জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ

ঐতিহাসিক বদর দিবস
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। মহিমান্বিত মাস রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করুন। ২য় হিজরির ১৭ রমজান, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ ১৩ মার্চ শুক্রবার মক্কা মোকাররমা ও মদীনা মনোওয়ারা মধ্যবর্তী বদর নামক স্থানে কাফির মুশরিকদের সাথে মুসলমানদের সর্ব প্রথম সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ মহান দিবসকে পবিত্র কুরআনের ভাষায় “ইয়াওমুল ফুরকান” তথা সত্য-মিথ্যার নিরূপনের দিন বলা হয়েছে। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এদিনে আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলমানদের একটি ক্ষুদ্র কাফেলাকে কাফিরদের বিশাল বাহিনীর উপর বিজয় দান করে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে সত্যের জয়, মিথ্যার পরাজয় সুনিশ্চিত করেছেন।
পবিত্র কুরআনের আলোকে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়:
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আত্মরক্ষামূলক বদর যুদ্ধ মুসলমানদের এক অবিস্মরণীয় বিজয় দিবস। কাফির সর্দার আবু জেহেলের নেতৃত্বে রণকৌশলে পারদর্শী অস্ত্র-সস্ত্রে সুসজ্জিত কাফিরদের এক বিশাল বাহিনীর সঙ্গে সার্বিক বিচারে এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মুসলমানরা যে গৌরব ও বিজয় ছিনিয়ে এনেছে তা ছিল আল্লাহ প্রদত্ত কুদরতের অবারিত সাহায্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আল্লাহ বদর প্রান্তরে তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন, তখন তোমরা হীনবল ছিলে, সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা: ৩ আল ইমরান, পারা ৪, আয়াত: ১২৩)। বদরের ময়দানে এই অচিন্তনীয় বিজয় ও গৌরব অর্জিত হয়েছিল একমাত্র আল্লাহর অফুরন্ত করুণা ও তাঁর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসাধারণ নেতৃত্বের জন্য। বদর যুদ্ধে আল্লাহতা’আলা প্রথমে এক হাজার, অতঃপর তিন হাজার, অতঃপর পাঁচ হাজার ফিরিস্তা দিয়ে কাফিরদের উপর মুসলমানদের সাহায্য করেছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, যখন তোমরা আপন প্রভুর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে, তখন তিনি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করেছেন আর বলেছেন আমি তোমাদের সাহায্যকারী হাজার সারিবদ্ধ ফিরিস্তা দ্বারা। (সূরা: আনফাল, আয়াত: ০৯)।পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে, যখন হে মাহবুব আপনি মুসলমানদেরকে বলেছিলেন, তোমাদের জন্য কি একথা যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রভূ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন তিন হাজার ফিরিস্তা অবতীর্ণ করে। (সূরা: আল ইমরান, পারা:৪, আয়াত: ১২৪)।
বদর যুদ্ধের কারণ ও বিবরণ:
এ যুদ্ধের কারণ প্রসঙ্গে বলা যায়, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা মনোওয়ারায় হিজরতের পর ইসলামের ক্রমবর্ধমান উন্নতি, অগ্রগতি ও সফলতা দেখে ইসলাম বিদ্বেষী মক্কার কাফির মুশরিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আবু জেহেল, ওতবা, শায়েবা প্রমূখ মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার দৃঢ় প্রত্যয়ে দ্বিতীয় হিজরিতে আবু জেহেলের নেতৃত্বে ৯৫০ জনের এক বিশাল কাফেলা মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়। কুরাইশদের কাফেলায় ছিল ১০০ অশ্বারোহী ৭০০ উষ্টারোহী অবশিষ্ট পদাতিক। আবু জাহেল বাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনে কুরাইশ দলপতিদের গতিরোধ করার জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনশত তেরজন মুসলমানদের নিয়ে গঠিত ক্ষুদ্রবাহিনীর এ কাফেলা মদীনা থেকে রওয়ানা হয়ে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বদর নামক স্থানে তাবু স্থাপন করেন। বদর হলো একটা কুপ, বদর ইবনে আমের নামক এক ব্যক্তি তা খনন করেছিল, তৎসংলগ্ন প্রাঙ্গণই বদর প্রান্তর। ৩১৩ জনের মধ্যে ২জন অর্শ্বারোহী, ছয়টি বর্ম, আটটি তরবারী এবং সত্তর জন উষ্ঠারোহী অবশিষ্ট সকলে ছিলেন নিরস্ত্র। আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস, নবীজির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য অসীম মনোবল ও দৃঢ় প্রত্যয়ে তারা আত্মরক্ষামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। কুরাইশদের বিশাল কাফেলা রীতিমত অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে সত্তর বছর বয়স্ক কুরাইশ নেতা রণদক্ষ বীর সেনাপতি আবু জাহেলের নেতৃত্বে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাল কিন্তু মহান স্রষ্টার অপার কৃপায় মুসলমানরাই যুদ্ধে বিজয় লাভ করল কাফির দল শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করলো। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলো। আল্লাহর ঘোষণা, সত্য সমাগত বাতিল অপসৃত, বাতিল তো অপসৃত হবারই (সূরা: বনী ইসরাঈল, পারা:১৫, আয়াত: ৮১)।
এ যুদ্ধে মুসলমানদের সাহায্যার্থে ফিরিস্তাগণ বদর ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন কোন কোন সাহাবী তাঁদেরকে স্বচক্ষে দেখেছেন, বদরে অংশগ্রহণকারী মুহাজির ও আনসার সাহবীদের সবাই ছিলেন ধৈর্যশীল ও পরহেজগার। [তাফসীরে নূরুল ইরফান, ১২৪,১২৫ নং আয়াতের সংশ্লিষ্ট তাফসির, কৃত: মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.)]
বদর যুদ্ধের পাক্কালে নবীজির প্রার্থনা:
দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান শুক্রবার হযরত বেলাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র কণ্ঠে সুললিত ফজরের আজান ধ্বনিত হল। রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে মুজাহিদ সাহাবাগণ জামাতসহকারে ফজরের নামায আদায় করলেন, নামাযান্তে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিগলিত চিত্তে সজল নয়নে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ তুমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছো তা পূরণ করো, হে আল্লাহ মুসলমানদের এই ক্ষুদ্র কাফেলাকে তুমি ধ্বংস করে দিলে পৃথিবীতে তোমার ইবাদত করার মতো আর কেউ থাকবেনা। (মুসলিম শরীফ, খন্ড ২য়, পৃ: ৯৩, মিশকাতুল মাসাবীহ, পৃ: ৫৩১, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং: ৩০০৬)
নবীজির দুআ কবুল হয়ে গেল, আল্লাহর নির্দেশক্রমে, নবীজি সাহাবায়ে কেরামকে সুসংবাদ দিলেন, বললেন তোমরা ভীত হয়োনা শংকিত হয়োনা সম্মুখপানে অগ্রসর হও। আল্লাহর নির্দেশে ফিরিস্তাদের একটি বিশাল বহর তোমাদের সাহাযার্থে আগমন করতেছেন, আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হলো বদরে প্রথমে মল্লযুদ্ধ শুরু হলো কুরাইশদের পক্ষে ওতবা, শায়বা ও ওলীদ তিনজন ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে মুসলমানদেরকে মল্লযুদ্ধে আহবান করলো, নবীজির ইঙ্গিতে হযরত ওবায়দা (রা.) হযরত হামজা (রা.) ও হযরত আলী (রা.) মল্লযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, হযরত হামজা (রা.) প্রথম আঘাতেই শায়বাকে ধরাশায়ী করলেন, হযরত আলী (রা.) অলীদকে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন, হযরত ওবায়দা (রা.) ওতবার সাথে পেরে উঠছিলেন না হযরত হামজা (রা.) ও আলী (রা.) অগ্রসর হয়ে ওতবাকে হামলা করে নিহত করলেন। তিনবীরের ধরাশায়ী হওয়ার দৃশ্য দেখে কুরাইশ বাহিনী ময়দানে ঝাপিয়ে পড়লো যুদ্ধ প্রচন্ড আকার ধারণ করলো কুরাইশ দলপতি যথাক্রমে আবু জেহেল, ওতবা, রবীয়া, শায়বা প্রমূখ যুদ্ধে প্রাণ হারাল। কাফিরদের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হলো পক্ষান্তরে মুসলমানদের ১৪ জন শাহাদত বরণ করলেন, এদের মধ্যে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনসার। প্রকৃত পক্ষে বিগত সাড়ে চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে মুসলমানদের সাথে কাফির মুশরিকদের যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তাতে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা শত্রু সৈন্য থেকে অধিক ছিলনা। অধিকাংশ সময় মুসলমানরাই বিজয়ের গৌরব অর্জন করেছে, ইসলামের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে মুসলমানরা স্রষ্টার উপর অটল বিশ্বাস ঈমানী চেতনা ও নবী প্রেমে উদ্দীপ্ত হয়ে বিজয়ের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মহানবীর সদয় ব্যবহার:
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে যাদের বন্দী করা হলো তাদের প্রতি মহানবীর মানবতা ও উদারতার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। নবীজি এরশাদ করেছেন,বন্দীদের প্রতি সৌজন্যমূলক ব্যবহার করো” তিনি বাধ্যতামূলকভাবে মুক্তিপণ আদায় করেননি। বন্দীদের সাধ্যানুসারে, মুক্তিপণ আদায় করেছিলেন। যারা নিতান্ত দুর্বল ছিল তাদেরকে বিনা পণেই মুক্তি দিয়েছিলেন, আবু গুররাহ নামী একজন কবিসহ অনেককে ফিদয়া ব্যতীত মুক্তি দিয়েছিলেন। [মাদারিযুন নবুয়ত, পৃ: ৭৬, কৃত: শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (র.)]
শিক্ষিত বন্দীদের মূল্যায়ন:
বন্দীদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ছিল তাদের প্রত্যেককে মদীনার দশজন মুসলমান বালক বালিকাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব দেন। শিক্ষার আলো বিতরণে মহানবীর এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। নবীজি এরশাদ করেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ। (মা আরিযুন নবুয়ত, পৃ:৭৬)
মহান আল্লাহ আমাদেরকে বদরের আদর্শ শিক্ষা ও চেতনাকে ধারণ করে ইসলামের উপর অটল অবিচল থাকার তাওফিক নসীব করুন। শোহাদায়ে বদরের ওসীলায় আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্যের উপর সিয়ামের প্রভাব
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে