স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা সমূহের বার্তা

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | শনিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

১১ সেপ্টেম্বর শুনলেই সাধারণভাবে অনেকেরই মনে পড়ে যায় ২০০১ সালের আমেরিকায় টুইন টাওয়ারে সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার কথা। ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আরও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কারণ আমেরিকা কথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সমাপ্ত করে আফগানিস্তান থেকে ২০ বছর পর ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ছিল। যদিও ঘোষিত সময়ের আগে ৩১ আগস্ট ছিল তাদের শেষদিন। ১৮৯৩ সালের এই ১১ সেপ্টেম্বর, আমেরিকার শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত “দ্য পার্লামেন্ট অব ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস” এ স্বামী বিবেকানন্দ অভ্যর্থনার উত্তরে প্রায় চার মিনিটের ও কম সময়ের ছোট্ট কিন্তু দুর্দান্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। সেদিনের তাঁর সেই ভাষণ বিশ্বব্যাপী প্রচারের জন্য ছিল না আজকালের ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রামের মতো কোনও দ্রুতগামী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মুদ্রিত সংবাদপত্রের উপর নির্ভর করে তাঁর সেই বার্তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমেরিকা তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল।
তখনকার সময়ের বিদ্যমান অসহিষ্ণুতা এবং সব ধরনের ধর্মান্ধতার অবসান করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন তাঁর ঐ বক্তৃতায়।
সে দিনের সে বক্তৃতায় আমেরিকাবাসীর মন কেড়ে নেওয়ার ফলস্বরূপ ১১ সেপ্টেম্বরের পরে আরও পাঁচ দিন বক্তৃতা করতে হয়েছিল স্বামীজিকে। ১৫, ১৯, ২০, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল তারিখ গুলো। ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ভ্রাতৃভাব এবং আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক নিয়েও অনেক কিছু বলেছিলেন তিনি । তিনি এমন কিছু বলেছিলেন, যা আজ একুশ শতকের তৃতীয় দশকের শুরুতেও এই বিশ্বে সমান প্রাসঙ্গিক। তা নাহলে আজকাল ও কেন অতীশ দীপঙ্কর পীস ট্রাস্টসহ অনেক সংগঠন আন্তঃধর্মীয় সংলাপ আয়োজন করে? বাংলাদেশে বিদ্যমান বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সহমর্মিতা, সংহতি নিশ্চিত করার জন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের যোগাযোগ এবং শান্তি বিনির্মাণের জন্য এই ধরনের সংলাপের আয়োজন করেন সংগঠনগুলো। আমার জানা মতে, অংশগ্রহণকারীরা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, শ্রেষ্ঠত্ব, অবিশ্বাস, ধর্মীয় সহিংসতা, চরমপন’া কাটিয়ে সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ ভিত্তিক শিক্ষাগুলি শেখার এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং নৈতিকতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে সমাপনী ভাষণে বলছিলেন, বিবদমান ধর্মীয় কোন্দলকে মিটিয়ে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক মসৃণ করার চেষ্টায় আমাদের নিয়োজিত থাকা উচিত। এ ধর্মসম্মেলন আমাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈপরীত্যের মধ্যেও সাধারণ সম্প্রীতির যে আবহ তৈরি করেছে তাঁর জন্য আয়োজক কমিটিকে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য বলে মত দেন তাঁর ভাষণে। তিনি আরও বলেন, সকল ধর্মীয় ঐক্যের সাধারণ ক্ষেত্র সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হয়ে থাকে।
তবে এখানে যদি কেউ আশা করে যে, এই ঐক্যটি যেকোনও একটি ধর্মের বিজয় এবং অন্যের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আসবে, আমি তাকে বলি, ভাই, আপনার পক্ষে এটি একটি অসম্ভব আশা। খ্রিস্টানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই ; তবে প্রত্যেককে অবশ্যই অন্যের ধর্ম বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে হবে এবং তার স্বতন্ত্রতা রক্ষা করতে হবে। যদি কেউ নিজের ধর্মের একচেটিয়া বেঁচে থাকার এবং অন্যের ধ্বংসের স্বপ্ন দেখে তবে তাকে বলি, শীঘ্রই প্রতিটি ধর্মের পতাকায় শত প্রতিরোধ সত্ত্বেও লিখিত “বিবাদ নয়; সহায়তা, বিনাশ নয়; পরস্পরের ভাব গ্রহণ, মতবিরোধ নয়; সমন্বয় ও শান্তি”। অসাম্প্রদায়িকতা হলো এমন একটি আদর্শিক মতবাদ, যেখানে সকল মানুষে মানুষে পারস্পরিক নৈতিকতা, ভ্রাতৃত্ববোধ সর্বোপরি একাত্মতা রক্ষা করে। যে ব্যক্তি অসামপ্রদায়িক ধারণাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে, নিরপেক্ষভাবে নিজের উদারতা ও সাম্যতা প্রকাশ করে তাকে একজন অসাম্প্রদায়িক বলি। বিশ্বে বিরাজমান ধর্ম মতবাদসমূহ সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল, শুধু আমার ধর্মের মাধ্যমেই বিধাতাকে পাওয়া যাবে এটা মোটেও ঠিক নয়। তাঁর মতে বিধাতার বক্তব্য হলো- যে কেউ, যে কোন রূপেই আমার কাছে প্রার্থনা করুক না কেন, আমি তাদের আহ্বানে সাড়া দিই এবং কাছে পৌঁছে যাই; সব ধরনের সাধনার পথে আমাকে পাওয়া যাবে। তিনি বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি এবং এর ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মান্ধতা দীর্ঘকাল ধরে এই সুন্দর পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। এটি পৃথিবীকে সহিংসতায় ভরিয়ে দিয়েছে এবং প্রায়শই মানুষের রক্তে রক্তাক্ত হয়েছে আমাদের এ সুন্দর পৃথিবী, সভ্যতা ধ্বংস করেছে, এমনকি কোন কোন দেশকে, জাতিকে হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
যদি এই ভয়াবহ দানবগুলির অস্তিত্ব না থাকতো, তবে মানবসমাজ এখনকার চেয়ে অনেক বেশি উন্নত হতো। তাই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সম্ভাষণে নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন, আমি সেই ধর্মভুক্ত, যে ধর্ম বিশ্বকে সহনশীলতা এবং সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা উভয়ই শিখিয়েছি। আমরা কেবল সর্বজনীন সহনশীলতায় বিশ্বাস করি না তবে আমরা সমস্ত ধর্মকেই সত্য হিসাবে গ্রহণ করি। স্বামী বিবেকানন্দ পরে একটি বিশেষ সভায় প্রাচ্যদেশের নারীদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলেন।তাঁর মতে, কোন জাতির প্রগতির শ্রেষ্ঠ মাপকাঠি নারীদের প্রতি তার মনোভাব। মাতৃজাতির প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ সম্মান। আপনারা জানেন প্রথমদিনে তিনি সম্বোধনে আমেরিকাবাসীগণকে ‘সিস্টারস্‌ এন্ড ব্রাদার্স’ বলে সম্ভাষণ করেছিলন। যখন সেই সন্ন্যাসী নারীকে প্রথম স্থান দিলেন এবং সমগ্র জগৎকে নিজ পরিবার বলে ঘোষণা করিলেন, তখন সেই মহাসম্মেলনে আনন্দের যে শিহরণ সঞ্চারিত হয়েছিল তা বহুবার শুনেছেন। বলেন, ‘আমাদের স্বজাতীয় কোন ব্যক্তি এভাবে সম্বোধন করার কখা ভাবতে পারলো না!’ সেই মুহূর্ত থেকেই মূলত তাঁর সাফল্যের সূত্রপাত হয়েছিল শিকাগোয়।
মজার ব্যাপার হলো, সম্মেলনের ব্যবস্থাপকগণের কাছে চঞ্চল শ্রোতৃবর্গকে কৌশলে শান্ত একটা অস্ত্র হয়ে উঠেছিলেন স্বামীজী। বিভিন্ন সময়ে পরে অনেকবার শ্রোতৃবর্গকে শান্ত করার জন্য আয়োজকরা বলেছিলেন, তাঁরা যদি ধৈর্য্য ধারণ করে অপেক্ষা করেন, তাহলে সর্বশেষে স্বামীজী একটি গল্প বলবেন বা একটি বক্তৃতা দিবেন।সম্মেলনে ১৫ সেপ্টেম্বর ভ্রাতৃভাব নিয়ে দেওয়া বক্তৃতার উপর শিকাগো সানডে হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণী থকে জানা যায়, স্বামীজীর মতে মানুষের ভ্রাতৃত্বই বহু-আকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য। এই ভ্রাতৃত্ব একটি স্বাভাবিক অবস্থা, কারণ আমরা সকলে একই ঈশ্বরের সন্তান। অতএব সার্ব্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের জন্য সমগ্র মানবজাতিকে অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য আমাদের মিলনভূমি প্রশস্ত করা প্রয়োজন।
১৯শে সেপ্টেম্বর নবম দিবসের অধিবেশনে স্বামীজী তাঁর বক্তৃতায় বলেন, কেউ ধনীর ঘরে জন্ম নিয়ে জন্ম থেকেই সুখভোগ করছে- সুস্থ শরীর ও উৎসাহপূর্ণ সুন্দর মন, কিছুরই অভাব নাই; আবার কেউ কেউ জন্মাবধি দুঃখভোগ করছে-কারও হাত পা নাই, কেউ বা জড়বুদ্ধি এবং অতি কষ্টে জীবনযাপন করছে। তাঁর প্রশ্ন, যখন সকলেই এক ন্যায়পরায়ন ও করুণাময় ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্ট, তখন কেউ সুখী এবং কেউ দুঃখী হলো কেন? ভগবান কি তাহলে কারও কারও পক্ষপাতী? অতএব স্বীকার করতে হবে সুখী বা দুঃখী হয়ে জন্মাবার পূর্বে নিশ্চয় বহুবিধ কারণ ছিল, যার ফলে জন্মের পর মানুষ সুখী বা দুঃখী হয়; তার নিজের পূর্বজন্মের কর্মসমূ্‌হই সেই-সব কারণ। সবার ঈশ্বর এক এবং তিনি মহান।
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে যখন ধর্মীয় উস্কানিমূলক পোস্ট, ছবি বা ভিডিও দেখি, তখন মনে হয় এই ধর্মীয় হানাহানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বাতাবরণে স্বামীজীর সেই পরধর্ম ও পরমত সহিষ্ণুতার বাণী আজও কতটা প্রাসঙ্গিক। তিনি গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব ও আদর্শে ১৮৯৮ সালে বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সেবামূলক আদর্শের কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বর্তমানে আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন সারাবিশ্বে সেই একই ভাবাদর্শ অনুসরণ করে চলেছে।
লেখক : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধষড়যন্ত্র-হত্যার কদর্য রাজনীতি ও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ