স্বাস্থ্যের উপর সিয়ামের প্রভাব

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজান। বলা হয়ে থাকে, দিনে সিয়াম আর রাতে কেয়াম। অর্থাৎ সিয়াম বা সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজের ভোগ-লালসাকে আত্মাহুতি দিয়ে ঈমানকে শক্ত ও মজবুত করাই হল মাহে রমজানের অন্যতম শিক্ষা। সিয়ামের অর্থ হচ্ছে আল্লাহতায়ালার নির্দেশ পালনে খাঁটি নিয়তে পানাহার হতে বিরত থাকা। আমার রাসূল (সা:) বলেন, ‘হে যুবকবৃন্দ! তোমাদের মধ্যে যার বিয়ে করার সামর্থ রয়েছে সে বিয়ে করবে আর যার সামর্থ নেই সে সিয়াম পালন করবে। এটা তার জন্যে রক্ষাকবচ হবে’ (মুসলিম শরীফ ২/২০১৮)। রমজানে স্বাস্থ্যের উপর খুব একটা ঝুঁকি নেই বললেই চলে।
সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে সুস্থতা অন্যতম একটি ফ্যাক্টর আর এই সুস্থতা আল্লাহর অপার রহমতেই নিয়ন্ত্রিত হয়। সেজন্যে রমজানে রোজা পালনের জন্য সুস্থ দেহ ও মন অতীব জরুরি। বয়স্ক, বৃদ্ধ এবং দুর্বল লোক যাদের সিয়াম পালন করার ক্ষমতা নেই তারা সিয়াম পালন করবে না এবং তাদের উপর সিয়াম ক্বাজা ও জরুরি নয়। কারণ তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির কোন সম্ভাবনা নেই, ফলে ভবিষ্যতেও তারা সিয়াম পালন করতে সক্ষম হবে না। এমতাবস্থায় তাদেরকে প্রতিটি ছুটে যাওয়া সিয়ামের জন্য ফিদিয়া বা কাফ্‌ফারা আদায় করতে হবে। এ অভিমতটি ইবনে আব্বাস (রা:) ও ইমাম বোখারীর। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা:) শেষ বয়সে অত্যন্ত বার্ধক্য অবস্থায় দু’বছর ধরে সিয়াম পালন করেননি এবং প্রতিটি সিয়ামের পরিবর্তে একজন মিসকিনকে গোশ্‌ত-রুটি আহার করাতেন। মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কোরআনের অকাট্য দলিল থেকেই উপরোক্ত কথাটি উপলদ্ধি করা যায়, ‘কেউ যদি অসুস্থ হয়ে যায় কিংবা কেউ যদি সফরে থাকে তাহলে সে ব্যক্তি সমপরিমাণ দিনের রোজা (সুস্থ হয়ে অথবা সফর থেকে ফিরে এসে) আদায় করে নেবে। যারা রোজা রাখার শক্তি রাখে (কিন্তু রোজা রাখে না), তাদের জন্যে এর বিনিময়ে ফিদিয়া থাকবে (এবং তা) হচ্ছে গরীব ব্যক্তির (তৃপ্তি ভরে) খাবার দেয়া’- সূরা বাকারা ১৮৫।
প্রতি বছর যারা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয় কিংবা পাকস্থলীতে অতিরিক্ত এসিড নিঃসরণ হয় তাদের ক্ষেত্রে রোজা প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। পবিত্র রমজানের সময় দীর্ঘ উপবাসের কারণে অনেক ক্ষেত্রে ডিহাইড্রেশন বা পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। সাধারণত রমজানে রোজার সময় খাবারের ফ্রিকোয়েন্সি হ্রাস পায়-যার প্রভাব পড়ে নিঃসরণ শক্তি, শরীরের ভর এবং শরীরের চর্বির উপর। দিনের বেলা খাবার নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা রোধ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে পারে। উপবাসের সময় মানবদেহ সম্পূর্ণরূপে বিষাক্ত পদার্থগুলো অপসারণ এবং পাচনতন্ত্রকে মেরামত করতে সক্ষম হয়। দিনের বেলা খাবার গ্রহণকে সীমাবদ্ধ করার কারণে উচ্চ কোলেস্টেরল, হৃদরোগ এবং স্থূলতার মত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। বিখ্যাত পুষ্টিবিদ ক্লেয়ার মাহী বলেছেন, ‘রোজা অন্ত্রটি পরিষ্কার করে দেয় এবং তার আস্তরণকে শক্তিশালী করে। এটি অটোফ্যাজি নামক প্রক্রিয়াটিকেও উদ্দীপিত করতে পারে, যেখানে কোষগুলি স্ব-পরিচ্ছন্ন হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপজ্জনক কণাগুলি অপসারিত হয়। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, উপবাস মস্তিষ্কে নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর নিঃসরণ করতে পারে। উপবাস মস্তিষ্কের কোষগুলো সুরক্ষিত করতে সহায়তা করে এবং হতাশা এবং উদ্বেগ হ্রাস করতে পারে, পাশাপাশি ডিমেন্‌শিয়া হওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলতে পারে। উপবাসের কারণে চর্বি হ্রাস ও পাতলা পেশি অর্জন করতে পারে উপবাসকারীগণ। টেকসই ওজন হ্রাস কেবল নিয়মিত উপবাসের মাধ্যমেই সম্ভব। এটি হজম ব্যবস্থা এবং সামগ্রিক বিপাক উন্নত করতে সহায়তা করে। অনেক স্বাস্থ্য গবেষক নিশ্চিত করেছেন যে, লিপিড, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং হরমোন বিপাকের পরিবর্তন উপবাসের সময় ঘটে। রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তিদের মেজাজ এবং মনন এর উপর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে, যা দিনের বেলায় বৃদ্ধি পায়। রমজান মাসে রোজাদারগণের অধিকাংশই মাথা ব্যথার অভিযোগ করে থাকেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাইগ্রেনের ১৪% ক্ষেত্রে টেনশন মাথা ব্যথার জন্যে হয়ে থাকে। ঘুমের অভাব, হাইপোগ্লাইসেমিয়া এবং ডিহাইড্রেশন এর কারণে মাথা ব্যথা হয়ে থাকে। রমজানে কায়িক পরিশ্রম কম থাকার কারণে শরীরের উপর চাপ কম হয়। রোজাদারগণের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে রমজানের রোজা। দীর্ঘক্ষণ উপবাস থাকার কারণে যখন ইফতার গ্রহণ করা হয় তখন রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যায়-এই ইনসুলিন শরীরের মাংসপেশী অথবা মস্তিকে গ্লুকোজ সরবরাহ করে এবং এর মাধ্যমে শক্তি সঞ্চিত হয়। অতিরিক্ত গ্লুকোজ লিভারে মষুপড়মবহ হিসাবে জমা হয়। উপবাস শুরু হওয়ার ৬ থেকে ২৪ ঘন্টা পর ইনসুলিন হঠাৎ কমে গিয়ে মষুপড়মবহ ভেঙ্গে যায়, ফলে গ্লুকোজ বের হয়ে শক্তি উৎপাদিত হয়। দিনের বেলা পানাহার, ধূমপান ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকার কারণে রোজাদারদের মাঝে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জিত হয়।
রমজান আমাদের নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা দেয়, যেমন : সঠিক সময়ে ইফতার, সঠিক সময়ে সেহেরী, সঠিক সময়ে তারাবিহ্‌ ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতি ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। উপবাসের কারণে মানবদেহের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যায় তবে তা নিয়ন্ত্রিত-এটাও মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বড় মেহেরবানী। কেননা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অস্বাভাবিক কমে গেলে যুঢ়ড়মষুপধবসরধ নামক উপসর্গ সৃষ্টি হয়। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শরীরে কাঁপুনি শরু হয়, শরীর থেকে ঘাম ঝরতে থাকে, শিরার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় ও রক্তচাপ কমে যায়। ফি বছর পেটের পীড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে রমজান বিশেষ আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। ইফতারী আইটেমে অতিরিক্ত তেল দিয়ে তৈরি নাস্তা বর্জন করা বাঞ্চনীয়। উপবাসের কারণে শরীরের কোষগুলো পরিচ্ছন্ন হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপজ্জনক কোষগুলোকে রক্ষা করে। বিষন্নতা ও উদ্বেগকে হ্রাস করে। রমজানে রোজা শরীরের চর্বি হ্রাস করতে সহায়তা করে এবং চর্বিহীন পেশীর সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। রমজান পাচক পদ্ধতি ও সামগ্রিক বিপাককে উন্নত করে। ইফতারী আইটেমে খেজুর, ফলমূল ও মিষ্টান্ন থাকা প্রয়োজন। মনে রাখবেন, ইফতার যেন ভোগ-বিলাস না হয়। সেহেরী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও খাবার। সেহেরী রোজাদারদের জীবনী শক্তি উন্নত করে এবং উপবাস সহজ ও সহনশীল করে। এই খাবারটি ধীরে ধীরে কার্বোহাইড্রেটগুলো সমৃদ্ধ করে, যেমন: শস্যের রুটি, চাল ইত্যাদি রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
লেখক: সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি, জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতি রোমন্থন ও বাস্তবতা
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা