এই সংকলনটি পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ও মূল্যবান সংযোজন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: কবিগুরুকে নিয়ে রচিত ‘কবির কথা’; অনূদিত গ্রন্থ ম্যাথু আর্নল্ডের ‘সোরাব রোস্তম’, এবং ‘বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র’, ‘কবিকথা মঞ্জুষা’; ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থ ‘সংস্কৃত প্রবেশ’, ‘পালি প্রবেশ’, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, ‘হিন্টস অন সংস্কৃট ট্রান্সশ্লেষন অ্যান্ড কম্পোজিশন ইত্যাদি। অনূদিত গ্রন্থগুলো অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন দেশিকোত্তম, বিশ্বভারতীর ডি-লিট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, শিশিরকুমার স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি। ১৯৫৯ সালের ১৩ জানুয়ারি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হন।