গণহত্যা চলেছে ৯ মাস ধরে। ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর’৭১ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে এই হত্যাযজ্ঞ চলেছে। যতই দিন যাচ্ছে গোটা দেশের বিক্ষিপ্ত ঘটনা দেখে শিহরিত হয় না এমন পাষাণ হৃদয় এই বঙ্গে নেই। ৭১ এর প্রজন্ম হিসেবে আমরা যেভাবে কেঁপে উঠি হয়তো আজকের প্রজন্ম সেভাবে উপলব্ধি
করতে পারে না। আমরা ত্রিশ লক্ষ শহীদের কথা বলি। কেউ খাতায় লিখে রাখেনি কোথায় কয়জন মরল। হয়তো ১০ জন বেশি বা ১ লক্ষ বেশি বলি, তাতে কী? ত্রিশ লক্ষ শব্দটি দিয়ে ঘটনার ভয়াবহতা উন্মোচিত হয় ক্ষণে ক্ষণে, মননে, চিন্তায়। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ৯ মাসে শরণার্থী ক্যাম্পে
মৃত্যুর সংখ্যা আট লক্ষ আটষট্টি হাজার। দুর্ভাগ্য হলো একাত্তরের গণহত্যা এখনো বিশ্ববাসীর কাছে অজানা এবং আজো মেলেনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
চেঙ্গিস খানের ইরাক, ইরান হত্যাকাণ্ড, নাগাসাকি–হিরোশিমাতে আমেরিকার আনবিক বোমা নিক্ষেপ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তুরষ্কের আর্মেনীয় হত্যা ও গণউচ্ছেদ, স্ট্যালিনের শ্রম শিবির ও মাও সেতুং এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে হিটলারের ইহুদি হত্যাকে হার মানিয়েছে
একাত্তরের গণহত্যা। ২৫ মার্চ রাতে দ্বিতীয় প্রহরে তিলোত্তমা রাজধানীতে ঠিক কত মানুষের বা কয় হাজার মনুষ্য নিধন উৎসব উদ্যাপিত হয়েছে তার পরিসংখ্যান কোনোদিন পাওয়া যাবে না। সাহিত্যিকদের কবিতা উপন্যাসে উঠে এসেছে, রক্তাক্ত হয়নি এমন খাল বিল হাওড় নদীর মতো কোনো স্রোতস্বিনী
জলাশয় বাংলায় পাওয়া যাবে না। বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়া রক্তের পরিমাণ ঠিক কত হবে তার অনুমান করাও সম্ভব নয়।
দীর্ঘদিন ধরে ২৫ মার্চ ও একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টি নানাভাবে আলোচিত হয়ে আসছে। এই ইস্যুতে প্রথম বাধা হল জাতিসংঘের গণহত্যা দিবস। ২০১৫ সাল থেকে ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক ‘গণহত্যা ও প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে দাপ্তরিকভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। প্রশ্ন হলো
এই দিবসের কারণে কী ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর গণহত্যা দিবসটি এবং ১৯৭১ সালের গণহত্যা স্বীকৃতি পাবে না?
২৫ মার্চ অপারেশন ‘সার্চ লাইটের’ ঘোষিত সশস্ত্র নিধনযজ্ঞের সমতুল্য কোন ঘটনা ইতিহাসে নেই। একদিনে এত মৃত্যুর ঘটনার নজির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও নেই। তাৎক্ষণিকভাবে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এলে বিরানব্বইয়ে বসনিয়ার মর্মস্পর্শী গণহত্যার পুনরাবৃত্তি হতো না। সভ্যতার দূর ভবিষ্যতেও যাতে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় তৎজন্য আন্তর্জাতিক সচেতনতার জন্যেই স্বীকৃতি প্রয়োজন।
দীর্ঘ অর্ধশতকেও স্বীকৃতি না পাওয়ার পেছনে মূলত আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক স্বার্থপরতাই দায়ী। পাক–মার্কিন– চীন সমঝোতা না হলে একা পাকিস্তান বর্বরতম এরূপ পদক্ষেপ নিতে এতো সাহস দেখাতো না। ইয়াহিয়া ধরে নিয়েছিল, এক কোটি বাঙালি নিধন করলেও কিছুই হবে না। আমেরিকা ও চীন পাশে থাকায় এই
ঔদ্ধত্য দেখানো ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর পক্ষে সম্ভব হয়েছে। আজকের প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছিল। এক কোটি শরণার্থীর জন্য আমেরিকা এক বস্তা চাল বা ডাল পাঠায়নি। প্রতিদিন পাখির মতো গুলি করে মারা হচ্ছিল হাজার হাজার বাঙালি। এই
নৃশংসতা থামানোর অনুরোধ নিয়ে ইন্ধিরা গান্ধী ওয়াশিংটনে গিয়ে নিক্সনের দরবারে হাজির হয়েছিলেন। দ্বি–পাক্ষিক বৈঠকে নিক্সন মিসেস গান্ধীকে সহানুভূতি জানানো দূরের কথা, কথাবার্তার মধ্য দিয়ে নিক্সন শরণার্থী ও বাঙালিদের প্রতি উপহাস করেছেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে চেঙ্গিস খান আর হিটলারের নামের
পাশে নিক্সনের নামও উচ্চারিত হবে। এটাও ঠিক যে, মার্কিন জনগণ, সংবাদপত্র ও শিল্পী সাহিত্যিকরা পথে পথে ভিক্ষা করে শরণার্থীদের জন্য টাকা, ওষুধ ও খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়েছে। জর্জ হ্যারিসনকে নাগরিকত্ব দিয়ে ঋণ শোধ না হলেও কৃতজ্ঞতা জানাতে কার্পণ্য করিনি।
সেই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, কিউবাসহ ১১টি সমাজতান্ত্রিক দেশ। এই দেশগুলো শরণার্থীদের জন্য পাঠিয়েছে খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ ও ডাক্তার। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠিয়েছে অস্ত্র আর গোলাবারুদ। জাতিসংঘের কুটগৃহে আমেরিকার সব কূটনৈতিক দুতিয়ালীকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন ব্রেজনেভের সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ভেটো প্রয়োগ না হলে আমাদের পরিণতি হতো তামিল, কুর্দী আর ফিলিস্তিন।
একটা কথা ঠিক, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জিয়া ও এরশাদ একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে টু–শব্দটি করেনি। এই সমর শাসন চলেছে ১৯৯৬ পর্যন্ত এরা সখ্য গড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যারা একাত্তরে এক বস্তা চাল দিয়ে সাহায্য করেনি। শেখ হাসিনা ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, গণহত্যার স্বীকৃতির
বিষয়গুলো সামনে আসে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলার বিচার করতেই তাঁর ৫ বছর সময় চলে যায়। সুখের কথা হলো, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমেই হাতে নেয়া হয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার। অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছেন বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়েছিল আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা ও যুব সমাজ। শাহবাগ আন্দোলন এর বড় প্রমাণ।
বাংলাদেশ মিশনগুলোতে নিশ্চয় অনেক কাজ আছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর কানাডার উইনিপেগের যাদুঘরে আয়োজন করা হয় ‘রিমেম্বার এন্ড রিকগনাইজ’ দ্য কেস অফ বাংলাদেশ শীর্ষক সেমিনার। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে আমাদের রাষ্ট্রদূতদের এ জাতীয় সেমিনার আয়োজনে সচেষ্ট হতে হবে। সভা, সমাবেশ ও
তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ গ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে ভয়াবহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেবার সময় এসে গেছে। পৃথিবীবাসীকে এটাও স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত যে, একাত্তরের গণহত্যার ও ২৫ মার্চের গণহত্যা স্বীকৃতি না পেলে মানবসভ্যতা পুণর্বার এমন নৃশংসতার মুখোমুখি হতে বাধ্য।
১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে না গেলে পরিস্থিতি এতো প্রতিকূল হতো না। রাশিয়া এখনো জাতিসংঘের অন্যতম ভেটো ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্র। রাশিয়ার পুতিন চেয়েছিল বলেই সিরিয়ায় মার্কিন হামলা ঠেকানো গেছে। বাংলাদেশ যদি জাতিসংঘে গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য আবেদন পেশ করে, তবে এই আবেদন
গৃহীত হবার প্রচুর সম্ভাবনা আছে। এখনো ভারত, রাশিয়া ও কিউবার মতো রাষ্ট্রগুলোর সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে। সমস্যা শুধু একটাই, তা হলো আজকের পৃথিবীর বহু মানুষ জানে না এমন একটি বর্বরতা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ঘটিয়েছিল। সময় অনেক পাল্টেছে, মানুষের মনোজগতেও অনেক মৌলিক
পরিবর্তন এসেছে। আন্তর্জাতিক কুটনীতিতেও বহু নীতিগত পরিবর্তন ঘটেছে। একেবারে পতনের মুহূর্তে চীন, পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায়নি। আজ পাকিস্তান রাষ্ট্রটিই ধ্বংসের মুখে। এমন পরিস্থিতিতে একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি আমেরিকা জোরালো কণ্ঠে বিরোধিতা করার সম্ভাবনা কম। বিরোধিতা করলেও কিচ্ছু যায় আসে না। আসুন লক্ষ কোটি মানুষের আবেদন নিয়ে আমরা জাতিসংঘে আবেদন পেশ করি। আমি নিশ্চিৎ এবারও আমরাই জিতবো।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট