আমার রাউজানের কৃতীসন্তান অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। উচ্চকণ্ঠ রাজনীতিক ছিলেন না কখনোই। শিক্ষক, পরবর্তীতে সাংবাদিক হিসেবে তাঁর পরিচিতি সীমাবদ্ধ ছিলো শিক্ষিত আলোকিতজনদের মধ্যে, যাঁদের সংখ্যা সবসময়ই অপ্রতুল। অথচ সত্তুরের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তাঁর কাছে রাউজান এলাকা থেকে বিপুল ভোটে পরাজিত হন তৎকালীন জাতীয় পরিষদের স্পীকার ফজলুল কাদের চৌধুরী।
অধ্যাপক খালেদ এবং আমাদের গ্রামের বাড়ির মধ্যেকার দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার, আমাদের পরিচয়সূত্র সেটি নয়। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমেদ। সময়টি ১৯৭৬ এবং আমি সাম্যবাদী দলের ছাত্র সংগঠন ‘জাতীয় ছাত্র আন্দোলন‘এর সক্রিয় কর্মী হিসেবে থাকতাম চন্দনপুরার অধ্যাপক আসহাবউদ্দীনের একরুমের একটি বাসায়। চবি‘র বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম আমি তখন। সাম্যবাদী দলের প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা। অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন ও অধ্যাপক খালেদ দু‘জন দুই মেরুর রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের দু‘জনের ভেতরকার গভীর সখ্য ও পরমতসহিষ্ণুতার বিষয়টি আমি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি অনেকগুলো দীর্ঘ আড্ডায়। ওসময়ের লেখা আসহাবউদ্দীন আহমেদের বেশ কয়েকটি বই প্রচণ্ড কাটাকুটির ভেতর থেকে উদ্ধার করে ফ্রেশ পাণ্ডুলিপি আমার হাতের লেখায় তৈরি। আমি অনেক সময় একাই যেতাম খালেদ সাহেবের বাসায়। কিছু বলতে হতো না। মৃদু হেসে আমার হাতে একটি ক্ষীণ স্বাস্থ্যের খাম শুধু ধরিয়ে দিতেন অধ্যাপক আসহাব উদ্দীনের জন্যে।
একদিন আমি মা–বাবার একমাত্র ছেলে জানতে পেরে তিনি বলেছিলেন, আপনি শিক্ষকতায় আসুন। আমি একটি হাইস্কুলে আপনার জন্যে চেষ্টা করতে পারি। শিক্ষকতা আপনার লেখালেখির জন্যে অনুকূল হতে পারে। অর্থাৎ প্রচ্ছন্নভাবে তিনি নিতান্ত স্নেহের বশে তাঁদের ভাষায় ‘চরমপন্থী রাজনীতি’ থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শই দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতি থেকে ঠিক ওই সময়টিতে বেরিয়ে আসা সম্ভব ছিলো না আমার।
আসহাব উদ্দীন সাহেবের উৎসাহে আমার এক বাণ্ডিল কবিতা আমি অধ্যাপক খালেদকে পড়তে দিই, যদিও তার আগেই আজাদীতে আমার বেশ কটি কবিতা ছাপা হয়ে গিয়েছে। দুই কীর্তিমানের একজনও আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু শৈলী আয়োজিত ‘সাংবাদিকতা ও মুক্তিযুদ্ধে অধ্যাপক খালেদ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এই স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেলো আমার।