সমসাময়িক রাজনীতিবিদের মধ্যে এমএ ওহাব ছিলেন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। সফেদ পাজামা পাঞ্জাবী পরিহিতি এমএ ওহাবের পাকা দাড়ি গোঁফে আচ্ছন্ন মুখমণ্ডলে একজন সত্যদ্রষ্টা প্রাচীন ঋষির সম্ভ্রম বিরাজ করতো। ফতেপুরের ভূমিপুত্র প্রকৃতই একজন কৃষক ছিলেন। হাল বলদ নিয়ে হাটহাজারীর বিলে জমি চাষ করতেন এবং তাড়াহুড়ো করে গোসল সেরে শহরে আসতেন বলে হাতে পায়ে ছোপছোপ কাদা লেপ্টে থাকতো। কখনো বা গ্রামের মেঠো পথ মাড়িয়ে আসার ফলে ধূলিধূসরিত থাকতেন। কিন্তু এসবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করার মতো শুচিবায়ুগ্রস্ত ছিলেন না তিনি। জাতীয় পর্যায়ের নেতৃপদে পরিগণিত হওয়ার পরও তাঁর মধ্যে কোন অভিমান ছিলো না। সহজ সরল গ্রাম্য কৃষকের চেয়ে বেশি কিছু নিজেকে মনে করতেন না কখনো। এত সাদা মাঠা জীবন যাপন করতেন যে, তাঁকে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বলেই ভ্রম হতো।
তাঁর জীবন ছিলো সৎ রাজনীতিকের দৃষ্টান্তস্থল। এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী যখন তাঁকে ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে জেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে তাঁর পিতার অনুমতি চাইতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি যে কথা বলেছিলেন, সেটা বেশ তাৎপর্যজনক। শুধু জেলা পরিষদের নির্বাচন নয়, পুত্রকে রাজনীতি করার জন্য পিতার অনুমতি প্রদানের বিষয়ও ছিলো। তখন তিনি পুত্রকে বলেছিলেন, “তুমি নাকি শর্ত দিয়েছ আমি অনুমতি না দিলে মাঠে নামবে না। আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম, তবে শর্ত থাকে যে, তুমি ভাত সামনে নিয়ে ওয়াদা কর, কখনো পিছনে হাত টানবে না (অর্থাৎ ঘুষ নিবা না)। যখন মনে করবে পিছনে হাত টানতে হবে তখন আমার ঘরের সন্তান ঘরে ফিরে আসবে। জনাব ওহাব সেইদিনই বাবার কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন যে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন। কখনো কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে, ঘুষ নিয়ে কাজ করবেন না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তার ওয়াদা রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। জনহিতকর কাজ করে গেছেন। “আমি ২৮ বৎসর ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কারো কাছে পিছনে হাত পাতিনি”। শেষ জীবনে পিতার এই শর্ত স্মরণ করে জনাব এম এ ওহাব গর্বভরে বলতেন।
জনাব এম এ ওহাব ১৯২৪ সালের ১ মার্চ হাটহাজারী থানার অন্তর্গত ফতেপুর গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হাজি খলিলুর রহমান হাটহাজারীর একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজহিতৈষী ছিলেন। তিনি ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত টানা ২৮ বছর ফতেপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, একজন সৎ ব্যক্তি হিসেবে হাটহাজারী থানার সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি বিশেষ সম্মানের পাত্র ছিলেন।
জনাব এম এ ওহাব হাটহাজারী হাইস্কুলে অধ্যয়নকালে ১৯৪৪-৪৫ সালে হাটহাজারী থানা মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৪৫-৪৬ সালে ছাত্রলীগ সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর এম এ ওহাব সে সময় চট্টগ্রামের একমাত্র ডিগ্রি কলেজ চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে পাকিস্তানের পক্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তৎকালীন অধ্যক্ষ জনাব আবু হেনা কর্তৃক দুই বৎসরের জন্য বহিষ্কৃত হন। ১৯৪৮ সালে ঐ কলেজে কলেজ ছাত্র কেবিনেট গঠন করে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে প্রথম দিকেই উক্ত দলে যোগদান করেন তিনি।
১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠিত হলে জনাব ওহাব চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ্রগ্রহণ করার কারণে তাঁর ওপর হুলিয়া জারি হওয়ার ফলে সে বছর বি.এ ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পরে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ হাটহাজারী ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে হাটহাজারী থানা আওয়ামী লীগের এক কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে গুমানমর্দনের ইদ্রিস সওদাগরকে সভাপতি ও এম এ ওহাবকে সাধারণ সম্পাদক করে হাটহাজারী থানা আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। এই দায়িত্ব পাওয়ার পর জনাব এম এ ওহাব হাটহাজারী থানার বিভিন্ন ইউনিয়নে গিয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ গঠন করেন।
১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ‘৬ দফা’ ঘোষণার পর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয়। তাতে এম আর সিদ্দিকী সভাপতি, এম এ আজিজ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই সময়ে জনাব ওহাব উত্তর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
জনাব এম এ ওহাবের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তাঁর জীবনকালে আরো বহু ঘটনা ঘটেছে। তন্মধ্যে দু’বার ভূগোল বদলে যেতে দেখেছেন তিনি। দু’টি স্বাধীতা সংগ্রামেই তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। প্রথমবার ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম যেটা চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনে পর্যবসিত হয়, জনাব এম এ ওহাব সেই আন্দোলনকালে তারুণ্যছোঁয়া কৈশোরোত্তীর্ণ যুবক। বাঙালি মুসলিম তখন ইসলামী রাষ্ট্রের মোহে স্বীয় জাতীয় অতীত, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়েছিলো। জনাব ওহাবও সেই বোঝা না বোঝার বয়সে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য বাঙালি মুসলমানের মোহমুক্তি ঘটে। জনাব ওহাবেরও মোহমুক্তি ঘটেছিলো।
জীবনে বহু রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন তিনি। কিন্তু সশস্ত্র যুদ্ধের সম্মুখীন সেই একবারই হয়েছিলেন। যুদ্ধ অবশ্য তিনি আগেও দেখেছেন। সে যুদ্ধ ছিলো বিশ্বযুদ্ধ-দ্বিতীয় মহাসমর। তবে সেই যুদ্ধের তিনি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মাত্র। অংশগ্রহণের বয়স হয়নি তাঁর। হাটহাজারী ফতেপুর গ্রামের এক কিশোর মাত্র তিনি। পক্ষান্তরে একাত্তরের যুদ্ধের তিনি একাধারে প্রত্যক্ষদর্শী ও কুশীলবও বটে। এই যুদ্ধের তিনি একাধারে রাজনৈতিক নেতা, সংগঠক, পরিচালক ও সৈনিক ছিলেন। অন্যকোন নেতার কথা জানি না, এম এ ওহাব কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই লড়াই করেছেন। যুদ্ধের ময়দানে, বাঙ্কারে, প্রতিরক্ষা অবস্থানে সৈন্যদের পাশে থেকে গুলি ছুঁড়েছেন। রীতিমত সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
এম এ ওহাবের রাজনৈতিক জীবনের একটি গৌরবময় ঘটনা হলো, তিনি ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিদের শপথগ্রহণ পরিচালনা করেন।
১৯৭৫ সালে জনাব এম এ ওহাব বঙ্গবন্ধু কর্তৃক কেন্দ্রীয় বাকশাল কমিটির সদস্য মনোনীত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেষ রাত্রে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার সময় অন্যান্য এমপিদের সঙ্গে তিনি শেরে বাংলা নগরে এমপি হোস্টেলে ছিলেন এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক ঘেরাও অবস্থায় ছিলেন। ১৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী কর্তৃক কারফিউ জারি করা হয়। দুইদিন পরে কারফিউ প্রত্যাহার করা হলে তিনি চট্টগ্রাম ফিরে আসেন।
১৯৭৬ সালে বাকশাল ব্যতিত রাজনৈতিক দল করার অনুমতি দেয়া হলে বেগম জোহরা তাজউদ্দিনকে আহবায়ক করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ঐ কমিটিতে চট্টগ্রাম হতে তাঁকে আহবায়ক কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা হয়।
১৯৮০ সালে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে জনাব এমএ ওহাব জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং মোশাররফ হোসেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়।
জনাব এম এ ওহাব ছাত্রজীবন থেকে বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তাঁর এলাকায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল কম। কারণ ফতেয়াবাদ উচ্চ বিদ্যালয় ও হাটহাজারী পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয় ছিল এলাকার বাইরে অনেক দূরে। সেই সময় এলাকার অধিকাংশ মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। তাছাড়া যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল ছিল না। গাড়ি-ঘোড়া তেমন নেই বললেই চলে। যারা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জন করতে চাইতো তাদের পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হতো। যাদের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল তারা স্কুল হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করত। অনেকে ইচ্ছা থাকলেও পড়ালেখা করতে পারত না। এ সমস্ত বিষয় অনুধাবন করে তিনি এলাকার মানুষকে শিক্ষিত করার ব্যাপারে চিন্তা করতে শুরু করেন।
জনাব ওহাব ফতেপুর ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে লতিফ পাড়া প্রাইমারি স্কুল (পাঠশালা) নামে পরিচিত স্কুলের সরকারি অনুমোদন লাভের ব্যবস্থা করেন।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার এই স্কুলটি রাস্তার পাশ থেকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয় এবং সরানো না হলে স্কুলের অনুমোদন বাতিল করা হবে বলে থানা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে নির্দেশ দেয় এবং স্কুলঘর পাকা করার জন্য ২০,০০০ টাকা অনুমোদন দেয়। তখন এম এ ওহাব তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে স্কুলটি মদনা পুকুরের পশ্চিম পাড়ে স্কুলের নামে দানকৃত জায়গায় স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করলে স্থানীয় এক ব্যক্তি বাধা সৃষ্টি করেন। এরপরে অনেক আলাপ-আলোচনার পর তিনি রাজি না হওয়ায় এলাকার নুর আহমদ কোং নামে প্রভাবশালী ব্যক্তির হস্তক্ষেপে তিনি স্কুলের জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তখন এম এ ওহাব তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে স্কুলটি পুকুরের পশ্চিম পাড়ের দক্ষিণাংশে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
জনাব ওহাব ফতেপুর ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবতে থাকেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অনেক চেষ্টা তদবির করে এম এ ওহাব তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৬৮ সালে ফতেপুর জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এটিকে একটি উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নিজ পাড়ায় এম.কে রহমানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলের জমি এম এ ওহাব ও তাঁর মেজ ভাই এম এ মান্নান এবং স্থানীয় ব্যক্তি গুরা মিয়া স্কুলের নামে দান করেন। পরবর্তীতে আবুল হোসেন নামে এলাকার একজন সমাজকর্মী কিছু জায়গা স্কুলের নামে দান করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারের নির্দেশে তিনি বিভিন্ন ইউনিয়নে ২০টি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করান। ফতেপুর ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে ফতেপুর মনজুরুল ইসলাম সিনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লগ্নে তিনি মৌলানা মফজল হোসেনকে সহযোগিতা করেন। তিনি মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। প্রায় ১০/১২ বছর তিনি মাদ্রাসা কমিটির সদস্য ছিলেন। মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা মফজল হোসেন সাহেবকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সুপারিনটেন্ডেন্টের পদ থেকে বাতিল করা হলে এম. এ ওহাব এর প্রতিবাদে সদস্যপদ ত্যাগ করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহুদিন তিনি হাটহাজারীর ওদুদিয়া মাদ্রাসার সদস্য হিসেবে ছিলেন। বিভিন্ন কোন্দলের কারণে তিনি সদস্য পদ ত্যাগ করেন।
বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ফতেপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, লতিফপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এম. কে রহমানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তিনি চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু ল’ টেম্পলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক